কলকাতা থেকে

নিজ দেশে অন্যরকম এক ভ্রমণ

বিশ্বকাপে টানা হারতে থাকা বাংলাদেশ দলের পিছু ঘুরতে ঘুরতে মানসিক আর শারীরিক শ্রান্তি দূর করার দারুণ এক দাওয়াই হিসেবেও কাজ করল এই ভ্রমণ।
Gede DHarshona road

ভিন দেশ থেকে নিজের দেশে কয়েক ঘণ্টার জন্য ভ্রমণ! শুনলে একটু অদ্ভুত লাগতে পারে। কিন্তু বিশেষ কারণে তেমন এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার আনন্দ যোগ হলো জীবনে। বিশ্বকাপে টানা হারতে থাকা বাংলাদেশ দলের পিছু ঘুরতে ঘুরতে মানসিক আর শারীরিক শ্রান্তি দূর করার দারুণ এক দাওয়াই হিসেবেও কাজ করল এই ভ্রমণ।

ভারতে বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা আমরা বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের ছয় মাসের মাল্টিপল ভিসায় একটা শর্ত ছিল। - 'একটানা ৩০ দিনের বেশি ভারতে অবস্থান করা যাবে না।'কিন্তু বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সব খেলা কাভার করতেও দরকার অন্তত দেড়মাস। সমাধান একটা খুঁজতেই হতো। এই ৩০ দিনের মেয়াদ বাড়ানোর আরও কিছু প্রক্রিয়া আছে। আমরা ক'জন এরমধ্য দিয়ে না গিয়ে ভাবলাম, কলকাতা থেকে যেহেতু কাছেই, দেশটা এক ঝলক ঘুরে আসি।

আগের রাতে নেদারল্যান্ডসের কাছে বিধ্বস্ত হওয়া বাংলাদেশ দলের কোন কার্যক্রম ছিলো না এদিন। এই ফাঁকা সূচিও উৎসাহ দিল আমাদের।

রোববার ভারতের ছুটির দিনের সকালে নাস্তা করে শিয়ালদহ থেকে ৭টা ৪০ মিনিটের গেদে লোকাল ধরে শুরু হলো যাত্রা। ট্রেনটি যেখানে গিয়ে থামে সেখানেই বাংলাদেশের বর্ডার, এপাশটা নদীয়ার গেদে, ওপাশটা চুয়াডাঙ্গার দর্শনা। প্রায় ১৩০ কিলোমিটার পথ। ৩০টির মতন স্টেশনে থেমেও বৈদ্যুতিক ট্রেন আমাদের পৌঁছে দিল আড়াই ঘণ্টায়। হেমন্তের সকালে গ্রাম বাংলার চির পরিচিত প্রকৃতি, চেনা বাতাসের ঘ্রাণ সঙ্গী হলো। এই নিভৃতি, এই সতেজতা বেঁচে থাকার রসদ হিসেবে জরুরি, কাজের শক্তি যোগাতে তো বটেই।  

১৯৪৭ সালের দেশভাগের কোন সময় শিয়ালদহ স্টেশনের ট্রেনের সূচি। যেখানে আছে বাংলাদেশের জন্য কিছু পরিচিত নাম। ছবি: সংগ্রহ

শিয়ালদহ স্টেশনের সঙ্গে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের একটা ঐতিহাসিক ও আবেগের সম্পর্ক। দেশভাগের আগে অবিভক্ত বাংলার যোগাযোগের বড় আশ্রয় ছিল এই শিয়ালদহ। এখান থেকে খুলনা, গোয়ালন্দ ঘাট, রাজশাহী কত জায়গায় ছুটে যেত ট্রেন। একটা পুরনো ছবিতে দেখা মিলে চিটাগাং এক্সপ্রেস, সুরমা মেইল নামের ট্রেনও ছুটত এই পথে।

দেড়শো বছরেরও অনেক আগে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম ট্রেন লাইন চালু হয় এই রুট দিয়েই। সেই ১৮৬২ সালে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া থেকে বাংলাদেশের জাগতি পর্যন্ত ট্রেন চালু হলে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয় তৎকালীন পূর্ববাংলায়।

তারপর থেকে কত মানুষের স্মৃতি, হৃদয়ের ক্ষত, নাড়ির টান বহন করে বেড়িয়েছে এই পথ। পথটি সচল এখনো। তবে মাঝে বসেছে ইমিগ্রেশন খাতা, নানাবিধ আনুষ্ঠানিকতা। একই ভাষা, একই সংস্কৃতি, আত্মীয়তার একই বন্ধন থাকলেও আলাদা দেশের বাস্তবতা মেনে ছুটছে জীবনের স্রোত।

Dharshona
গেদে স্টেশনে নেমে ইমিগ্রেশন সেরে খানিক এগিয়েই বাংলাদেশ।

গেদে নদীয়া জেলার নিভৃত এক পল্লীগ্রাম। ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতায় ভিড় না থাকায় আমাদেরও সময় বেশি লাগেনি। গলায় অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড ঝুলতে থাকায় অনেকেই বিশ্বকাপ প্রসঙ্গে এগিয়ে এসে কথা বললেন। বাংলাদেশের বাজে পারফরম্যান্সে এপার বাংলার মানুষও মনে হলো বেশ হতাশ। 'এমন খেলছে কেন?' এই কমন প্রশ্নের উত্তরে নীরব থেকে অসহায়ত্ব প্রকাশ করা ছাড়া উপায় নেই। বাংলাদেশ প্রান্তে অবশ্য এসব প্রশ্নের ঝাঁজ আরেকটু কড়া।

ইমিগ্রেশন টেবিল থেকে চায়ের টং দোকান। সর্বত্র সাকিবদের ব্যর্থতায় কারণ খতিয়ে দেখার গবেষণা চলমান। কয়েকটা ঘণ্টা এর বাইরে থাকতে চাই বলে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল নিতে হলো। নিজ দেশের চেনা আবহ, মোবাইল নেটওয়ার্ক এসব প্রশ্নের স্রোত থেকে বাঁচিয়ে দিল সহজেই।

দর্শনায় আমাদের সময়টা উপভোগ্য করে দিতে ব্যস্ত ছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক রেজাউল করিম লিটন। তার  আতিথেয়তার উষ্ণতায় বাংলাদেশে চার ঘণ্টা সময় পার করে ফের পার হলাম ইমিগ্রেশন খাতা।

দুই প্রান্তের আনুষ্ঠানিকতা সারতে বেশিক্ষণ না লাগলেও দুই মিনিটের জন্য হাতছাড়া করে ফেলি গেদে-শিয়ালদহ

Gede Station
বাংলাদেশে গিয়ে আবার বাংলাদেশ থেকে ফিরে ভারতের গেদে স্টেশনে আমরা।

লোকাল। কি করব তা নিয়ে যখন ভাবছি দেখি আরেকটা ট্রেন এসে হাজির। ৪০ মিনিট পর সেই ট্রেনে চেপে রানাঘাট, রানাঘাট থেকে শিয়ালদহের ট্রেন পেতে সমস্যা হলো না।

ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামেও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এসব অঞ্চলে ভ্রমণ করলে যে কারো চোখে পড়বে। রোববার ছাড়া গেদে থেকে  ২৪ ঘণ্টায় পাওয়া যায় ১৮টি ট্রেন। রোববার স্বাভাবিকভাবে সংখ্যা কিছুটা কম।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লোকাল ট্রেনের কামরা। এসব ট্রেন চলে একদম ঘড়ির কাঁটা মেনে এবং খুব দ্রুত গতিতে

সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, এসব ট্রেনে ভাড়া অতি অল্প। শিয়ালদহ থেকে গেদে ১৩০ কিলোমিটার পথের ভাড়া মাত্র ৩০ রুপি। আগেও একাধিকবার এই পথে যাওয়া-আসা করার অভিজ্ঞতা থাকায় আমি সেটা জানতাম। আমার সহকর্মীরা এতটা পথ এত অল্প ভাড়া জেনে অবাক।  যাওয়া আসা মিলিয়ে ২৬০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করা যাচ্ছে কেবল ৬০ রুপিতে। একের পর এক ট্রেনে চেপে এখানকার জনপদের ব্যস্ততা পুরোপুরি বহন করছে এসব ট্রেন। ঢাকা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরের মুন্সিগঞ্জ কিংবা ৬০ কিলোমিটার দুরের মানিকগঞ্জ থেকে অফিস করার কথা চিন্তাও করা যায় না। অথচ এখানে দিব্যি ১০০ কিলোমিটার দূর থেকে এসেও কলকাতায় অনেকে রোজ অফিস করেন। এবং অতি অল্প যাতায়াত খরচে তারা সেটা করতে পারেন।

ভারতের সঙ্গে ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্সের মতই সীমান্তের এপার-ওপারে যোগাযোগ ব্যবস্থার এই বাস্তবতা ধরিয়ে দেয় বিস্তর ফারাকের ছবি! দেশের জন্য মনটা একটু দমে যায় এসব ক্ষেত্রে।

বিশ্বকাপ কাভার করতে এসে ক্রিকেটের বাইরে কী আর থাকা সম্ভব? সন্ধ্যার পর কলকাতা ফিরে রাতে বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের নৈশভোজের আমন্ত্রণে গিয়ে দেখা হয়ে গেলো ক্রিকেটারদের সঙ্গেই। ডাচ বিপর্যয়ের পর দলের ভেঙে পড়া মনোবলের কথা প্রকাশ্যেই জানিয়ে গিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। টুর্নামেন্টে এখনো তিন ম্যাচ বাকি থাকা যেন হাঁপিয়ে তুলেছে বাংলাদেশ দলকে। সব কিছুই লাগছে ভীষণ ভারি।

হাইকমিশনের খোলা প্রান্তরে অবশ্য বাতাসটা হালকা করার চেষ্টা ছিলো। আড়ষ্টতা ভেঙে ক্রিকেটাররাও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছেন। স্রেফ আড্ডা দেওয়ার মুডে কাটিয়ে দিতে পেরেছেন ঘণ্টা তিনেক। বিসিবি সভাপতি, বোর্ড পরিচালকরা উপস্থিত থাকা এর ভেতরেও প্রশ্নের খোঁজ চলছে। সেমিফাইনালের স্বপ্ন নিয়ে আশা একটা দলের কেন এমন হলো। পুরো স্কোয়াডের সবাই কীভাবে ছন্দহীন থাকেন? সাকিব বলে দিয়েছেন, প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা থাকলে তো ফলই ভিন্ন হতো। বাংলাদেশের আসলে অনেক কিছুতেই, অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বাকি।

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

1d ago