দেশি প্রকৌশলীদের দক্ষতায় সচল হলো বিকল ডেমু ট্রেন

চীন থেকে আমদানি করা ২০ সেট ডেমু ট্রেন মাত্র ৪ বছর চলার পর প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে অকার্যকর হয়ে পড়ে। দেশের প্রকৌশলীদের প্রচেষ্টায় দিনাজপুরের পার্বতীপুরে রেলওয়ে লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপে সফলভাবে সেগুলোর ইঞ্জিনের যান্ত্রিক পরিবর্তন ও সংযোজন করে এক সেট ডেমু ট্রেন আবারও চলাচলের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
দেশি প্রকৌশলীদের দক্ষতায় অচল এ ডেমু ট্রেনটি সচল হয়েছে। ছবি: স্টার

চীন থেকে আমদানি করা ২০ সেট ডেমু ট্রেন মাত্র ৪ বছর চলার পর প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে অকার্যকর হয়ে পড়ে। দেশের প্রকৌশলীদের প্রচেষ্টায় দিনাজপুরের পার্বতীপুরে রেলওয়ে লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপে সফলভাবে সেগুলোর ইঞ্জিনের যান্ত্রিক পরিবর্তন ও সংযোজন করে এক সেট ডেমু ট্রেন আবারও চলাচলের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।

২০১৮ সাল থেকে ডেমু ট্রেনগুলো যান্ত্রিক সমস্যার কারণে পড়ে ছিল। মেরামতের পর ট্রেনটি আবারও পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন রুটে চালানো হয়।

এ বিষয়ে পার্বতীপুর রেলওয়ে কর্মকর্তারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, গত রোববার বিকেলে পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রুটে একটি ডেমু ট্রেন পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হয়। এরপর সোমবার সেটি বাংলাদেশ রেলওয়েকে হস্তান্তর করা হয়েছে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চীন থেকে ২০ সেট ডেমু ট্রেন আমদানি করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ওই ট্রেনের মাধ্যমে কাছাকাছি দূরত্বে ব্যাপকহারে যাত্রী পরিবহন করা। চীনের তানশাং ইন্টারন্যাশনাল ও ডানিয়াল টেকনিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ওই ডেমু ট্রেনের নির্মাতা। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ট্রেনগুলো এক ধরনের বিশেষ সফটওয়্যার দিয়ে পরিচালিত হয়। তবে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সেই প্রযুক্তি কখনোই বাংলাদেশকে হস্তান্তর করেনি। এর মডিউল বিকল হলে নতুন মডিউলের সঙ্গে সফটওয়্যার সেটআপ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিত। এর জন্য চীনের প্রকৌশলীদের কাছে ধরনা দিতে হয়। যা ছিল অনেক ব্যয়বহুল।

এ ছাড়া প্রতিটি ডেমুতে ৪০টি মডিউল রয়েছে। যার প্রতিটির দাম প্রায় ৭ লাখ টাকা। চীনা প্রকৌশলীরা প্রযুক্তি হস্তান্তর না করায় একটার পর একটা ট্রেন বিকল হতে থাকে।

পার্বতীপুরের সেন্ট্রাল লোকোমোটিভ ফ্যাক্টরির রেলওয়ে কর্মকর্তারা ডেইলি স্টারকে জানান, প্রায় ২০ সেট ডেমু ট্রেনই ৪ বছর পর বেশ কিছু প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে অকার্যকর হয়ে পড়ে। পরে রেলওয়ে কর্মকর্তারা বিভিন্ন রুটে ডেমু চলাচল স্থগিত করে। যার ফলে সারাদেশের যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েন।

প্রতিটি ডেমু ট্রেনের পরিচালনকাল ৩৫ বছর থাকলেও মাত্র ৪ বছরে সেগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। পরে ২০১৮ সালে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিষ্ক্রিয় ডেমু ট্রেনগুলো মেরামতের জন্য সরবরাহকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু সরবরাহকারী সংস্থাটি মেরামতের যে চার্জ দাবি করে, তা আমদানি ব্যয়ের প্রায় সমান বলে জানান পার্বতীপুরের কর্মকর্তারা।

২০২০ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ রেলওয়ে তার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ডেমু ট্রেনটিকে আবারও সক্রিয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। একই বছরের শেষ দিকে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার সেন্ট্রাল লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপে ২টি ডেমু ট্রেন আনা হয়।

রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান, ডেমু ট্রেনটি মেরামত করতে বিশেষজ্ঞদের ১ বছরের বেশি সময় লেগেছে। কেন্দ্রীয় ওয়ার্কশপে মেরামতের জন্য আরেকটি ট্রেনের যান্ত্রিক ত্রুটি সমাধানের কাজ চলছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী ও আনবিক শক্তি কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান গতকাল রোববার ডেইলি স্টারকে জানান, ডেমু ট্রেনগুলো একটি সফ্টওয়্যার-ইলেকট্রিক মডিউলেটর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের কাছে এই ধরনের মডিউলের জ্ঞান অভাব ছিল।

ডেমু ট্রেন পরিচালনার জন্য প্রতিটি ডেমুতে ৪০টি ইলেকট্রিক-সফ্টওয়্যার মডিউল রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বিশেষজ্ঞরা ইনভার্টার দিয়ে মডিউলটি পুনরায় স্থাপন করেন। ডেমুর পাওয়ার সেকশনে চীন থেকে সরবরাহ করা ব্যাটারিগুলোও স্থানীয় বাজারে সহজলভ্য পার্টস ও ব্যাটারির সেট দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। যান্ত্রিক বিষয়ে তেমন কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।'

ডেমু ট্রেনের পরিবর্তন ও কাস্টমাইজেশনের জন্য সব খুচরা জিনিস ব্যবহার করা হয়েছে, যা দেশের বাজারে পাওয়া যায় ও সস্তা, বলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মো. আসাদুজ্জামান।

তিনি জানান, দেশি প্রযুক্তিতে ভবিষ্যতে অচল হয়ে পড়ে থাকা সবগুলো ডেমু ট্রেনই সচল করা সম্ভব। তবে অবশ্যই দক্ষ জনবল থাকতে হবে।

অচল ডেমু ট্রেনটি মেরামত করতে কত খরচ হয়েছে, তা এখনো হিসাব করা যায়নি। তবে, আনুমানিক ৫০ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে বলে জানা গেছে।

পার্বতীপুর উপজেলায় বিআরের সেন্ট্রাল লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপের প্রধান নির্বাহী মো. রফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে জানান, ডেমু ট্রেনগুলোর সিস্টেম ও মডিউল পরিবর্তন করে সেগুলো সচল করা হয়েছে। অন্যান্য অচল ট্রেনগুলোও মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

তিনি আরও জানান, পরীক্ষার ট্রায়াল চলাকালীন ডেমু ট্রেনটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭৪ কিলোমিটার গতিতে চালানো হয়েছে। ট্রেনটির চালক মশিউর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি অন্তত ৭০০ থেকে ৮০০ যাত্রী বহন করতে পারবে এবং সফলভাবে চালানো যাবে।'

বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মঞ্জুর-উল আলম চৌধুরী স্থানীয় প্রযুক্তিতে পরিবর্তনের পর মেরামত করা ডেমু ট্রেনের প্রথম ট্রায়াল রানে উপস্থিত থেকে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'দেশীয় বিশেষজ্ঞরা স্থানীয়ভাবে পাওয়া খুচরা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে এই সফলতা অর্জন করেছেন। যা স্থানীয় তহবিল সংরক্ষণে সহায়তা করেছে। এই ধরনের সফল চেষ্টা বাংলাদেশ রেলওয়েকে এগিয়ে নিতে উৎসাহ যোগাবে।'

'আমাদের বিশেষজ্ঞরা তাদের দক্ষতা দেখিয়েছেন। রেলের প্রকৌশল কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করা হবে', বলেন তিনি।

Comments