আন্তর্জাতিক নারী দিবস

‘ডিজিটাল স্পেস’ কি শুধুই পুরুষের জন্য

ডিজিটাল স্পেস’ কি শুধুই পুরুষের জন্য
ছবি: ফ্রিপিক

'একজন নারী হিসেবে, বাংলাদেশে অনলাইনমাধ্যমগুলো ব্যবহার করা এখনো বেশ চ্যালেঞ্জিং। নারী কিংবা জেন্ডার সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে অশোভন মন্তব্য, সহিংসতার খবরগুলো নিয়ে মজা করা এবং ভিকটিমকে দোষারোপ করা এবং সমস্যাগুলোর জন্য নারীর দিকেই বারংবার আঙুল তোলা আমাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে', — বলেন অহনা অরনি হাসান (২৬)। 

দেশের ক্রমবর্ধমান ডিজিটালাইজেশন নিয়ে গর্ব করার সময় এখনই, তবে আমরা মুদ্রার অন্য দিকটিকে উপেক্ষা করতে পারি না। 'ডিজিটাল স্পেস' বাংলাদেশে নারীদের জন্য এখনো নিরাপদ নয়। ২০২২ সালে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশে একটি সমীক্ষা চালায়। যেখানে দেখা যায় দেশের প্রায় ৬৩ দশমিক ৫১ শতাংশ নারী অনলাইন হয়রানি ও সহিংসতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি শুধু রিপোর্ট করা সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে সমীক্ষা ফলাফল করা হয়েছে। বাস্তবিক অর্থে দেশে নারীদের ডিজিটাল নিরাপত্তার বাস্তব পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

'বাংলাদেশের পাবলিক পরিসরগুলো যেমন- মেলা, রাস্তা এবং গণপরিবহন, নারী এবং শিশুদের জন্য এতটাই অনিরাপদ; ডিজিটাল পরিসরও যে একই রকম অনিরাপদ তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ অফলাইন কিংবা অনলাইন উভয় ক্ষেত্রেই, এটি শুধু যৌন হয়রানি নয় বরং আগ্রাসন, বুলিং এবং অশ্লীল ভাষার ব্যবহার হিসেবেও প্রকাশ পেতে পারে', বলেছেন নবনিতা চৌধুরী, পরিচালক,জেন্ডার, জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি (জিজেডি) এবং প্রিভেনটিং ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন ইনিশিয়েটিভ, ব্র্যাক। 

সাইবার অপরাধ কখনো কখনো আরও বেশি বিপজ্জনক হতে পারে কারণ সাইবার অপরাধীদের জন্য সেটা বেনামে করার সুযোগ রয়েছে৷ তারা সহজেই ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে এবং শিকারের জন্য ফাঁদ তৈরি করতে পারে। ডিজিটাল অপরাধীরা সহজেই তাদের ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টও লুকাতে পারে, ফলে তাদের ট্র্যাক করা এবং বিচারের আওতায় আনা বেশ কঠিন কাজ হয়ে পড়ে।

'অনলাইনে নারীদের হয়রানির সবচেয়ে সাধারণ ধরনগুলোর মধ্যে একটি হলো ভিকটিমকে দোষারোপ করা৷ 'ভিকটিমকে দোষারোপ করা শুধু শারীরিক জায়গাতেই সীমাবদ্ধ নয়৷ যখন একজন নারী অনলাইনে হয়রানির বিষয়ে কথা বলেন, তখন তাকে প্রশ্ন দিয়ে আক্রমণ করা শুরু করে যে, কেন সে অনলাইনে ছবি পোস্ট করেছে বা তার ফটোতে এমন পোশাক পরেছে? অপরদিকে নারীর যদি তেমন কোনো দোষ ও না থাকে তাহলে তাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করা হয় কেন সে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে',—বলে ব্যাখ্যা করেন নবনিতা চৌধুরী। 

ভুক্তভোগীদের দোষারোপ করার এই সংস্কৃতি, অনলাইনে হয়রানি এবং সহিংসতার বিষয়ে কথা বলার আগে এবং রিপোর্ট করার আগে ভুক্তভোগীকে শতবার ভাবতে বাধ্য করে। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন)-এর সিইও কানিজ ফাতেমা বলেন, 'তরুণী এবং কিশোরীরা সাধারণত তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গেও ঘটনা শেয়ার করতে চায় না কারণ তারাও সাধারণত ভিকটিমকেই দোষারোপ করে।'

নারীদের জন্য নিরাপদ 'ডিজিটাল স্পেস' নিয়ে আলোচনা করার ক্ষেত্রে ট্রান্সওমেন এবং জেন্ডারভিত্তিক বিভিন্ন ব্যক্তিদের বাদ দিতে পারি না। 'ট্রান্সএন্ড'-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও লামিয়া তানজিন তানহা বলেন, 'আমাদের সমীক্ষা থেকে, আমরা দেখেছি যে বিপুল সংখ্যক ট্রান্সওমেন এবং কুইয়ার নারীরা অনলাইনে হেনস্তার সম্মুখীন হয়, বিশেষ করে প্রতারণা এবং ব্ল্যাকমেলিংয়ের। তাদের নিরাপত্তা অনলাইনে এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি আমাদের সামনে একটি বড় সমস্যা চিত্রায়ন করে। ট্রান্সজেন্ডার অনলাইন স্পেস-এর অ্যাক্সেসগুলো ব্যবহার করতে ভয় পান, অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তারা অনলাইনে চাকরির পোস্ট মিস করে যায়।'

তিনি আরও যোগ করেন, 'নারীদের কীভাবে হয়রানি বা সহিংসতার মুখোমুখি না হয়ে অফলাইন এবং অনলাইন উভয় স্থানেই থাকার অধিকার রয়েছে সে বিষয়ে আরও কার্যকরী আলোচনার প্রয়োজন। আইনি পদক্ষেপ অনিরাপদ স্থানগুলোর একমাত্র সমাধান হতে পারে না। বরং সমাজে একটি আচরণগত পরিবর্তনও প্রয়োজন। আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে সবাই এতে অংশ নেওয়ার পরিবর্তে হয়রানি বা সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। অনলাইন নেটিজেন হিসেবে শিষ্টাচার পরিবার এবং স্কুলে কথোপকথনের মাধ্যমে শেখানো উচিত।' 

প্রকৃতপক্ষে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ ২০১৮) সাইবার সহিংসতার বিরুদ্ধে নারীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, তাই আইনি পদক্ষেপ নেওয়া সর্বোত্তম পদ্ধতি হতে পারে না বলে মনে করেন লামিয়া তানজিন তানহা।

'বাংলাদেশের অনেক নারী 'অনলাইন হাইজিন' বজায় রাখে না। 'ডিজিটাল স্পেস' ব্যবহার করার সময় তাদের যে মৌলিক নিরাপত্তা ও ব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে সে সম্পর্কে তাদের পর্যাপ্ত সচেতনতা ও জ্ঞান নেই', — বলেছেন কানিজ ফাতেমা৷ 

'বিডিওএসএন' নিয়মিত সচেতনতা সেশনের আয়োজন করে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত অনলাইন নিরাপত্তা বিষয়ের ওপর বিভিন্ন একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে সেশনের আয়োজন করে থাকে। তিনি আরও বলেন, 'আমরা সেশনগুলোতে ছাত্র এবং শিক্ষক উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করি যাতে শিক্ষকরাও এই সমস্যাগুলো সম্পর্কে সচেতন হন এবং শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে পারে৷ যেহেতু এটি একটি একক সংস্থা তাই বাংলাদেশের সব নারীদের কাছে পৌঁছাতে সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে সরকার এবং অন্যান্য এনজিওগুলোরও অনুরূপ সেশন পরিচালনা করা অপরিহার্য।'

লামিয়া তানজিন তানহার মতে, 'আরেক ধরনের সচেতনতামূলক সেশনও প্রয়োজন।' তিনি বলেন, ''আমরা ভুলে যেতে পারি না যে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ট্রান্সজেন্ডারদের ও ডিজিটাল অধিকার রয়েছে। আমাদের 'সিসজেন্ডারদের' জন্য আরও সচেতনতামূলক সেশনের আয়োজন করতে হবে যাতে তারা এই অধিকারগুলো সম্পর্কে সচেতন হয় এবং সবাইকে ট্রান্সজেন্ডারদের সম্মান করা শিখতে হবে। হটলাইন এবং ওয়েবসাইটসহ ডিজিটাল অধিকার এবং নিরাপত্তার বিষয়ে ট্রান্সজেন্ডারদের অবগত করতে হবে। অনলাইন নিরাপত্তা সম্পর্কিত ট্রান্স সম্প্রদায়ের তথ্য, ডাটার অপ্রতুলতা রয়েছে, যা পরিবর্তন করা দরকার। 'ট্রান্সএন্ড'-এ, আমরা ইতোমধ্যেই আমাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন করার চেষ্টা করছি। যেমন, ডকুমেন্টারির মাধ্যমে ট্রান্স পিপল সম্পর্কে মানুসের মাঝে যে প্রচলিত ভুল ধারণার রয়েছে সেটি তুলে ধরা হয় ও সচেতন করার চেষ্টা করা হয়।'

সচেতনতা গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষার বিকল্প নেই। কানিজ ফাতেমা বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি সচেতনতামূলক সেশন এবং সেমিনারগুলো সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান করতে পারে না। আমাদের জাতীয় পাঠ্যক্রমে এখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) নামে একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমরা আইসিটির পাঠ্যক্রমে অনলাইন নিরাপত্তা সম্পর্কিত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারি যাতে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও এ বিষয়ে জানতে পারে।'

'সবশেষে, ডিজিটাল স্পেসে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করার সময় আমাদের উপরের মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। নারী এবং পুরুষের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল বিভাজন রয়েছে। সমস্ত মানুষ, বিশেষ করে নারীদের, ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তিতে সমান অ্যাক্সেস নিশ্চিত না করে ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়ে কথা বলতে পারি না', বলে মন্তব্য করেন নবনিতা চৌধুরী।

অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি কীভাবে ডিজিটাল বিভাজন ভেঙে ফেলা এবং অনলাইন স্পেসগুলোতে নারী এবং জেন্ডার-বৈচিত্র্যযুক্ত ব্যক্তিসহ সব ব্যক্তির অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। একই সঙ্গে তাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যেন, তারা অনলাইন স্পেস গুলোতে অ্যাক্সেস চালিয়ে যেতে পারে। প্রত্যেকেরই ইন্টারনেটে নিরাপদে ব্যবহার করার অধিকার রয়েছে।

 

মায়াবী অরণ্য: একজন নারীবাদী কর্মী। যিনি যুব সংগঠন 'কথা'র নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

অনুবাদ করেছেন আসিয়া আফরিন চৌধুরী

 

 

Comments

The Daily Star  | English
Kamal Hossain calls for protecting nation

Kamal Hossain urges vigilance against obstacles to nation-building effort

"The main goal of the freedom — gained through the great Liberation War — was to establish democracy, justice, human rights and build a society free from exploitation. But we have failed to achieve that in the last 54 years," says Dr Kamal

46m ago