যেমন হতে পারে ভবিষ্যতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম

সেমি অটোমেটেড সামাজিক মাধ্যম কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ এখনই করা সম্ভব। প্রচুর বট প্রোফাইল থাকতে পারে তখন। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে চাঙ্গা করতে কিংবা ধামাচাপা দিতে এসব বটগুলোতে ব্যবহার করা হতে পারে। সামাজিক মাধ্যম থেকে কারও আয় যদি কমে যায়, তাহলে অতিরিক্ত বট (ভুয়া প্রোফাইল) ব্যবহার করে সে আয় সমন্বয় করতে চাইবে। ব্যবহারকারীদের রুচি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন কনটেন্ট তৈরা করা সম্ভব হবে তখন।
যেমন হতে পারে ভবিষ্যতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
যেমন হতে পারে ভবিষ্যতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ছবি: সংগৃহীত

পেশাজীবীদের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইন সম্প্রতি ঘোষণা করেছে তারা ব্যবহারকারীদের জন্য পোস্ট লেখার ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করছে। স্ন্যাপচ্যাট নিজেদের এআই চ্যাটবট তৈরি করছে। ফেসবুকও তাদের প্ল্যাটফর্মে কীভাবে আরও কৃত্রিমে বুদ্ধিমত্তা সংযুক্ত করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছে। 

সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আরও বাড়ছে, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভবিষ্যতের সামাজিকমাধ্যম হতে যাচ্ছে সেমি অটোমেটেড বা আধা-স্বয়ংক্রিয়, অর্থাৎ, ব্যবহারকারীকে সবকিছু করতে হবে না, বা যেসব পোস্ট, প্রশ্ন-উত্তর বা কনটেন্ট দেখা যাবে, সেগুলোর সবই ব্যবহারকারীকেই তৈরি করতে হবে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি অনেক কনটেন্ট দেখা যাবে সামনে। 

বড় সামাজিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে লিংকডইনই যে প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে, সেটি যৌক্তিক। মাইক্রোসফটের মালিকানাধীন এই মাধ্যমটি মূলত পেশাজীবীরা ব্যবহার করেন। এখানে কাজ, কীভাবে দক্ষতা বাড়ানো যাবে, ব্যবস্থাপনা পরামর্শ- এমন সব পোস্টই দেওয়া হয়। আর এসব কাজেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পারদর্শিতা অনেক। তাই লিংকডইনেরই এই সুযোগ প্রথমে লুফে নেওয়ার কথা। 

যেমন হতে পারে ভবিষ্যতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
ছবি: সংগৃহীত

 
যদিও এখনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কনটেন্টের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে না লিংকডইন। প্রতিষ্ঠানটি শুধু ব্যবহারকারীদের মধ্যে 'কথোপকথন শুরুর প্ররোচনা দেয়' এমন কিছু কনটেন্ট তৈরি করছে, যেমন- কীভাবে সামাজিক মাধ্যমে আপনার প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং করা যায় কিংবা 'সামাজিক মাধ্যমে কীভাবে আপনার লেখা আরও ছড়িয়ে দেওয়া যায়'। এসব কনটেন্ট তৈরিতে লিংকডইনের সম্পাদনা পরিষদও ভূমিকা রাখছে। 

ছোট উদ্যোগ হলেও এটি নতুন একটি দিকের সূচনা। এই প্রথম বড় কোনো সামাজিক মাধ্যম প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবহারকারীদের সক্রিয় রাখার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি কনটেন্টের সাহায্য নিচ্ছে। এটি ঘটছে এমন এক সময়ে যখন বহুমাত্রিক সমস্যা নিয়ে খেই হারিয়েছে টুইটার আর ফেসবুকে কীভাবে পেইড সাবসস্ক্রিপশনকে সফল করা যায়, তা নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে ফেসবুককে। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভবিষ্যতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পথপ্রদর্শক হতে পারে। আধা-স্বয়ংক্রিয় সমাজিক যোগাযোগব্যবস্থাই হতে পারে ভবিষ্যতের পাথেয়। 

অবশ্য সামাজিক মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এটিই প্রথম নয়। ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামের মতো বড় বড় মাধ্যমগুলো দীর্ঘদিন ধরেই কৃত্রির বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকের রুচি ও চাহিদা অনুসারে তাদের ফিডে কনটেন্ট দেখাচ্ছে। এজন্যই আমাদের সবার ফিডে আলাদা আলাদা কনটেন্ট দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে প্রত্যেক ব্যবহারকারীকে ভিন্ন ভিন্ন ফিড দেখানো আর কনটেন্ট বানানো এক কথা না। প্রতিষ্ঠানগুলো এখন চাইলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি কনটেন্টের বন্যা বইয়ে দিতে পারে, যেটা কয়েক বছর আগেও সেম্ভব ছিল না। 

বর্তমানে 'জেনারেটিভ এআই' এর উন্মাদনা হয়তো অনেকের কাছেই বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। তবে এর ভবিষ্যত সম্ভাবনা অসীম। ব্যবহারকারীদের হাতে এখন এমন সফটওয়্যার আছে যা দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে ছবি, ভিডিও, টেক্সটসহ যেকোনো ধরনের কনটেন্ট তৈরি করা সম্ভব। আর সামাজিক মাধ্যমের হাতে আছে ব্যবহারকারীরে সব তথ্য (লোকেশন, পছন্দ-অপছন্দ)। এতে করে এআই আর সামাজিক মাধ্যমের একসঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্র এবং এর ফলে উভয়েরই অস্বাভাবিক উত্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। 

সেমি অটোমেটেড সামাজিক মাধ্যম কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ এখনই করা সম্ভব। প্রচুর বট প্রোফাইল থাকতে পারে তখন। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে চাঙ্গা করতে কিংবা ধামাচাপা দিতে এসব বটগুলোতে ব্যবহার করা হতে পারে। সামাজিক মাধ্যম থেকে কারও আয় যদি কমে যায়, তাহলে অতিরিক্ত বট (ভুয়া প্রোফাইল) ব্যবহার করে সে আয় সমন্বয় করতে চাইবে। ব্যবহারকারীদের রুচি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন কনটেন্ট তৈরা করা সম্ভব হবে তখন।

যদি সফলভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে ব্যবহারকারীরা হয়তো কৃত্রিম প্রোফাইলে ভর্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতেও পারে। এমনো হতে পারে এসব ভুয়া কিন্তু সামাজিকমাধ্যমের মান বাড়ানো ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা প্রোফাইলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে বিভিন্ন জায়গায় আপনি বাড়তি ডিসকাউন্টও পেতে পারেন। 

যদি সত্যিই এমনটা হয়, তাহলে মূল যে ধারণার ওপর ভিত্তি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্ম হয়েছে- বাস্তব মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ, নিজস্ব অনুভূতি, সংবাদ বা তথ্য অন্য মানুষদের সঙ্গে ভাগাভাগি করা, তার মৃত্যু ঘটবে। তখন নতুন আরেক ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্ম হবে এবং অনলাইন বিনোদনেরও নতুন ধারা সৃষ্টি হবে। 

সত্যি কথা বলতে এই ধারা ইতোমধ্যেই চালু হয়ে গেছে। ক্যারেকটারডটএআই এবং নোভেলএআই-এর সাহায্যে এখনই ব্যবহারকারীরা তাদের পছন্দের কোনো কল্পিত চরিত্র বা সুপারহিরোর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথোপকথন চালাতে পারে। ব্যবহারকারীরা মূলত কথা বলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবটের সঙ্গে, আর চ্যাটবটটি ব্যবহারকারীর পছন্দের চরিত্র সেজে তার সঙ্গে কথা বলে। এসব টুল ব্যবহারকারীকে যেভাবে দীর্ঘ সময় আটকে রাখে, সেটি অভাবনীয়। মাইক্রোসফটের বিং চ্যাটবট উন্মুক্ত হওয়ার পর মানুষের প্রতিক্রিয়াই দেখুন না! সবাই কীভাবে এই চ্যাটবটটি লুফে নিয়েছে এবং এটির সঙ্গে কথোপকথনো দীর্ঘ সময় ব্যয় করছে। 

ইন্টারনেটে ভার্চুয়াল কথোপকথন সঙ্গী 'রেপ্লিকা'র উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে এক্ষেত্রে। এই সফটওয়্যারটি একজন সত্যিকার মানুষের সঙ্গী (কৃত্রিম) হিসেবে কথাপকথন চালায়। রেপ্লিকা মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যেই এই কথোপকথন চালায়। একসময় এই প্ল্যাটফর্মটিতে রোমান্টিক রোল-প্লে করা যেত, রেপ্লিকা যেটিকে 'মানুষের বাস্তব সম্পর্কের প্রতিস্থাপন' হিসেবে বর্ণনা করতো। কিন্তু বর্তমানে এই ফিচারটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে, যাতে ব্যবহারকারীরা মোটেও সন্তুষ্ট নয়। ভবিষ্যতে আগ্রাসী কোনো কোম্পানি এমন সেবা চালু করবে না, সেটি নিশ্চিভাবে বলা যায় না। 

অনলাইন দুনিয়ার বড় খেলোয়াড়রা ইতোমধ্যেই এই পরিবর্তনকে লক্ষ্য করেছেন। গত মাসেই স্ন্যাপচ্যাট 'মাই এআই' নামের চ্যাটজিপিটি পাওয়ার্ড নতুন চ্যাটবট ফিচার উন্মুক্ত করেছে। ডিসকর্ডও ঘোষণা দিয়েছে তারা তাদের কথোপতখনকে আরও উন্নত করতে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করবে। ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠানও একই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। মেটার প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ গত ফেব্রুয়ারি মাসে বলেছিলেন, তার প্রতিষ্ঠান 'কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে কীভাবে মানুষকে আরও বিভিন্নভাবে উপকার করা যায়' তা নিয়ে কাজ করছে। মেটা ইতোমধ্যেই আভ্যন্তরীণভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারকারী সম্পন্ন ফেবসুকের একটি মডেল নিয়ে কাজ করছে। 

এআই আমাদের এতদিনের পরিচিত ইন্টারনেট দুনিয়াকে খুব দ্রুত বদলে দিচ্ছে। এই বদল যদি সামাজিক মাধ্যমেও ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়, তাহলে মানুষের কেমন অভিজ্ঞতা হবে, সেটি হয়ত আরও সময় গেলে বোঝা যাবে। 

তথ্যসূত্র: দ্য ভার্জ
গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

 

Comments