টুইটারের সময় কি ফুরিয়ে আসছে?

দায়িত্ব নেওয়ার পর টুইটারে একের পর এক নাটকীয় পরিবর্তন আনতে থাকেন মাস্ক।
টুইটারের সময় কি ফুরিয়ে আসছে
ছবি: রয়টার্স

বছরখানেক আগে টুইটার কেনার ইচ্ছার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন ইলন মাস্ক। এরপর বহু নাটক শেষে টুইটার কেনেন তিনি। বলা ভালো কিনতে বাধ্য হন। 

দায়িত্ব নেওয়ার পর টুইটারে একের পর এক নাটকীয় পরিবর্তন আনতে থাকেন মাস্ক। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, মাস্ক কখন কী করেন, সেটা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছে এবং তার পরিবর্তনগুলো টুইটারের জন্য কতটা ভালো কিংবা কতটা মন্দ, তা নিয়েও আলোচনা থামছে না। 

তবে তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বহু মানুষ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কিছু কিছু সিদ্ধান্ত আবার টুইটার ব্যবহারকারীদের জন্যও বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করছে। 

এমন পরিস্থিতিতে টুইটারের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে কি না, তা নিয়ে আলোচনার পালে নতুন হওয়া যোগ হয়েছে।

নতুন টুইটার

বর্তমানে যে টুইটার আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার সঙ্গে আগের টুইটারের অনেক ক্ষেত্রেই মিল নেই। এখন টুইটারে যাদের ব্লু টিক আছে, তাদের প্রত্যেককে মাসিক ৮ মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে। অথচ, আগে এটি ছিল কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আসল কি না, সেটি নির্ণয়ের অন্যতম মাপকাঠি। 

যদিও ব্লু টিকের জন্য অর্থ পরিশোধের সময় একটি ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া আছে, তবে সেটির যথার্থতা নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে। ইতোমধ্যে দেখা গেছে অসংখ্য মানুষ ভুয়া নামে কিংবা অন্যের নামে খোলা অ্যাকাউন্টে অর্থের বিনিময়ে ব্লু টিক চিহ্ন সংযুক্ত করেছেন। এতে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা ও ভুয়া তথ্য ছড়ানোর ঝুঁকে অনেক বেড়েছে। 

এপিল মাসের শুরুর দিকে মার্টিন লুইস নামের একজন অর্থনীতিবিদ অভিযোগ করেন, তার নাম ব্যবহার করে খোলা একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। ওই ভুয়া অ্যাকাউন্টটিও অর্থের বিনিময়ে ব্লু টিক সাবসক্রাইব করেছিল। 

যারা টুইটার ব্লু সাবসক্রাইব করছেন, তারা এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি ভিজিবিলিটি পাচ্ছেন। ফলে সামনের দিনগুলোতে টুইটারে কে রাজত্ব করবে, সেটি সহজেই অনুমেয়। আগে যেমন সাংবাদিকেরা কোনো একটি খবর টুইটারে প্রথম প্রকাশ করতেন এবং তা নিয়ে টুইটারে অলোচনা শুরু হতো, সেটি ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেছে, কারণ ব্রেকিং নিউজ সরবরাহকারী এমন অসংখ্য সাংবাদিক টুইটার ব্লু সাবসক্রাইব করেননি। 

ইতোমধ্যে দেখা গেছে, বিভিন্ন বিভাগে বিশ্বের অনেক বিখ্যাত মানুষেরা ব্লু টিক সাবসক্রাইব করেননি। 

এখন পর্যন্ত কত সংখ্যক ব্যবহারকারী ব্লু টিক সাবসক্রাইব করেছেন, তা নিশ্চিত করেনি টুইটার। তবে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, ৩০ কোটি টুইটার ব্যবহারকারীর খুব সামান্য একটা অংশই ব্লু টিক সবাসক্রাইব করেছেন।

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড

কে গুরুত্বপূর্ণ আর কে গুরুত্বপূর্ণ না, টুইটারের আগের প্রশাসকেরা সেটি নিজেরা নির্ধারণ করত এবং তাদের সিদ্ধান্তে যারা গুরুত্বপূর্ণ, তাদেরকে ব্লু টিক দেওয়া হতো। এলন মাস্কের মতে এটি ন্যায্য উপায় হতে পারে না। তিনি মনে করেন, কে গুরুত্বপূর্ণ আর কে গুরুত্বপূর্ণ না, তা নির্ধারণের ভার টুইটারের হাতে থাকা উচিত নয়। 

ইলন মাস্কের কথায় হয়তো যুক্তি আছে। তবে তার দায়িত্ব পালনকালেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে বিনামূল্যে ব্লু টিক দেওয়ার অফার দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকারী বেলিংক্যাট এমন একটি প্রতিষ্ঠান বলে বিবিসিকে নিশ্চিত করেছেন এর প্রতিষ্ঠাতা। 

মাস্ক নিজেই জানিয়েছেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে স্টিফেন কিং, ল্যাবরন জেমস ও উইলিয়াম শ্যাটনারের ব্লু টিকের অর্থ পরিশোধ করেছেন। এরা প্রত্যেকেই ব্লু টিক সাবসক্রিপশনের কড়া সমালোচনা করেছেন এবং এর জন্য নিজেরা কোনো অর্থ খরচ করবেন না বলে জানিয়েছিলেন। 

টুইটার জানিয়েছে, যেসব বিজনেস অ্যাকাউন্ট মাসে অন্তত ১ হাজার ডলারের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে না, তাদের অ্যাকাউন্টে বিজ্ঞাপন কার্যক্রম চালু রাখতে ব্লু টিক সাবসক্রাইব করতে হবে। অর্থাৎ, এখন থেকে বিজ্ঞাপনের পেছনে মাসে ১ হাজার ডলারের কম খরচকারী সব বিজনেস অ্যাকাউন্টকেই ব্লু টিক সাবসক্রাইব করতে হবে, যদি তারা বিজ্ঞাপনী সেবা চালু রাখতে চান।   

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য এটি এক বিশাল পরিবর্তন। আমরা জানি ডিজিটাল অ্যাডভার্টাইজিংয়ের মূল আয় কিন্তু বড় বড় কোম্পানির কাছ থেকে আসে না, বরং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়ই এখানে মূল আয়। 

সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার যে অঙ্গীকার মাস্ক করেছেন, সেটি তিনি নিজেই রক্ষা করতে পারছেন না। 

এটি কি নতুন মাধ্যমের সূচনা? 

মানুষ সাধারণত পরিচিত গণ্ডি ছেড়ে বের হতে চায় না। টুইটার তুলনামূলক ছোট সামাজিক মাধ্যম। বর্তমানে এটি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পার হলেও এখনো এর আবেদন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। 

মাস্কের অধীনে টুইটার যথেচ্ছভাবে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থাও সুখকর নয়। অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো টুইটারও ভুয়া তথ্য ছড়ানো ও অপব্যবহারের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারছে না। মাস্ক অত্যন্ত বিচক্ষণ একজন উদ্যোক্তা। প্রযুক্তি দুনিয়াকে অনেকভাবে আমূল বদলে দিয়েছেন তিনি। তার অনুসরণকারীর সংখ্যাও বিশাল। তিনি নিয়মিত বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করেন, তবে অনেকেই টুইটারের ব্যাপারে মাস্কের ওপর ভরসাও রেখেছিলেন। কিন্তু মাস্ক প্রতিনিয়ত তাদেরকে হতাশ করছেন। 

সংবাদমাধ্যমগুলোর অ্যাকাউন্টের সঙ্গে তাদের পরিচয় ও বিনিয়োগের 'লেবেল' লাগানো নিয়ে বিতর্কের জেরে কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (সিবিএন) এবং এনপিআর-এর মতো সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো টুইটার থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে নিয়েছে। মাস্ক দায়িত্ব নেওয়ার পর সঙ্গীতশিল্পী এলটন জন, কমেডিয়ান স্টিফেন ফ্রাই, মডেল জিজি হাদীদ তাদের টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। সাসবক্রাইব না করায় নিউ ইয়র্ক টাইমসের অ্যাকাউন্ট থেকেও ভেরিফিকেশন মাস্ক তুলে দিয়েছে টুইটার। 

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিও জানিয়েছে, সাবসক্রিপশনের জন্য তারা টুইটারকে কোনো অর্থ প্রদান করবে না। ফলে টুইটার বিবিসির 'গোল্ড চেকমার্ক' তুলে নিয়েছে। ফলে অনেকেই এখন বিবিসির আসল টুইটার অ্যাকাউন্ট নিয়ে দ্বিধায় পড়বে। একই ঘটনা ঘটতে পারে আরও অনেক সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রেও। 

তবে অর্থ পরিশোধ না করায় ব্লু টিক হারানোকে অনেকেই উদযাপনও করেছেন। আগে ব্লু টিক ছিল, এমন অনেকেই টুইট করে জানিয়েছেন, ব্লু টিক হারানো নিয়ে তাদের কোনো আক্ষেপ নেই। তারা বরং খুশি। 

উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেলিব্রেটি ও প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান টুইটার থেকে চলে যাওয়ায় কিংবা ব্লু টিক হারানোয় সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাছে এই মাধ্যমটির আবেদন আগের চেয়ে কমবে। কারণ এসব সেলিব্রেটিরা প্রচুর ব্যবহারকারীকে টুইটারে টেনে এনেছেন। তাদের অবর্তমানে এসব ব্যবহারকারীরাও টুইটার ব্যবহার ছেড়ে দেবেন বা কমিয়ে আনবেন। 

বিভিন্ন পেশা ও কাজের উপকরণ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে টুইটার সামনের দিনগুলোতে কোন পথে যায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি আছে বিশ্লেষক ও প্রযুক্তি প্রেমীদের। 

টুইটারের যখন এই দশা, তখন এর প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসি প্রায় টুইটারের ডিজাইনের আদলেই নতুন আরেকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তৈরি করেছেন, নাম 'ব্লুস্কাই'। 

জ্যাক ডরসির তৈরি এই মাধ্যমটি এখনো ছোট পরিসরে চলছে এবং আমন্ত্রণ ছাড়া কেউ এখনো এখানে একাউন্ট খুলতে পারেন না। তবে মাধ্যমটি ব্যবহার করছেন, বিবিসির এমন একজন সাংবাদিক বলেছেন, এর সম্ভাবনা আছে। 

ছোট কিংন্তু ইনফ্লুয়েন্সিয়াল- এমন সামাজিক মাধ্যমের গুরুত্ব ভবিষ্যতে অনেক বাড়বে। হয়তো ব্লুস্কাইয়ের হাত ধরেই সেটি শুরু হবে। 

সূত্র: বিসিসি

গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

Comments

The Daily Star  | English

More than 600 dengue cases reported in a day; 1 more die

The number of dengue cases in the country has crossed 600 in a single day for the first time this year, as experts urge authorities to take urgent measures to control the spread of the disease

1h ago