১৮ বছরে যেসব পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে ইউটিউব

২০০৫ সালের ২৪ এপ্রিল ভিডিওটি ইউটিউব নামের একটি ওয়েবসাইটে আপলোড করেন জাওয়াদ। তখন কি কেউ ভেবেছিল কী বিশাল ইতিহাসের শুরু হয়েছিল সেদিন!
১৮ বছরে যেসব পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে ইউটিউব
ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো চিড়িয়াখানায় ঘুরতে গিয়ে হাতির দীর্ঘ শুঁড় নিয়ে লাজুক মুখে একটি ভিডিও রেকর্ড করেছিলেন জাওয়াদ করিম নামের এক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ। হাতির খাঁচার সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় মাত্র ১৯ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে ওই তরুণ বলছিলেন, 'এদের সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হচ্ছে তাদের অনেক দীর্ঘ শুঁড় আছে। তাদের সম্পর্কে মোটামুটি এটাই বলা যায়।'  

২০০৫ সালের ২৪ এপ্রিল ভিডিওটি ইউটিউব নামের একটি ওয়েবসাইটে আপলোড করেন জাওয়াদ। তখন কি কেউ ভেবেছিল কী বিশাল ইতিহাসের শুরু হয়েছিল সেদিন! এই ইউটিউব একদিন বিশ্বের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও বিনোদনের জগতটাই পুরোপুরি পাল্টে দেবে, সেটি কী কেউ ভেবেছিল!

জাওয়াদ করিম, চ্যাড হার্লি ও স্টিভ চ্যান- এই ৩ জন মিলে ইউটিউব প্রতিষ্ঠা করেন। তারা ইন্টারনেটে ভিডিও দেখার প্ল্যাটফর্মের ঘাটতি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। খুব দ্রুত ইউটিউবের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। মাত্র এক বছরের মাথায় ওয়েবসাইটটিতে দৈনিক ২৫ মিলিয়ন ভিডিও প্রদর্শিত হচ্ছিল। আর ১০ বছরের মাথায় ওয়েবসাইটির মাসিক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যায় এবং তাদের ওয়াচ টাইম ছিল ৬০০ কোটি ঘণ্টা! তখন প্রতি মিনিটে ওয়েবসাইটটিতে ১০০ ঘণ্টারও বেশি ভিডিও আপলোড হচ্ছিল। বর্তমানে সাইটটিতে শত শত কোটি ভিডিও আছে। শখের নির্মাতা থেকে শুরু করে প্রফেশনাল নির্মাতা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ভিডিও স্থান পাচ্ছে এই প্ল্যাটফর্মে। হাসির, মজার, সামরিক, দুর্ধর্ষ, ভয়ঙ্কর, শিক্ষনীয় থেকে শুরু করে এমন কোনো বিষয় নেই, যে বিষয়ের কোনো ভিডিও ইউটিউবে নেই। 

যেভাবে শুরু

২০০৫ সালের ভ্যালেন্টাইনস ডে'র দিন www.youtube.com ডোমেইন চালু করেন জাওয়াদ করিম, চ্যাড হার্লি ও স্টিভ চ্যান। কিংবদন্তি অনুসারে, এই ৩ জন 'টিউন ইন, হুক আপ' নামে একটি অনলাইন ডেটিং পরিষেবা তৈরি করার পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। 

কিন্তু পেপ্যালের এই ৩ কর্মী মিলে যে সাইটটি তৈরি করেছিলেন, তা ব্যক্তিগত বিভিন্ন অভিজ্ঞতার ভিডিও সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করার জন্য যথেষ্ঠ। বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত- যেমন ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে যে ভয়াবহ সুনামি হয়েছিল কিংবা ২০০৪ সালে সুপার বোলের মাঝবিরতির অনুষ্ঠানে জ্যানেট জ্যাকসনের সেই বিখ্যাত ওয়্যারড্রোব ম্যালফাংশনের কোনো ভিডিও কেউ দেখতে চাইলে তখন সম্ভব ছিল না। এই ৩ উদ্যোক্তা ভাবলেন, তারা এমন একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবেন, যেখানে যে কেউ সহজেই যেকোনো ভিডিও আপলোড করতে পারবে এবং দেখতে পারবে। 

দৈনিক ৩০ হাজার দর্শকের মাইলফলক স্পর্শ করতে ইউটিউবের সময় লেগেছে মাত্র ১ মাস। ৬ মাস পর দর্শকসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ লাখে। এক বছরের মধ্যে ইউটিউবের দৈনিক ভিউ দাঁড়ায় আড়াই কোটি এবং তখন দৈনিক ২০ হাজার ভিডিও আপলোড হতো। ২০০৬ সালের অক্টোবরে ১.৬৫ বিলিয়ন ডলারে ইউটিউবকে কিনে নেয় গুগল। 

ইউটিউবের সফলতার মূল কারিগর তরুণরা, যাদের নিজেদের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ভিডিও আকারে সারা দুনিয়ার সঙ্গে শেয়ারে কোনো সমস্যা নেই। যে কেউ যেকোনো সময় চাইলে যেকোনো বিষয়ের ওপর ভিডিও আপলোড দিতে পারে। যদিও এর ইতিবাচক দিকের সঙ্গে কিছু নেতিবাচকত দিকও আছে। একদিকে যেমন ইউটিউবে বিড়ালের সুন্দর ও মজার মুহূর্তের ভিডিও দেখা যায়, আবার চরমপন্থীদের বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর প্রচালনা এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ছড়ানো হয়। ইউটিউব এক সময় হয়ে ওঠে নতুন এমটিভি, যা রাজনৈতিক ভাষ্য পরিবর্তন ও রাজনীতিকদের জনপ্রিয়তার হাতিয়ারে পরিণত হয়। আবার একই রকম ভিডিও দেখার পরামর্শ দেওয়া অ্যালগরিদমের কারণে অনেকেই আসক্ত হয়ে পড়ছিলেন এবং অনেকে আবার চরমপন্থার দিকেও ঝুঁকছিলেন। 

এ বছর ইউটিউবের বয়স ১৮ হলো। ইউটিউবকে অবিশ্বাস্য প্রভাবশালী বললেও অনেক কম বলা হয়। ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মটি কীভাবে সারা দুনিয়াকে চিরতরে বদলে দিয়েছে, তা দেখব এই লেখায়। 

মিউজিক শিল্পে রাতারাতি পরিবর্তন

১৩ বছর বয়সী জাস্টিন বিবারের খালি গলায় গাওয়া একটি গানের ভিডিও তার মা ইউটিউবে আপলোড করার পরই সারা বিশ্ব এই খুদে সংগীত শিল্পীর কণ্ঠের জাদু সম্পর্কে জানতে পারে। এর মাত্র ৩ বছরের মাথায় ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বিবারের কনসার্টের সব টিকিট কয়েক মিনিটের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে বিবারের অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা, দর্শক-শ্রোতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ প্রমাণ করে মিউজিক শিল্পে ইউটিউবের প্রভাব কতটা দৃঢ় হতে পারে। 

ইউটিউবের কল্যাণে শিল্পীদের এজেন্ট ও রেকর্ড লেবেলের হাত থেকে ক্ষমতা সরে শিল্পীদের হাতে আসে। শিল্পীরা চাইলে এখন তাদের গানের সব কিছুর ব্যাপারে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আগে এটা অসম্ভব ছিল। দেখা গেছে গান থেকে যা আয় হতো, তার বেশিরভাগই রেকর্ড লেবেল বা এজেন্টদের পকেটে চলে যেত। কিন্তু ইউটিউবের কারণে একেবারে অপরিচিত শিল্পীরাও তাদের কণ্ঠ ও মেধার জোরে রাতারাতি হিট হয়ে যাচ্ছেন। মুহূর্তের মধ্যে সারা বিশ্বের মানুষ তাদের গান শুনতে পারছেন। শিল্পীরাও সরাসরি তাদের শ্রোতা দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছেন। ইউটিউব আসার আগে এমন চিত্র কল্পনাই করা যেত না। রেকর্ড লেবেলগুলো নিজেদের শিল্পীদের নিয়ে যে 'কুল ক্লাব' তৈরি করেছিল, ইউটিউবের প্রভাবে তা হাওয়ায় উড়ে গেছে। 

দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্পী সাই-য়ের কথাই ধরুন না। দক্ষিণ কোরিয়ায় তিনি ৫টি গানের অ্যালবাম মুক্তি দিয়েছিলেন। সেগুলো তেমন একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। তাকে সেভাবে কেউ চিনতোও না। কিন্তু ২০১২ সালে গ্যাংনাম স্টাইল গানটি ইউটিউবে মুক্তি পাওয়ার পর সারা দুনিয়া যেভাবে এই গানে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল, সেটিকে অকল্পনীয়ই বলতে হবে। ইউটিউবের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে এই গান। জেলখানা থেকে শুরু করে স্টেডিয়াম, স্কুল থেকে শুরু করে গলির দোকান- সর্বত্র ছিল গ্যাংনাম স্টাইল গানের জয়জয়কার। দেশ-বিদেশের টেলিভিশন, রেডিও ও পত্রিকার কল্যাণে সাই অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে সারা বিশ্বের অন্যতম পরিচিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। দীর্ঘ সাড়ে ৪ বছর ইউটিউবের সবচেয়ে বেশি ভিউ হওয়া ভিডিওর রেকর্ড ধরে রেখেছিল এই ভিডিওটি। আজকের দিন পর্যন্ত গানটির ভিউ হয়েছে ৪৭০ কোটি বার। বলাই বাহুল্য, এই জনপ্রিয়তার সৌজন্যে তার ষষ্ঠ অ্যালবাম অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

যদিও সাই এবং বিবারের অকল্পনীয় জনপ্রিয়তার উদাহরণ ব্যতিক্রম, তবে এই ভিডিও প্ল্যাটফর্মের কারণে অসংখ্য গায়ক-গায়িকা রাতারাতি জিরো থেকে হিরো হয়েছেন। শন মেন্ডেস, টরি কেলি, চার্লি প্লুথের মতো বিদেশি তারকাদের পাশাপাশি বাংলাদেশেও অনেক শিল্পী ইউটিউবের কারণে নামডাক কুড়িয়েছেন। কয়েক বছর আগে প্রায় অপরিচিত এক সংগীত শিল্পী আরমান আলিফের 'অপরাধী' নামের একটি গান ইউটিউবে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। ঈগল মিউজিকের ব্যানারে প্রকাশিত গানটি একন পর্যন্ত প্রায় ৩৬ কোটি দর্শক দেখেছেন। এটি এখনো ইউটিউবে অন্যতম বেশি ভিউ পাওয়া বাংলা গান। 

বড় বড় বিনোদন কনটেন্ট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন যে নিজেদের স্ট্রিমিং সার্ভিস চালু করছে, সেখানেও ইউটিউবের প্রভাব আছে। যেমন- এনবিসি আগে তাদের কনটেন্টগুলো ইউটিউবে প্রকাশ করতো। কিন্তু পরে তারা তাদের ইউটিউব চ্যানেলটি বন্ধ করে দিয়ে হুলু নামের নতুন স্ট্রিমিং সার্ভিস চালু করে। 

আমাদের পপুলার কালচারকে ইউটিউব যেভাবে প্রভাবিত করেছে, সেটি আর কোনো মাধ্যম পারেনি। 

কম খরচে তৈরি ভিডিওর জনপ্রিয়তা

ইউটিউব প্রমাণ করেছে, দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য উচ্চ মানসম্মত ভিডিও হওয়ার প্রয়োজন নেই। ভিডিওর প্রোডাকশন এবং অডিওর পেছনেও অনেক খরচের দরকার নেই। বরং অল্প খরচে কিংবা বিনা খরচে তৈরি ভিডিওগুলোরও অনেক জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং এই ধরনের ভিডিওই ইউটিউবের জন্য উত্তম। 

সাধারণ ও অপেশাদারভাবে তৈরি এসব ভিডিওর যে বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল, ক্যাবল টিভি বা অন্যান্য বড় বড় প্রোডাকশন হাউজের ভিডিওতে তা খুঁজে পাওয়া যেত না। এখনো ক্ষুদ্র নির্মাতারাই ইউটিউবের প্রাণ। অনেক বড় বড় ইউটিউবারও অল্প সংখ্যক কর্মীর সাহায্যে ভিডিও নির্মাণ করছেন। এর পাশাপাশি আছে অপেশাদার ও সৌখিন ইউটিউবার। এরাই ইউটিউবকে জনপ্রিয়তার শিখরে রেখেছে। 

দর্শকরাই ইউটিউবের চালিকাশক্তি

ইউটিউবের জনপ্রিয়তার পেছনে ভিডিও নির্মাতাদের অনেক বড় ভূমিকা আছে সত্যি, তবে এখানে দর্শকরাই শেষ কথা। ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করার উদ্দেশ্য একটাই- ভিউ পাওয়া। যত বেশি ভিউ, তত বেশি লাভ। ক্যাবল টিভিতে প্রাইম টাইম স্লট থাকে, যখন সবচেয়ে বেশি দর্শক নির্দিষ্ট টিভি চ্যানেল দেখতে বসেন এবং প্রতিটি অনুষ্ঠানের রেটিং করা হয় যাতে বোঝা যায় কোন অনুষ্ঠান কত সংখ্যক দর্শক দেখছেন। ইউটিউবের হিসাব অনেক সহজ। ভিডিও আপলোড করার পর দর্শকরা চাইলে যেকোনো সময় সেটি দেখতে পারেন আর ভিডিওর সফলতা নির্ভর করে সেটি কত দর্শক দেখলো আর কত শেয়ার হলো, তার ওপর। আর ইউটিউবের ভিডিওর দর্শকসংখ্যা জানতেও কোনো রেটিং প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয় না, ভিডিওর নিচেই ভিউ কাউন্ট থাকে। ফলে নির্মাতাদের পাশাপাশি দর্শকরাও বুঝতে পারেন ভিডিওটি তার আগে কত মানুষ দেখেছেন। 

একটি ইউটিউব চ্যানেল তৈরি এবং বিকাশের জন্য এর নির্মাতারা এমন একটি সুযোগ পান যা বড় বড় টেলিভিশন চ্যানেলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও কখনো ছিল না- সেটি হচ্ছে দর্শকদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। ভালো নির্মাতারা তাদের দর্শকদের সঙ্গে যেগাযোগ রক্ষা করেন, তাদের মতামত শোনেন এবং সে অনুসারে ভিডিও তৈরি করেন। যেহেতু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগ আছে, তাই নির্মাতারাও সহজেই দর্শকদের প্রত্যাশা জানতে পারছেন। এতে করে কনটেন্ট বাছাই করতে তাদের অনেক সুবিধা হচ্ছে। নির্মাতাদের সঙ্গে দর্শকদের সরাসরি এই সম্পর্কের জন্ম দিয়েছে ইউটিউব, যা এখন বিনোদনের প্রতিটি ধারায় পালিত হচ্ছে।  

কোন ভিডিওটি জনপ্রিয় হবে বা নির্মাতাদের কাছে ভিডিওর প্রত্যাশা কী, এসব বিষয়ে দর্শকদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে। তবে ইউটিউবে আসলেই কী কী দেখা যায়, তার পুরো নিয়ন্ত্রণ দর্শকদের হাতেও নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো আছে। তবে এখানে আরও অনেক বড় শক্তি আছে, যা অতীতে সবসময় কল্যাণকর কিছু বয়ে আনেনি। 

ইউটিউবের অ্যালগরিগম

২০১০ সালে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের ওপর পিএইচডি ডিগ্রিধারী গিউম শালো (Guillaume Chaslot) গুগলে যোগ দেন। তিনি যখন গুগলে যোগ দেন, তখনো জানতেন না তাকে কোন কাজটি করতে হবে। কয়েকদিন পর ইউটিউবের 'রিকমেন্ডেড ভিডিও এঞ্জিন' তৈরি করতে বলা হয় তাকে। 

এই ইঞ্জিনটি মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে দর্শকের পছন্দ-অপছন্দ মূল্যায়ন করতে পারবে এবং একটি ভিডিও দেখা শেষ হলে সেই মূল্যায়ন অনুসারে পরবর্তী ভিডিও দেখার পরামর্শ দেবে। রিকমন্ডেশন এঞ্জিনের উদ্দেশ্য ছিল- ভিডিওর ওয়াচ টাইম বাড়ানো ও দর্শককে যত দীর্ঘ সময় সম্ভব ইউটিউবে আটকে রাখা। 

শালোর মতে, ভিডিওর ভিউর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওয়াচ টাইম। একটি ভিডিও যত বেশি দৈর্ঘ্য পর্যন্ত দেখা হবে, সেটির এনগেইজমেন্ট তত বেশি হবে এবং সেই ভিডিও থেকে আয়ও তত বেশি হবে। শালোর দায়িত্ব ছিল দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সরিয়ে- যারা হাতে ধরে ভিডিও বাছাই করতো, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেজিজেন্স যুক্ত করা। তাকে এমনভাবে প্রোগ্রাম লিখতে হয়েছিল, যাতে সেটি প্রত্যেক দর্শককে আলাদা মূল্যায়ন করতে পারে। এটা ছিল এক অসম্ভব কাজ। এ কাজ তিনি সফল হয়েছিলেন। তবে তার এই কাজ অনেকের ক্ষতিরও কারণ হয়েছে। 

মেরুকরণ ও চরমপন্থা

আপনি যদি প্র্যাংক ভিডিও, কোনো কিছু করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার ভিডিও কিংবা মাতাল লোকদের পুলিশের হাতে আটক হওয়ার ভিডিও দেখতে থাকেন, তাহলে ইউটিউবের অ্যালগরিদম অনুরূপ অসংখ্য ভিডিও আপনার ফিডে দিতেই থাকবে। কিন্তু এ কাজে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স যুক্ত করার পর এটি এখন ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা কখনো কখনো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ইউটিউবের অ্যালগরিদম ভিডিওর দৃষ্টিভঙ্গিকেও আমলে নিচ্ছে এবং সে অনুসারে ভিডিও দেখার পরামর্শ দিচ্ছে। 

যেমন- আপনি যদি প্রতিবাদকারীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে করা একটি প্রতিবাদের ভিডিও দেখেন, তাহলে ইউটিউবের অ্যালগরিদম এই ভিডিরও দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে আরও অনেকগুলো ভিডিও দেখার পরামর্শ দেবে। কিন্তু আপনি যদি একই ঘটনার পুলিশের দৃষ্টিভঙ্গিতে করা ভিডিও দেখেন, তাহলে সেই ভিডিওর উদ্দেশ্য ও অর্থ কিন্তু ভিন্ন হবে। এখন ইউটিউব যেটা করছে, নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির ভিডিওই দেখাচ্ছে, ফলে বড় মেরুকরণ তৈরি হচ্ছে। এরকম একপাক্ষিক ভিডিওর পরামর্শের ফলে অনেকেই চরমপন্থার দিকে ধাবিত হচ্ছেন বলে অনেক অভিযোগ আছে ইউটিউবের বিরুদ্ধে। 

নেতিবাচকতা রুখতে গুগল কী করছে

ইউটিউবের নেতিবাচক প্রভাবগুলো রুখতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে গুগল। সংস্থাটি একটি বিশ্বস্ত 'ফ্ল্যাগার প্রোগ্রাম' চালু করেছে যার মাধ্যমে বাছাইকৃত দর্শকরা কোনো ভিডিওর বিষয়বস্তু অনপুযুক্ত মনে করলে সে সম্পর্কে গুগলকে সতর্ক করতে পারে। আবার কোনো ভিডিওর বিষয়বস্তু যদি ধর্মীয় বা শেষ্ঠত্ববাদীদের অনুভূতিতে আঘাত হানার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে ভিডিও শুরুতেই সে সম্পর্কে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়। 

এটা যদিও একটি কঠিন যুদ্ধ। প্রযুক্তিগত দিক থেকে বললে- একটি ভিডিও কোনো সন্ত্রসী তৈরি করেছে, নাকি কোনো ভালো গণমাধ্যম সেই সন্ত্রাসীর ওপর ভিডিওটি তৈরি করেছে, কোনো মেশিনের পক্ষে এটা বোঝা সত্যিই মুশকিল। বিভিন্ন পক্ষ ইউটিউবকে নিজেদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যবহার করছে। কেউ হয়তো নতুন আইফোনের রিভিউ দেখছে কিংবা গণিত শেখার ভিডিও দেখছে, কিন্তু অন্যরা আরও বিতর্কিত ও ক্ষতিকর ভিডিও দেখছে। 

ইউটিউবে বিভিন্ন সময় নানা রকম চ্যালেঞ্জ জনপ্রিয়তা পায়। মানুষ সেখান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেসব চ্যালেঞ্জে অংশ নেয়। যেমন- এএলএস রোগ বিষয়ে সচেতনা তৈরির উদ্দেশ্যে আইস বাকেট চ্যালেঞ্জ শুরু হয়েছিল ইউটিউবে। কিন্তু টাইড পড চ্যালেঞ্জের মতো অনেক ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জেরও জন্ম এই প্ল্যাটফর্মে। ইউটিউব অবশ্য পরে টাইড পড চ্যালেঞ্জ নিষিদ্ধ করেছে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখার বয়সসীমা বেঁধে দিয়েছে। 

আয়ের নতুন উৎস

ইউটিউব সবার জন্য বাড়তি আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছে। এটি এই প্ল্যাটফর্মের অন্যতম বড় ইতিবাচক ব্যাপার। মিউজিশিয়ান, রিভিউয়ার, কমেডিয়ান, প্র্যাংস্টার, অটো মেকানিকস- সবাই ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে বাড়তি অর্থ আয় করছে। 

রাজনীতিতে প্রভাব

রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীনদের হাতে ক্ষমতা দিয়েছে ইউটিউব। সরকারের কোনো দুর্নীতি ও দায়িত্ব পালনে অবহেলার ঘটনা সাধারণ মানুষ এখন ইউটিউবের মাধ্যমে প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে। যেসব দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত, সেসব দেশে সরকারবিরোধীদের মতামত প্রচারে ইউটিউব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সিরিয়ার বিদ্রোহীরা প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে ইউটিউবকে ব্যবহার করেছে। ২০১২ সালে রাশিয়ার নারীবাদী আন্দোলন প্ল্যাটফর্ম পুসি রায়টের কর্মীরা প্রেসিডেন্ট পুতিনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিলেন। এই ভিডিও ইউটিউবের মাধ্যমে সবাই দেখেছে। রাশিয়ার বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি পুতিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির তথ্য প্রমাণও ইউটিউবেই প্রকাশ করছিলেন। ২০১৩ সালে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ পশ্চিমাদের উদ্দেশ্যে তার দেশকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেওয়ার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেটিও ইউটিউবের মাধ্যমে বিশ্ববাসী দেখেছে। আবার চরমপন্থী মতাদর্শের প্রচারও হচ্ছে এই মাধ্যম ব্যবহার করে। 

একনায়কদেরকে কিছুটা হলেও জবাবদিহির আওতায় আনতে পারছে ইউটিউব। ট্রেনে মাতাল নারীর হাতে কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রীর হয়রানি থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মিট রমনির 'অর্ধেক মার্কিন নাগরিক নিজেদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল নয়' মন্তব্য- সবই মোবাইলে ধারণ করে পরে ইউটিউবে আপলোড করার ফলে সবাই দেখতে পেরেছে। রাজনীতিবিদদের এমন মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথা ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ার পর তাদের ক্যারিয়ারের ক্ষতি হয়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রজিলের জাইর বলসোনারোর মতো অতি ডানপন্থী নেতাদের অবির্ভাবেও ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো ভূমিকা রেখেছে। 

ক্ষতির চেয়ে ইউটিউবে লাভই বেশি। বিভিন্ন চ্যারিটি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ইউটিউবের মাধ্যমে এবং এখান থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নানা ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়, যা বিশ্বের সার্বিক মঙ্গলে কাজে আসে।  

শিক্ষাখাতে ইউটিউব

খান একাডেমির নাম আমরা অনেকেই জানি। অর্থনীতি, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো সহজে বোঝানো হয় খান একাডেমির ভিডিওতে। ভিডিওগুলো মূলত ইউটিউবেই আপলোড করা হয়। বিশ্বের যেকোনো একাডেমিক বিষয়ের ওপর সহজবোধ্য ভাষায় বিশেষজ্ঞদের লেকচার পাওয়া যায় ইউটিউবে। ফলে কোনো কিছু শেখা এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। ইউটিউবে নানা বিষয়ের ওপর লাখ লাখ টিউটোরিয়াল আছে, যেগুলো দেখে মানুষ সহজেই সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। 

বাংলাদেশে টেন মিনিটস স্কুল এবং শিখোর মতো এডটেক প্রতিষ্ঠানের উত্থানেও ইউটিউবের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। 

সংবাদের উৎস

ইউটিউব এখন সংবাদের বড় উৎস হয়ে উঠেছে। অনেক সাংবাদিক গতানুগতিক সংবাদপ্রতিষ্ঠানের চকরি ছেড়ে ইউটিউবের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্স জার্নালিজম করছেন। ২০১২ সালে মার্কিন থিংক ট্যাংক পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইউটিউবে যত কিছু সার্চ করা হয়, তার মধ্যে সংবাদ অন্যতম। সিটিজেন জার্নালিজম জনপ্রিয়তা পেয়েছে ইউটিউবের সৌজন্যে। 

কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা সেই ঘটনার ভিডিও সবার আগে ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে আপলোড করছেন। জাপানের সুনামি, সাদ্দামের হোসেনের ফাঁসি, যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি রাজ্যের ফার্গুসনে অ্যান্টি-পুলিশ রায়টের ভিডিও সর্বপ্রথম ইউটিউবেই আপলোড করা হয়েছিল। টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা পৌঁছানোর আগেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ভিডিও মানুষ দেখেছে ইউটিউবের সৌজন্যেই। 

এর বাইরেও ব্যবসা, বিজ্ঞাপন, প্রযুক্তি শিল্পের বিকাশ, অর্থনতি, কমিউনিটি তৈরি, সমাজ সংস্কার ইত্যাদি নানা খাতকে চিরতরে বদলে দিয়েছে ইউটিউব। 

সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট, আল জাজিরা, আইবিসি, ডিজিটাল ট্রেন্ডস

 

Comments