স্যামসাং-গুগলের অম্ল মধুর সম্পর্ক

ফোনের বাজারে স্যামসাং এবং গুগল, উভয়ের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য অ্যাপলকে হটানো। কিন্তু এই দুটি প্রতিষ্ঠানর নিজেদের মধ্যেও তীব্র প্রতিযোগিতা রয়েছে।
স্যামসাং-গুগলের অম্ল মধুর সম্পর্ক। ছবি: সংগৃহীত
স্যামসাং-গুগলের অম্ল মধুর সম্পর্ক। ছবি: সংগৃহীত

প্রযুক্তি খাতের বড় ২ প্রতিষ্ঠান স্যামসাং ও গুগল। তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। আবার অংশীদারও। গুগলকে ছাড়া যেমন স্যামসাংয়ের চলে না, তেমনি গুগলও তার ব্যবসার জন্য স্যামসাংয়ের ওপর নির্ভরশীল। এ এক অম্ল মধুর সম্পর্ক।

ফোনের বাজারে স্যামসাং এবং গুগল, উভয়ের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য অ্যাপলকে হটানো। কিন্তু এই দুটি প্রতিষ্ঠানর নিজেদের মধ্যেও তীব্র প্রতিযোগিতা রয়েছে।

কেন স্যামসাং ও গুগলের একে অন্যকে প্রয়োজন

স্যামসাং গ্যালাক্সি ২৩ ও গুগলের পিক্সেল ৭। ছবি: সংগৃহীত
স্যামসাং গ্যালাক্সি ২৩ ও গুগলের পিক্সেল ৭। ছবি: সংগৃহীত

এই দুটি প্রতিষ্ঠান একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। স্যামসাং বিশ্বের সবচেয়ে বড় অ্যান্ড্রয়েড ফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ, গুগলের সেবাগুলো গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে স্যামসাং। স্যামসাং যদি না থাকতো, তাহলে ভালো বিকল্পের অভাবে প্রচুর গ্রাহক আইফোনের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হতো, যার বিশাল নেতিবাচক প্রভাব পড়তো গুগলের আয়ে।

অন্যদিকে, স্যামসাংয়েরও গুগলকে প্রয়োজন, কারণ তারা অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের সত্ত্বাধিকারী। স্যামসাং এক সময় নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করলেও দীর্ঘদিন আগেই সেখান থেকে সরে অ্যান্ড্রয়েডের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

স্যামসাং যেভাবে গুগলকে হঠাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিল

ফোন ও অন্যান্য ডিভাইসের বাজারে স্যামসাং নিজেদের অনন্য অবস্থান তৈরি করতে চেয়েছিল। গুগলের সেবা তারা শুরুতে ব্যবহার করতে চায়নি। ২০১০ সালে স্যামসাং তাদের অপারেটিং সিস্টেম 'বাডা' চালু করে, কিন্তু ইউজার ইন্টারফেসের জটিলতা ও কারিগরি সমস্যার কারণে ফোন ব্যবহারকারীদের কাছে এটি জনপ্রিয়তা পায়নি। 

এটি ব্যর্থ হওয়ার পর ২০১২ সালে টাইজেন নামে আরেকটি অপারেটিং সিস্টেম চালু করে প্রতিষ্ঠানটি। মোটামুটি একই কারণে এটাও ব্যর্থ হয়।

পুরোপুরি সফল না হলেও স্যামসাং গুগলের অপারেটিং সিস্টেমকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল। যদি নিজেদের অপারেটিং সিস্টেমে স্যামসাং সফল হতো, তাহলে তাদের সব গ্রাহককেই নিজেদের অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারে বাধ্য করতো তারা।

স্যামসাংকে রুখতে ২০১২ সালে ১২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে মোটোরোলা কিনে নেয় গুগল। তখন এক ব্লগপোস্টে গুগল জানায়, অ্যান্ড্রয়েড ইকোসিস্টেম অক্ষুণ্ণ রাখতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি মোবাইল কম্পিউটিংয়ে বিভিন্ন উদ্ভাবনেও গতি আনতে সহায়তা করবে মোটোরোলা।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্যামসাং অবশেষে তাদের ফ্ল্যাগশিপ গ্যালাক্সি ফোনগুলোতে অ্যান্ড্রয়েড ওএস ও প্রি-ইনস্টলড অ্যাপ হিসেবে গুগলের কিছু অ্যাপ রাখতে শুরু করে।

তবে গুগল ও স্যামসাংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ২০১৭ সালে স্যামসাং নিজেদের ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট সেবা 'বিক্সবি' চালু করে। এটি গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে স্যামসাং এবারও সফলতা পায়নি। অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীরা বিক্সবির চেয়ে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্যবহারেই বেশি স্বচ্ছন্দ।

গুগল ও স্যামসাংয়ের অংশীদারিত্ব যেভাবে সময়ের সঙ্গে দৃঢ় হয়েছে

স্যামসাং গ্যালাক্সি ২২ ও গুগলের পিক্সেল ৬। ছবি: সংগৃহীত
স্যামসাং গ্যালাক্সি ২২ ও গুগলের পিক্সেল ৬। ছবি: সংগৃহীত

অতীতে তীব্র প্রতিযোগীতাপূর্ণ মনোভাব থাকলেও বর্তমানে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক বেশ উষ্ণ। গুগল এখন তাদের পিক্সেল ফোনের বিক্রি বাড়াতে চাইছে। এ কাজে স্যামসাংয়ের বিশাল উৎপাদন সুবিধা ও হার্ডওয়্যার দক্ষতা প্রয়োজন গুগলেরও।

যদি ২ প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে স্যামসাং যেমন তাদের উৎপাদন ব্যবসার জন্য বড় ১টি গ্রাহক পাবে, তেমনি গুগলও অ্যান্ড্রয়েডের টিকে থাকা নিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারবে।

ইতোমধ্যে গ্যালাক্সি ওয়াচের অপারেটিং সিস্টেম তৈরিতেও গুগলের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে স্যামসাং।

গুগলের পিক্সেল ফোনে যে টেন্সর চিপ ব্যবহৃত হয়, সেটি তৈরি করে স্যামসাংয়ের সেমিকন্ডাক্টর উৎপানকারী প্রতিষ্ঠান 'স্যামসাং ফাউন্ড্রি'। ২০২২ সালের অক্টোবরে গুগলের স্মার্ট হোম ইকোস্টিস্টেম 'স্মার্ট থিংস' ও 'গুগল হোম' নিয়ে কাজ করার জন্য গুগলের সঙ্গে অংশীদারিত্ব বাড়ানোর ঘোষণা দেয় স্যামসাং। কিছু কিছু প্রতিবেদনের দাবি অনুযায়ী সম্প্রতি উন্মোচিত গুগলের পিক্সেল ফোল্ড ফোনের ডিসপ্লে তৈরি করেছে স্যামসাং।

তবে গুগলের সঙ্গে এসব চুক্তির মানে এই নয় যে স্যামসাং তাদের নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম ও অ্যাপ নিয়ে কাজ করতে পারবে না। বরং চুক্তিগুলোর অর্থ হচ্ছে স্যামসাংকে গুগল প্লে, সার্চ, অ্যাসিস্ট্যান্টের মতো গুগলের সেবাগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

সফটওয়্যারে দিন দিন উন্নতি করছে স্যামসাং

স্যামসাং যদিও হার্ডওয়্যার খাতের রাজা, তবে তারাও জানে সফটওয়্যারই হচ্ছে ভবিষ্যৎ। কেন? কারণ, যখন একটি পণ্য বিক্রি হয়ে যায়, তখন এর হার্ডওয়্যারের উপর প্রতিষ্ঠানের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু সফটওয়্যারের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ডিভাইসের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যায় এবং এটি বেশি লাভজনক।

একসময় মানুষ ফোনে নির্দিষ্ট কিছু অ্যাপ ব্যবহার করতো। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। স্মার্টফোন এখন একটি ব্যক্তিগত কম্পিউটিং ডিভাইসে পরিণত হয়েছে। মানুষ এখন আর নির্দিষ্ট কিছু অ্যাপেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখছে না। এজন্যই সফটওয়্যারের দিকে স্যামসাং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এত মনোযোগ দিচ্ছে।

২০১০ সালে স্যামসাং 'টাচউইজ' চালু করলেও নিখুঁতভাবে কাজ না করার জন্য এটি গ্রাহকদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে কিন্তু ২০১৮ সালে চালু হওয়া ইউজার ইন্টারফেস সফটওয়্যার 'ওয়ান ইউআই' অনেককেই মুগ্ধ করে। 

স্যামসাংয়ের ফোনগুলো এখন ৪ বছর পর্যন্ত ওএস আপডেট পায়, যা গুগলের পিক্সেল ফোনের চেয়ে বেশি।

এছাড়াও, মাইক্রোসফটের সঙ্গে অংশীদারিত্ব চুক্তির মাধ্যমেও নিজেদের ইকোসিস্টেম আরও উন্নত করার চেষ্টা করছে স্যামসাং। গ্যালাক্সি ফোনের ব্যাকআপও তাই গুগল ড্রাইভের পরিবর্তে ওয়ান ড্রাইভে সংরক্ষিত থাকে। একই কারণে গ্যালাক্সি ফোনে 'লিংক টু উইন্ডোজ অ্যাপ' প্রি ইনস্টলড থাকে, যাতে আপনি চাইলেই ফোনটিকে উইন্ডোজ কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন।

এসব কিছুর উদ্দেশ্যই হচ্ছে ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমানো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আধুনিক অনেক অ্যাপ ও সেবাই গুগল মোবাইল সার্ভিসেস (জিএমএস) এর উপর নির্ভরশীল। যেমন- হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথনের ব্যাকআপ রাখে গুগল ড্রাইভে, উবারের ন্যাভিগেশনের জন্য গুগল ম্যাপস ব্যবহৃত হয় এবং গেম ডেভেলপাররা অ্যাপের মাধ্যমে গেম বিক্রির জন্য গুগলের প্লে স্টোর ব্যবহার করে।

আপাতত অ্যাপল ছাড়া আর তেমন কোনো মোবাইল ডিভাইস নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের হাতে গুগলের সেবা ব্যবহার না করার বিকল্প নেই। তাই স্যামসাংকেও আপাতত এ পথেই হাঁটতে হচ্ছে। তবে মাইক্রোসফট ও অন্যান্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার্যকর অংশীদারিত্বে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে।

সূত্র: মেকইউজঅব

গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

Comments

The Daily Star  | English

Heat takes a toll on expecting mothers

Pregnant women are more prone to heat-related illnesses like exhaustion and heatstroke

14h ago