বিজয়ের রাজত্বে অভ্রর বিপ্লবী উত্থান

একটা সময় পর্যন্ত কিবোর্ডে বাংলা টাইপ করা বেশ চ্যলেঞ্জিং ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। বাংলা টাইপিংকে সহজলভ্য এবং সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে অভ্র কিবোর্ড।

২০০৩ সালের ২৬ মার্চ মেহদী হাসান খানের হাত ধরে জন্ম নেওয়া এই সফটওয়্যারটি শুধু একটি টাইপিং টুল নয়, এটি বাংলা ভাষার ডিজিটাল প্রসারে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

২২ বছর পরে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা পেলো অভ্র। আজ বৃহস্পতিবার অভ্রর স্রষ্টা মেহদী ও তার দলের হাতে একুশে পদক তুলে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

তবে যতটা সহজ ভাবছেন, এই কিবোর্ডের পথচলা কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না।

অভ্র কিবোর্ড যেভাবে কাজ করে

অভ্র কিবোর্ড একটি ইউনিকোডভিত্তিক বাংলা টাইপিং সফটওয়্যার। এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো ফোনেটিক টাইপিং পদ্ধতি। ব্যবহারকারী ইংরেজি অক্ষরে বাংলা শব্দের উচ্চারণ লিখলে, সফটওয়্যারটি তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলা বর্ণে রূপান্তর করে।

উদাহরণস্বরূপ, ইংরেজিতে 'ami' লিখলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে 'আমি' হয়ে যায়। এ ছাড়া, অভ্রতে বিভিন্ন কিবোর্ড লেআউট (যেমন: প্রভাত, মুনীর অপটিমা, অভ্র ইজি) রয়েছে, যা পছন্দ অনুযায়ী বেছে নিতে পারেন ব্যবহারকারীরা। উইন্ডোজ, লিনাক্স, ম্যাক, অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস—সব অপারেটিং সিস্টেমে সমানভাবে কাজ করে অভ্র।

বাংলা ভাষাকে সহজতর করতে অভ্র যেভাবে কাজ করেছে

অভ্র কিবোর্ডের আগে বাংলা টাইপিং ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। ২০০৩ সালের আগে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে বাংলা টাইপিংয়ের প্রধান মাধ্যম ছিল বিজয় কিবোর্ড, যেটি ইউনিকোড সমর্থন করত না। ফলে ইন্টারনেটে বাংলা লেখা প্রায় অসম্ভব ছিল। এ সংকট থেকেই জন্ম নেয় অভ্র।

মেহদী হাসান খান নিজের উদ্যোগে ভিজ্যুয়াল বেসিক ডটনেট ব্যবহার করে ইউনিকোডভিত্তিক বাংলা টাইপিং সফটওয়্যার তৈরি করেন। এর ফোনেটিক পদ্ধতি নতুন ব্যবহারকারীদের জন্য বাংলা টাইপিংকে সহজলভ্য করে তোলে। ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে অভ্রর প্রথম সংস্করণ মুক্তি পায়। অভ্র ওপেন সোর্স এবং বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য হওয়ায় এটি দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়।

অন্যদিকে বিজয় একটি বাণিজ্যিক সফটওয়ার। টাকা খরচ না করে আপনি বৈধভাবে এই এই সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারেন না।

বিজয়ের আগ্রাসন

'বিজয়' সফটওয়্যারের সত্ত্বাধিকারী আনন্দ কম্পিউটার্সের প্রধান নির্বাহী আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। ২০১০ সালে প্রথম প্রকাশ্যে অভ্রকে ব্যবসায়িক হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করেন তিনি। বাধা দিতে শুরু করেন এর প্রসারে।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সে বছর এপ্রিলে একটি সংবাদপত্রের নিবন্ধে অভ্রকে ইঙ্গিত করে জব্বার অভিযোগ করেন, হ্যাকাররা তার 'বিজয়' সফটওয়্যারটি চুরি করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অভ্র কিবোর্ডকে পাইরেটেড সফটওয়্যার হিসেবে অভিহিত করেন তিনি।

অভ্র কিবোর্ডের বিরুদ্ধে একাধিকবার আইনি ব্যবস্থা নিয়েছেন মোস্তাফা জব্বার। অভ্রকে 'পাইরেটেড সফটওয়্যার' দাবি করার পাশাপাশি এর ইউনিবিজয় লে-আউটকে তার প্যাটেন্টকৃত বিজয় কিবোর্ডের নকল বলে অভিযোগ করেন।

এ নিয়ে ২০১০ সালে তিনি কপিরাইট অফিসে অভিযোগ করেন। যার ফলে মেহদী হাসান খানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। পরে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয় এবং অভ্র থেকে ইউনিবিজয় লে-আউট সরিয়ে নেওয়া হয়। জব্বারের কপিরাইট ভঙ্গের অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৫ সালে গুগল প্লে স্টোর থেকে অভ্রভিত্তিক অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ রিদমিক কিবোর্ড সরিয়ে দেওয়া হয়। যদিও পরে নতুন লেআউট নিয়ে এটি আবার প্লে স্টোরে ফিরে আসে।

ক্ষমতাচ্যুত ও পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১৮ সালের মন্ত্রীসভায় টেকনোক্রেট মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন মোস্তাফা জব্বার। তথ্য ও প্রযুক্তি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। অভ্রর জনপ্রিয়তাকে বাধাগ্রস্ত করতে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সব অ্যান্ড্রয়েড ফোনে বিজয় কিবোর্ড বাধ্যতামূলক করে।

তবে এর কারণ হিসেবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ জানায়, বিজয় কি-বোর্ড 'বাংলা লেখার জাতীয় মান' হয়ে যাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগ সব ধরনের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে বিজয় অ্যান্ড্রয়েড প্যাকেজ কিট বা এপিকে ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করে—অর্থাৎ নতুন ফোন ব্যবহারকারীর হাতে যাওয়ার আগেই সেখানে থাকতে হবে বিজয় কিবোর্ড।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

অভ্রকে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম, মাইক্রোসফট এবং সফটপিডিয়া স্বীকৃতি দিয়েছে।

অভ্রর বৈশিষ্ট্য ও জনপ্রিয়তা

অভ্র মূলত ওপেন সোর্স এবং বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য একটি সফটওয়্যার। এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো-

১. ফোনেটিক টাইপিং: ইংরেজি অক্ষর দিয়ে বাংলা উচ্চারণ লিখলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলায় পরিবর্তিত হয়।

২. বিভিন্ন লেআউট: অভ্রতে প্রভাত, মুনীর অপটিমা, অভ্র ইজি, জাতীয়সহ বিভিন্ন বাংলা কী-বোর্ড লেআউট রয়েছে।

৩. প্ল্যাটফর্ম স্বাধীনতা: এটি উইন্ডোজ, লিনাক্স, ম্যাক, অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস প্ল্যাটফর্মে কাজ করে।

৪. ফ্রি ও ওপেন সোর্স: অভ্রর সোর্স কোড উন্মুক্ত, তাই এটি সহজেই উন্নয়ন করা সম্ভব।

এ সফটওয়্যার দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশেষ করে ফেসবুক, ব্লগ এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বাংলা লেখার সুবিধা থাকায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এটি ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, অভ্র শুধু একটি সফটওয়্যার নয়, এটি একটি আন্দোলন—বাংলা ভাষাকে মুক্ত করার আন্দোলন। এটি প্রমাণ করেছে, প্রযুক্তি শুধু ব্যবসার জন্য নয়, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসারের জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে।

মেহদী হাসান খান ও তার দলের প্রচেষ্টা বাংলা ভাষার ডিজিটাল রূপান্তরে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। 'ভাষা হোক উন্মুক্ত'—এ দর্শন নিয়েই অভ্র এগিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের পথে।

Comments

The Daily Star  | English

US bomber jets leave UK base; Iran launches 'Fattah-1 missiles' towards Israel

Israel and Iran attacked each other for a sixth straight day on Wednesday, and Israeli air power reigns over Iran, but needs US for deeper impact

10h ago