ভরা মৌসুমেও কেন বাড়ছে দেশি পেঁয়াজের দাম

পাবনায় কৃষকদের কাছ থেকে পেঁয়াজ কিনে ব্যবসায়ীরা অন্যান্য জেলায় পাঠাচ্ছেন। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

সপ্তাহান্তে আবারও বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। ভালো মুনাফার আশায় অনেক কৃষক ও ব্যবসায়ীরা মজুদ পেঁয়াজ বাজারে ছাড়তে তেমন আগ্রহী নন। কেননা, বর্তমানে দেশে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ আছে।

ঢাকার কাঁচাবাজারগুলোয় বর্তমানে দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও তা ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যে দেখা গেছে—রাজধানীতে পেঁয়াজের খুচরা দাম ৪০ থেকে ৬৫ টাকা। আগের মাসের তুলনায় দাম সাড়ে ২৩ শতাংশ বেশি।

এক সপ্তাহ আগেও প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।

ঢাকার খুচরা বিক্রেতা ও পাইকাররা এবং পাবনা ও ফরিদপুরের মতো প্রধান পেঁয়াজ উৎপাদনকারী জেলার কৃষকরা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, প্রায় তিন সপ্তাহ আগেও খেত থেকে সরাসরি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন আর খেতে কোনো পেঁয়াজ নেই। কৃষকরা পেঁয়াজ তুলে মজুত করে রেখেছেন।

মৌসুমের শুরুতে উৎপাদন খরচ তুলতে অনেক কৃষক পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন। তাই হঠাৎ সরবরাহ বেড়ে গিয়ে দাম কমেছিল।

এখন তারা ভালোমানের পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছেন। বাড়তি দামের আশায় বাকি পেঁয়াজ বিক্রির ক্ষেত্রেও তারা সময় নিচ্ছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইংয়ের পরিচালক মো. আব্দুর রহিম ডেইলি স্টারকে বলেন, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকার গত মার্চ মাস থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রেখেছে।

দেশে পেঁয়াজের চারা সাধারণত ডিসেম্বরে রোপণ করা হয়। মার্চ-এপ্রিলের দিকে নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করে।

চলতি বছরের শুরুতেই উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি হওয়ায় কৃষকরা আক্ষেপ করেছিলেন।

কৃষি সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া ডেইলি স্টারকে জানান, চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে কৃষকদের খরচ হয়েছে ৩৫ থেকে ৪৮ টাকা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুসারে—চলতি মৌসুমে মোট উৎপাদন হবে ৩৯ লাখ টনের বেশি। দেশের চাহিদা মেটাতে তা যথেষ্ট হলেও পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আরও ছয় থেকে সাত লাখ টন আমদানির প্রয়োজন।

খেত থেকে খুচরা বিক্রি, দাম বাড়ছে প্রতি ধাপে

ঢাকার ফার্মগেট এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে।'

ঢাকার মিরপুরের পল্লবী এলাকার খুচরা বিক্রেতা নুরুল আলম শিকদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত সপ্তাহের তুলনায় প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়ে ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে।'

কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মো. কালাম শেখ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাকে কৃষক বা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি দামে পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে। এ কারণে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।'

ঢাকার প্রধান পাইকারিকেন্দ্র শ্যামবাজারের পেঁয়াজ পাইকারি বিক্রেতা সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল মাজেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পেঁয়াজ তোলার মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই।'

'গতকাল পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪৭ থেকে ৫০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে ছিল ৩০ থেকে ৩২ টাকা।'

আমদানি স্থগিতের কারণে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

পেঁয়াজের জেলায় বাজার পরিস্থিতি

দেশের অন্যতম প্রধান পেঁয়াজ উৎপাদনকারী জেলা পাবনায় সম্প্রতি প্রতি মন (৩৭ দশমিক ৬৫ কেজি) পেঁয়াজের পাইকারি দাম দুই হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। এক মাস আগে তা ছিল ৮০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা।

'দুই সপ্তাহ আগেও অনেক কৃষক খেত থেকেই পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন' জানিয়ে পাবনার পাইকারি বিক্রেতা রবিউল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন কৃষকরা ভালোমানের পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছেন। এসব পেঁয়াজ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যেতে পারে। তাই বাজার পরিস্থিতি দেখে কৃষকরা পেঁয়াজ বিক্রির সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।'

পাবনার সুজানগর উপজেলার কৃষক মন্টু খান পাঁচ শতাধিক মন পেঁয়াজ ঘরে তুললেও দাম কমে যাওয়ায় সেগুলো বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত মাসে প্রতি মন পেঁয়াজের দাম ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। এতে উৎপাদন খরচ উঠছে না। আমি সারাবছর ধীরে ধীরে বিক্রির জন্য বাড়িতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছি।'

ফরিদপুরের সালথা উপজেলায়ও পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। প্রতি মনের দাম এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা।

ফরিদপুর সদরের পাইকারি ব্যবসায়ী কামাল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেক কৃষক বাজারচাহিদা অনুযায়ী বিক্রির পরিবর্তে পেঁয়াজ মজুদ করছেন। ফলে ভরা মৌসুমেও পেঁয়াজের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।'

তার মতে, 'দাম আরও বাড়বে এমন আশায় ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ পেঁয়াজ মজুদ করছেন।'

ফরিদপুরের জ্যেষ্ঠ কৃষি বিপণন কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেক কৃষক পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছেন। তাই বাজারের সরবরাহ কমেছে। এ ছাড়াও, ভবিষ্যতে বেশি দামের আশায় ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ পেঁয়াজ কিনে মজুদ করছেন। এসব কারণে সম্প্রতি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।'

কৃষিসচিব এমদাদ উল্লাহ মিয়া মনে করেন, 'কৃষকের ন্যায্য মুনাফা নিশ্চিত করতে পেঁয়াজের খুচরা দাম কেজিপ্রতি ৬০ টাকা হওয়া দরকার। উৎপাদন খরচ থেকে খুচরা বিক্রির দামের ফারাক ১৫ থেকে ২০ টাকা হওয়া উচিত।'

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খুচরা বাজারে যখন পেঁয়াজের দাম ৬০ টাকার কম ছিল, তখনো কৃষকদের লোকসান হচ্ছিল।'

Comments