চাকরির সাক্ষাৎকারে ‘নিজের সম্পর্কে’ যেভাবে বলবেন
চাকরির সাক্ষাৎকারে যেকোনো প্রার্থীকেই একটি সাধারণ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। প্রার্থীকে নিজের সম্পর্কে বলতে বলা হয়। আপাতদৃষ্টিতে এটাকে খুব সহজই মনে হয়, কারণ আপনার সম্পর্কে তো আপনিই সবচেয়ে ভালো জানবেন ও বলতে পারবেন। কিন্তু এটাই আবার অনেক সময় খুবই কঠিন।
কারণ হয়ত দীর্ঘ বাছাই প্রক্রিয়া শেষে আপনি শেষ রাউন্ডে উপনীত হলেন এবং প্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ আরও সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সাক্ষাৎকার বোর্ডে থাকতে পারেন। এখানে আপনার প্রতিটি কথা ও অঙ্গভঙ্গির গুরুত্ব আছে, আপনি কতটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলছেন, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা কেন এটি জিজ্ঞেস করেন
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা প্রার্থীর কাছে এটিই সবার আগে জানতে চান। লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট প্রশিক্ষক আলিনা ক্যাম্পস বলেন, 'মূল সাক্ষাৎকার শুরুর আগে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের জন্য এটা কিছুটা হালকা হয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া। বেশিরভাগ সময়ই সাক্ষাৎকারের শুরুর দিকে টুকটাক অন্য কথাবার্তা হয়। তাই এই প্রশ্নটি হচ্ছে মূল সাক্ষাৎকারে ঢোকার একটি প্রক্রিয়া। প্রার্থী মানসিকভাবে দুর্বল থাকেন, আবার সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরাও নিজেদের প্রস্তুত করে নেন।'
ক্যারিয়ার বিষয়ক প্রশিক্ষক আল দেয়ার ভাষ্য অনুসারে, এই প্রশ্নটির মাধ্যমেই সাক্ষাৎকারটি কোন দিকে যাবে, তা অনেকটা নির্ধারিত হয়। তিনি বলেন, আপনি কী বলছেন, তার ওপর ভিত্তি করে তারা পরবর্তী প্রশ্নটি করবে এবং ধারাবাহিকভাবে ও প্রসঙ্গক্রমে আরও প্রশ্ন করতে থাকবে, যা নিয়োগদাতাদের আপনার সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা তৈরি করতে সহায়তা করবে এবং তারা যেরকম প্রার্থী খুঁজছেন, আপনার মধ্যে তেমন সম্ভাবনা আছে কি না, সে বিষয়েও তারা নিশ্চিত হতে পারবে।
অধিকাংশ সময়ই 'আপনার সম্পর্কে বলুন' এই কথাটিই বলা হবে। তবে মাঝে মাঝে নিয়োগদাতারা নিজেদের মতো করেও প্রশ্নটি করতে পারেন। যেমন-
আমার কাছে আপনার সিভি আছে, কিন্তু আপনি নিজের সম্পর্কে আরও কিছু বলতে পারেন।
আপনার সিভি সম্পর্কে বলুন।
আপনার যাত্রা সম্পর্কে শুনতে আগ্রহী।
আপনার অতীত কাজ সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত বলুন।
'নিজের সম্পর্কে বলুন' এর জবাব কীভাবে দিতে হবে
এর জবাব প্রেক্ষাপট অনুসারে ভিন্ন হবে। তবে মোটাদাগে আপনার বক্তব্যে যেসব বিষয় যুক্ত করতে পারেন-
সংশ্লিষ্ট পদে কাজ করার জন্য আপনি যে যথেষ্ট অভিজ্ঞ, দক্ষ এবং সেরা প্রার্থী, নিয়োগদাতাকে সেটি উপলব্ধি করান।
আপনার চাকরি জীবনের বিভিন্ন দিক, বর্তমান চাকরি ও ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান, সে সম্পর্কে তাদেরকে ধারণা দিন।
প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট পদ সম্পর্কে আপনার যে খুব ভালো জানাশোনা আছে এবং এই পদটি কীভাবে আপনার ক্যারিয়ারের উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে, তা প্রমাণ করুন।
আপনার যোগাযোগ দক্ষতা উপস্থাপন করুন। নিজেকে পেশাদারভাবে উপস্থাপন করুন।
আপনাকে যখন নিজের সম্পর্কে বলতে বলা হবে, তখন আসলে কী কী বললে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বাদ যাবে না, ক্যারিয়ার বিষয়ক প্রশিক্ষক লিলি ঝ্যাং এ ক্ষেত্রে তিনটি সূত্র মেনে চলার পরামর্শ দেন।
বর্তমান: আপনি এখন যে কাজটি করছেন, সে সম্পর্কে বলুন। সাম্প্রতিক কোনো বড় অর্জন থাকলেও সেটি উল্লেখ করতে ভুলবেন না।
অতীত: নিয়োগদাতাদের বলুন আপনি কেন নতুন চাকরিটি করতে চান। এই চাকরি সম্পর্কিত কোনো অতীত অভিজ্ঞতা থাকলে সেটি উল্লেখ করুন।
ভবিষ্যৎ: আপনি ভবিষ্যতে কী করতে চান এবং আপনি কেন চাকরিটি সম্পর্কে আগ্রহী এবং কেন নিজেকে যোগ্য মনে করছেন, সেটি বলুন।
ঠিক এই পদ্ধতিতেই আপনাকে উত্তর দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সাক্ষাৎকারের মাঝখানে যদি কোনো কথা বলার জন্য উপযুক্ত মনে হয়, তাহলে সেটি বলতে পারেন।
কিছু পরামর্শ
চাকরির সাক্ষাৎকারে নিজের সম্পর্কে বলার অংশটি কেবলই প্রথম পর্ব। এরপর সাক্ষাৎকার অনেকদিকেই গড়াতে পারে। নিজেকে যোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে যেসব বিষয় মথায় রাখা দরকার-
ফার্স্ট ইমপ্রেশন গুরুত্বপূর্ণ
ক্যারিয়ার কোচ স্টিভ ডেভিস বলেন, ফার্স্ট ইমপ্রেশন তৈরির জন্য আমরা আসলে একটি সুযোগই পাই। আমার মতে বেশিরভাগ নিয়োগের সিদ্ধান্তই হয় এই ফার্স্ট ইমপ্রেশনের ওপর ভিত্তি করে। তাই আপনি কীভাবে সম্ভাষণ জানাচ্ছেন, কীভাবে হাত মেলাচ্ছেন, দৃষ্টি বিনিময় কীভাবে করছেন, প্রথম কোন কথাটি বলছেন- এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যেহেতু নিজের সম্পর্কে কিছু বলেই সাক্ষাৎকারটি শুরু করতে হয়, তাই এই বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে যান এবং নিয়োগদাতাদের দেখান যে, আপনি যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন।
উত্তর যাতে প্রাসঙ্গিক থাকে
নিয়োগদাতারা যখন আপনার সম্পর্কে জানতে চায়, তার মানে তারা সংশ্লিষ্ট কাজে আপনার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা সম্পর্কেই চানতে চায়। তাই নিজের সারা জীবনের গল্প বলা দরকার নেই। সংশ্লিষ্ট পদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এমন কাজ বা অভিজ্ঞতার কথাও বলার দরকার নেই। যে পদের জন্য সাক্ষাৎকার দিতে এসেছেন, আপনার সব কথা যাতে সেটিকে ঘিরেই থাকে, এটা মাথায় রাখতে হবে।
সাক্ষাৎকার দিতে আসার আগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি ভালোভাবে পড়ুন। এই পদের দায়িত্ব কী হবে এবং প্রতিষ্ঠানটি কেমন, সে সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা নিন। আপনি কেন পদটির জন্য উপযুক্ত, এটা ব্যাখ্যা করার সময় এসব তথ্য কাজে দেবে।
কারা আপনার কথা শুনছেন, তাদের কথা মাথায় রাখুন
যেকোনো সাক্ষাৎকার কিংবা কথোপকথনের সময় আপনার শ্রোতা কারা, তাদের কথা মাথায় রাখতে হবে। একটি চাকরির বাছাই প্রক্রিয়ায় আপনাকে হয়ত বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করতে হতে পারে। প্রতিটি ধাপেই হয়ত নিজের সম্পর্কে বলতে হতে পারে। কিন্তু প্রত্যেকবার তো আপনি একইভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবেন না। কারা আপনার কথা শুনছেন, তার কথা চিন্তা করে উত্তর সাজান। আপনি হয়ত এমন কোনো নিয়োগদাতার সঙ্গে কথা বলছেন, যিনি আপনার দক্ষতার খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানতে ততটা আগ্রহী নন, তখন আপনি তাকে মোটাদাগে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বলতে পারেন। আবার আপনি যখন আপনার সম্ভাব্য বসের সঙ্গে কথা বলছেন, তখন দক্ষতার খুঁটিনাটি এবং বিভিন্ন টেকনিক্যাল বিষয়গুলো উল্লেখ করতে পারেন।
আত্মবিশ্বাস ও উৎসাহের সঙ্গে কথা বলুন
সাক্ষাৎকারে অবশ্যই নিজেকে পেশাদারভাবে উপস্থাপন করতে হবে। তবে কেন আপনি প্রতিষ্ঠান ও চাকরিটি সম্পর্কে এতটা উৎসাহী তা উল্লেখ করুন। কিছুটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার (যদি থাকে) কথাও উল্লেখ করতে পারেন।
আপনাকে সব ব্যাপারে হয়তো দীর্ঘ বক্তব্য দিতে হবে না। তবে কথা বলার সময় নিজের আত্মবিশ্বাস ও উৎসাহ প্রকাশ করুন। কথার মধ্যে যাতে গতানুগতিকতা না থাকে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে পারেন।
প্রস্তুতি নিন, তবে কিছু মুখস্থ করবেন না
ধরুন সাক্ষাৎকারের শুরুতে নিজের সম্পর্কে বলতে বলা হবে, এই ব্যাপারে আপনি মোটামুটি নিশ্চিত। ফলে আপনি কী কী বলবেন, তা বাসা থেকেই মুখস্থ করে গেলেন। ইন্টারভিউ বোর্ডে কিন্তু আপনি এই মুখস্থ কথা বলতে পারবেন না। পারলেও সেটি শুনতে রোবটিক লাগবে, যা কেউ পছন্দ করবে না। আপনি বরং নিজের কোন কোন দিক সম্পর্কে বলতে চান, সে বিষয়ে বাসায় প্রস্তুতি নিন। আয়নার সামনে দাড়িয়ে চর্চা করুন। কিন্তু কোনো কিছু মুখস্থ করতে যাবেন না।
সূত্র: দ্য মিউজ
গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল
Comments