বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে দুর্বিষহ জীবন

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করার জন্য অনেকের সঙ্গেই কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই কথা বলতে রাজি হননি। বুঝতে পারি, তারা ভয়ে কথা বলতে চাচ্ছেন না।
হলের রুমে লাগেজ রাখারও ঠিক মতো জায়গা হয় না। ছবি: স্টার

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করার জন্য অনেকের সঙ্গেই কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই কথা বলতে রাজি হননি। বুঝতে পারি, তারা ভয়ে কথা বলতে চাচ্ছেন না।

শিক্ষার্থীরা তাদের অতি প্রয়োজনীয় এই বিষয়েও কথা বলেন না ভয়ে। এই ভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রেতাত্মার মতো ভর করে আছে। যারা কথা বলেছেন নিরাপত্তার স্বার্থে এই প্রতিবেদনে তাদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সূর্যসেন হলের বাসিন্দা সালমান হাবিব বলেন, 'রুমটি স্যাতস্যাতে এবং ভয়ংকর। একরুমে ৮ জন থাকি, মেঝেতে ঘুমাতে হয়। প্রথম বছর তো একরুমে ছিলাম প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ জন। সেটা অবশ্য এই রুমের চেয়ে বড় ছিল। আমাদের রুমে লাগেজ রাখারও ঠিক মতো জায়গা হয় না। ছাদ থেকে পলেস্তরা খসে পড়ে। ওই যে দেখেন, ছাদের রড দেখা যাচ্ছে।'

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আহসানউল্লাহ হলের বাসিন্দা বিবেক চৌধুরী হলে তার প্রথম বছরের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বলেন, 'আমাদের রুমটা ৬ জন শিক্ষার্থী থাকার মতো সাইজের ছিল না। এক কথায় সেটাকে অসম্ভবও বলে দিতে পারেন। নিজের জন্য টেবিল রাখার জায়গা তো ছিলই না। আমি একবার হলের পানির ফিল্টারে কিছু পোকার লার্ভা পেয়েছিলাম। কর্তৃপক্ষকে জানানোর পর তারা বললেন, এর জন্য আমরাই দায়ী। আমরাই নাকি ফিল্টারটা ঠিকভাবে ব্যবহার করছি না।'

গণরুম। ছবি: স্টার

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর মূল সমস্যা হচ্ছে নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য থাকার ব্যবস্থা না থাকা। সাধারণত নতুন শিক্ষার্থীদের গণরুমে থাকতে হয়। এসব গণরুমে ৩০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী একটি অস্বাস্থ্যকর রুমে থাকেন, যেখানে বায়ু চলাচল, স্বাস্থ্যবিধি বা শিক্ষার্থীদের সুস্থতার জন্য কোনো ব্যবস্থা থাকে না। এই গণরুমগুলো থাকে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রনে।

মেডিকেল কলেজগুলোর হলের অবস্থাও শোচনীয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. ফজলে রাব্বি হলের বাসিন্দা সাকিব আহমেদ বলেন, 'সবাইকেই যে সমস্যাটির মুখোমুখি হতেই হয় তা হলো, নতুন ভর্তি হয়ে গণরুমে উঠতে হয়। এটা একটা ভয়ংকর জায়গা। সেখানে আপনার নিজস্বতা বলতে কিছুই নেই।'

তিনি বলেন, 'যদি আপনার কপাল বেশি ভালো হয় তাহলে এমন রুম পাবেন যেখানে ৮ থেকে ১২ জন থাকতে হবে। অথচ, ওই রুম ডিজাইন করা হয়েছে ৪ জনের জন্য।'

তিনি আরও বলেন, 'যখন এত ছোট জায়গায় এত বেশি মানুষ থাকবে, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে আর স্বাস্থ্যবিধি থাকে না। টয়লেটগুলো অত্যন্ত নোংরা। এমন অবস্থা যে সেগুলো কোনোভাবেই ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। আর হলের আশেপাশের করিডোর ও মাঠগুলোকে শিক্ষার্থীরাই এক একটি ডাস্টবিনে রূপান্তরিত করেছে।'

দীর্ঘদিন ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাগুলো রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডাইনিং ও ক্যান্টিনে খাবারের মান। ঢাবির শামসুন নাহার হলের বাসিন্দা জারিন তাসনিম বলেন, 'যে খরচ দেখানো হয় সেই তুলনায় ডাইনিংয়ে খাবারের মান খুবই খারাপ।'

তিনি বলেন, 'খাবারের না আছে স্বাদ, না আছে পুষ্টি। বাধ্য হয়ে আমি নিজে রান্না করেই খাই। কিন্তু পড়াশুনাসহ সবকিছু মিলিয়ে সবসময় রান্না করা সম্ভবও হয় না। বিশুদ্ধ পানির অভাব তো এখানে নিত্যসঙ্গী। সবার পক্ষে কি আর বোতলের পানি কিনে খাওয়া সম্ভব? বাধ্য হয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে কলের পানিই খেতে হয়।'

হলেও টয়লেট। ছবি: স্টার

খাবারের খারাপ মানের কারণে অনেক শিক্ষার্থীই বাইরে খান। সাকিবের মতে, হলে খাবার যে সব সময় সাশ্রয়ী দামে পাওয়া যায় তা-ও না। তিনি বলেন, 'আমার হলের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এখানে ডাইনিংয়ের ব্যবস্থা নেই। ক্যান্টিনে খেতে হয়। মোটামুটি মানের খাবার খেতে প্রতিদিন দুপুর ও রাত মিলিয়ে অন্তত ২০০ টাকা খরচ করতে হয়।'

হলে আবাসন সমস্যা যে কেবল জায়গার অভাবে, বিষয়টি তেমন নয়। এর সঙ্গেও জড়িয়ে থাকে রাজনীতি। নতুন শিক্ষার্থীদের যখন গণরুমে রাখা হয়, তখনও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট অনেক শিক্ষার্থী ভালো রুমের বরাদ্দ পায়।

হলে রাজনীতির প্রভাব বিষয়ে সালমান বলেন, 'প্রত্যেকটা হলে চেইন অব কমান্ড আছে।'

তিনি বলেন, 'প্রতিটি ব্যাচ তাদের জুনিয়র ব্যাচটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর সিনিয়রদের কথা শোনা তো বাধ্যতামূলক, নইলে হল থেকে বেরও করে দিতে পারে। শিক্ষার্থীদের অনেকরই মেস ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তাই কষ্ট হলেও মুখবুজে পড়ে থাকে। অনেক সিনিয়ররা পড়া শেষ হলেও চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত রুম ছাড়েন না। তাদের মধ্যে অনেকে তো ৭ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে হলে থাকেন। মূলত রাজনৈতিক প্রভাব এবং জ্যেষ্ঠতার কারণে রুম বরাদ্দে বৈষম্য হয়। ৪ জনের জন্য ডিজাইন করা যে রুমে আমার ৮ জন থাকি, সেই একই ডিজাইনের রুমে আবার ২ জন থাকে। এ কারণেই এসব গণরুম করতে হয়।'

সালমানের মতে, ছাত্র রাজনীতির প্রভাব এবং চেইন অব কমান্ডের কারণেই রুম সংকট হয়। এর জন্য শুধু জায়গা বা রুমের সল্পতা দায়ী না।

তিনি বলেন, 'যদি কোনো শিক্ষার্থীকে তার সিনিয়র গেষ্টরুমে বা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ডাকেন, তাহলে তার যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এসব জায়গায় গেলে অন্তত ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় তার নষ্ট হবেই। হলে বসবাসকারী একজন শিক্ষার্থীর প্রধান উদ্বেগ থাকে টিকে থাকা নিয়ে। এই কারণে তারা আত্ম উন্নয়নে পিছিয়ে থাকে। মনের কোণে ভয় নিয়ে নতুন কিছু চিন্তা করা বা আত্ম উন্নয়নে সময় দেওয়া সম্ভব হয় না।'

মেয়েদের হলের অবস্থা এত বেশি খারাপ না হলেও ভালো না। সেখানেও হল বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় রাজনৈতিকভাবেই।

রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের বাসিন্দা নীলা ফেরদৌস বলেন, 'আমাদের হলের অপর্যাপ্ততার কারণে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা হলে কোনো সিট পায় না। অবশ্য রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকলে ভিন্ন কথা। স্বাভাবিকভাবেই, প্রথমবর্ষে হলে সিট পাইনি। তখন গণরুমে থাকতাম। সেখানকার পরিস্থিতি ছিল আমার ওপর বিশাল মানসিক আঘাত। তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর সিট পেয়েছি। একটি রুমে আমরা এখন ৫ জন থাকি। এখনও যে রুমে অনেক জায়গা তা কিন্তু নয়।'

হলে শিক্ষার্থীদের পোশাক রাখার জন্য কোনো ওয়ারড্রব রাখার জায়গা থাকে না। ফলে, এভাবেই দড়ি টাঙিয়ে তাতে ঝুলিয়ে রাখতে হয় কাপড়। ছবি: স্টার

ঢাবির জারিন বলেন, 'প্রথমবর্ষের ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে গণরুমে রাখা হয়। রাজনৈতিক গণরুমের পরিস্থিতি আরও খারাপ। সেখানে প্রায় ৮০ জনকে থাকতে হয় এক একটি রুমে। অনেককে মেঝেতে ঘুমাতে হয়। এমনকি এখন রুম বরাদ্দ পাওয়ার পরেও এক বিছানায় ২ জনকে থাকতে হয়।'

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলার সময় শিক্ষার্থীরা জানান, আবাসন, স্বাস্থ্যবিধি, মানসম্পন্ন খাবার, ক্যাম্পাসে নিরাপদ পরিবেশের মতো মৌলিক সুযোগ-সুবিধাগুলো তাদের অধিকার। হল কর্তৃপক্ষের উচিৎ, প্রথম থেকেই এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করা।

সাকিব বলেন, 'হলের ভবন সংস্কার, ইনডোর গেম, করিডোর ও মাঠ নিয়মিত পরিষ্কার করা দরকার। আমাদের স্থায়ী টয়লেট ক্লিনার নেই। বাড়তি টাকা দিলে সপ্তাহে ২ বা ৩ বার পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা এসে রুম পরিস্কার করে দিয়ে যান।'

তিনি আরও বলেন, 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে যে ঢাকায় যাদের থাকার জায়গা নেই সেইসব শিক্ষার্থী রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই হলে সিট পেয়েছে।'

রুয়েটের নীলা বলেন, 'আমাদের হলে সাধারণত সন্ধ্যা ৭টায় এবং শীতকালে সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ শুরু হয়। এত কঠোরভাবে এই নিয়ম মেনে চলা হয় যে কারো যদি ১০ মিনিটও দেরি হয়ে যায় ফিরতে, তাহলে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।'

মেয়েদের হলের সব সমস্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'কারফিউ দিলেও তা রাত ৯টার পরে হওয়া উচিৎ। ছেলেদের হলে থাকলেও আমাদের হলে পড়ার ঘর ও ওয়াইফাই সুবিধা নেই। প্রতি মাসে ইন্টারনেট ডেটা কিনে সবার পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না।'

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাগুলো রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডাইনিং ও ক্যান্টিনে খাবারের মান। ছবি: স্টার

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে নেয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য ড. মো. নুরুল আলম বলেন, 'একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। মানসম্পন্ন খাবার, মানসম্মত থাকার জায়গা আবশ্যক। সম্প্রতি আমি ক্যাম্পাসের সব হল প্রভোস্টের সঙ্গে বসে তাদের খাবারের মান এবং খাবারের দাম সম্পর্কে আরও সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে খাবারের দাম নির্ধারণের নির্দেশও দিয়েছি।'

জাবির হল প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি ড. আবদুল্লাহ হিল কাফি বলেন, 'কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই গণরুম থাকা উচিত নয়। ছাত্রজীবনের প্রথম দিন থেকেই একটি নির্দিষ্ট সিট তার জন্য নিশ্চিত করতে হবে। পড়ার জায়গা, বর্তমান সময়ে উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা একজন শিক্ষার্থীর জন্য আবশ্যক। হলের প্রভোস্টদের সব শিক্ষার্থীদের বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।'

২০২০ সালে ঢাবি কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় গণরুম বন্ধ এবং হলে নিয়ম ভঙ্গ করে অবস্থান করা সবাইকে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে, সেই সিদ্ধান্ত আজও বাস্তবায়ণ হয়নি। কর্তৃপক্ষ এর আগে বেশ কয়েকবার হল থেকে নিয়ম ভঙ্গ করে অবস্থানকারীদের উচ্ছেদের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশীল ছাত্রনেতাদের কারণে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশে পাবলিক ইউনিভার্সিটির হলগুলো দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুয়েটের একাধিক শিক্ষার্থীর মতে, আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনার পর ক্যাম্পাসটিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ায় বুয়েটের হলগুলো অনেকটাই নিরাপদ।

অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শোচনীয় জীবনযাত্রার অবস্থা বিবেচনায় প্রশ্ন থেকেই যায়—হলের মান উন্নয়নের জন্য কি শিক্ষার্থীদের জীবন দিয়েই মূল্য দিতে হবে?

 

প্রতিবেদনটি তৈরি করতে সহযোগিতা করেছেন দ্য ডেইলি স্টারের জাবি প্রতিনিধি শেখ তাজুল ইসলাম তাজ। অনুবাদ করেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস।

হাসিব উর রশিদ ইফতি; [email protected]

Comments

The Daily Star  | English
pharmaceutical industry of Bangladesh

Pharma Sector: From nowhere to a lifesaver

The year 1982 was a watershed in the history of the pharmaceutical industry of Bangladesh as the government stepped in to lay the foundation for its stellar growth in the subsequent decades.

16h ago