আশ্বাসে বিশ্বাসী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন

‘আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো’, ‘আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিবো’, ‘বিষয়টা মাত্র জানতে পারলাম, দেখছি’— বাক্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ নানান বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের থেকে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ আশ্বাস। বছর পেরিয়ে গেলে বোঝা যায়, বাক্যগুলো শুধু বলার জন্য-ই বলা। মুখস্থ কিছু বুলি সর্বস্বমাত্র।
স্টার বাংলা অনলাইন গ্রাফিক্স

'আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো', 'আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিবো', 'বিষয়টা মাত্র জানতে পারলাম, দেখছি'— বাক্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ নানান বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের থেকে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ আশ্বাস। বছর পেরিয়ে গেলে বোঝা যায়, বাক্যগুলো শুধু বলার জন্য-ই বলা। মুখস্থ কিছু বুলি সর্বস্বমাত্র।

সাময়িকভাবে বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা থেকে এমন কথা বলা, নাকি আসলেই সমাধানের আশা নিয়ে এমন আশ্বাস দেওয়া, সেটা হতে পারে তদন্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এমন অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আশ্বাস দিলেও বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন বা সমাধানে আসতে পারেনি।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে উঠে আসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্টটি দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত, ক্যাম্পাস পরিণত হচ্ছে ময়লার ভাগাড়ে।

তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলে, 'আমরা বিষয়টি মাত্র জানতে পারলাম। আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করবো৷'

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যে ময়লার ভাগাড় হয়ে আছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট যে অকেজো, সেটা একজন সাংবাদিক বলার পর প্রশাসন জানতে পেরেছেন। এর মাধ্যমেই পরিষ্কার হয় যে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসন কতটা দায়িত্বশীল।

এবার আসা যাক, 'আমরা বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করবো' এই বাক্যে। এই বিষয়টা নিয়ে পরবর্তী প্রায় ১০ মাসে ঠিক কতবার আলোচনা করার সুযোগ ছিল বা থাকে— সে আলোচনায় না গিয়ে যদি ধরে নেওয়া হয় যে আলোচনা অনেকবার হয়েছে, সেক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেনি।

তৃতীয় আরেকটি পছন্দের বাক্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের রয়েছে। সেটি হলো 'আমরা এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিবো'।

গত ৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবীমা, খাবারের মান,  ইন্টারনেট সেবা ইত্যাদি নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে স্মারকলিপি দেন শিক্ষার্থীরা। তখনও প্রশাসন আশ্বাস দেয়, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার।

এই দ্রুততা কতদিনে, কতমাসে হবে সেই হিসাব প্রযুক্তির এই যুগে মেলানো অসম্ভব। এভাবে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা এমন সংকটের মুখোমুখি হন। বছর পেরিয়ে বছর আসে, উপাচার্যর পর আরেক উপাচার্য আসেন, কিন্তু শিক্ষার্থীদের হতাশা কাটে না।

এবার যাওয়া যাক ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে। গত ২ অক্টোবর দ্য ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদনে জাবির ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শেখ মোহাম্মদ সিয়াম একটি সিটের জন্য লড়তে গিয়ে কতটা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন, সেটি প্রকাশ পেয়েছে। আড়াই বছরেও দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পড়ার টেবিল ও ঘুমানোর জায়গা না পাওয়া সিয়াম একাই উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে সিয়াম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উপাচার্যের এক একান্ত সচিব আরেক একান্ত সচিবের সঙ্গে পরের দিন দেখা করতে যেতে বলেন শুধুমাত্র অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার জন্য।'

কবে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন, সেটা সিয়াম জানেন না। তবে, সিয়াম জেনেছেন, উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে হলে তাকে আগে উপাচার্যের ২ একান্ত সচিবের সঙ্গে ২ দিন আলাদা করে দেখা করতে হবে। তার মানে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ অভিভাবককে পেতে একজন শিক্ষার্থীর লেগে যায় অন্তত ৭২ ঘণ্টা।

একজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে ৩ দিন সময় অতিবাহিত করতে হবে? এরপরও উপাচার্যের দেখা পাওয়া যাবে কি না, শিক্ষার্থীরা জানেন না।

অথচ ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের শিক্ষার্থীরা চাইলেই দেখা পেতে পারেন উপাচার্যের এবং শিক্ষকদের বিভিন্ন আয়োজনে তার সরব উপস্থিতির দেখা যায়।

এ বিষয়ে, আরও ২টি ঘটনা তুলে ধরা যেতে পারে।

'অভিযোগ নিয়ে জাবির সাবেক উপাচার্য ফারজানা ইসলামকে একাধিকবার কল ও মেসেজ করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি'।

এই লেখাটি এ বছরের ২৩ মার্চ দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত 'ভর্তি পরীক্ষার টাকা শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ভাগ-বাঁটোয়ারা' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন থেকে নেওয়া।

প্রতিবেদনটিতে দেখানো হয়, ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি সভা করে সভাপতিসহ প্রত্যেক ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির প্রত্যেক সদস্য সর্বনিম্ন ৯ হাজার ৮৫৭ টাকা করে নিয়েছেন। বিতর্কিত শিফট পদ্ধতিতে ১ দিনে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা করে নিয়েছেন শিক্ষকরা। উপ-উপাচার্য ২ জন হলেও ৩ জনকে সদস্য হিসেবে ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র 'সম্মান রক্ষার্থে'।

এমন গুরুতর অভিযোগ নিয়ে কথা বলতেও কল বা মেসেজ করে পাওয়া যায়নি সাবেক উপাচার্য ফারজানা ইসলাম, এমনকি বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. নুরুল আলমকে।

'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নুরুল আলম এবং সাবেক উপাচার্য ফারজানা ইসলামকে একাধিকবার কল করা হলেও তারা কেউ কল ধরেননি এবং মেসেজ দেওয়া হলেও তার উত্তর দেননি।'

এটুকুও এ বছরের ২৭ জুন দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত 'জাবি: প্রশাসনিক ভবন নিয়ে আরেক দফা তথ্য গোপন' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন থেকে নেওয়া।

প্রতিবেদনটিতে দেখানো হয়, ২টি প্রশাসনিক ভবন থাকা সত্ত্বেও ডিপিপিতে তৃতীয় প্রশাসনিক ভবনের প্রয়োজনীয়তা দেখাতে গিয়ে ২ জায়গায় তথ্য গোপন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেক্ষেত্রে অপচয়ের পথে ছিল শত কোটি টাকা।

তথ্য গোপন, অপচয়— এমন বিষয়ে কথা বলতে চেষ্টা করেও সাড়া মেলেনি উপাচার্যর কাছ থেকে।

এমন উদাহরণ আরও অনেকগুলো দেওয়া যেতে পারে, যেখানে উপাচার্যরা কল বা মেসেজের উত্তর পরবর্তীতে কখনো দেননি।

উপাচার্যরা কি কেবলমাত্র শিক্ষার্থীভেদে বা সাংবাদিকদের এমন ব্যস্ততা দেখান? নাকি তারা সবসময়ই এমন ব্যস্ত থাকেন? এমন প্রশ্ন আসা খুবই স্বাভাবিক।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ শিক্ষার্থী এবং এর অভিভাবক উপাচার্য। উভয়ের সম্পর্কে এমন দূরত্ব শিক্ষা সহায়ক নয়। এটা উপাচার্যদের ভাববার বিষয় হতে পারে কি? যদি ব্যস্ততা কমিয়ে শিক্ষার্থী বা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ উপাচার্যরা কখনো কখনো বের করে ফেলেন, সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র ওই 'আলোচনা করবো', 'মাত্র জানলাম', 'দ্রুত ব্যবস্থা নিবো' কথার বাইরে গিয়ে কোনো কথা শিক্ষার্থীরা আশা করতে পারেন কি?

শেখ তাজুল ইসলাম তাজ, নিজস্ব সংবাদদাতা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Comments