সাবেক ব্যক্তিগত সহকারীকে বাঁচাতে ‘মরিয়া’ চবি উপাচার্য
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে পদ বেচাকেনা সংক্রান্ত ৫টি ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার ঘটনায় উপাচার্য অধ্যাপক শিরিন আখতারের সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) খালেদ মিসবাহুল মোকর রবীনের জড়িত থাকার প্রমাণ মিললেও কোনো শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে প্রভাষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগের পর অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত ৫টি ফোনালাপ ফাঁস হয় চলতি বছরের জানুয়ারিতে। এর মধ্যে একটি ফোনালাপে প্রভাষক পদের এক প্রার্থীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পিএস রবীনকে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলতে শোনা যায়। অপর একটি ফোনালাপে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর শীর্ষ ব্যক্তিদের 'ম্যানেজ' করতে উপাচার্যের টাকার প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক কর্মচারী।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫ মার্চ ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি 'উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন' তদন্ত কমিটি গঠন করে চবি প্রশাসন। সেদিন সংবাদ সম্মেলন করে উপাচার্য শিরিন আখতার ৩ কর্মদিবসের মধ্যে অভিযুক্তদের লিখিত বক্তব্য পাওয়ার পর এর মূল হোতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেন। জানান, এ ঘটনায় তিনি বিব্রত।
কিন্তু তদন্ত কমিটি রবীনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দিলেও তা আমলে নেননি উপাচার্য। এর সঙ্গে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা প্রহরী আহমদ হোসেনের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়রি করা হয়। সাময়িক বরখাস্ত করা হয় তাকে। তবে রবীনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি প্রশাসন।
এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের অভিযোগ, সাবেক পিএসকে রক্ষায় পুনঃতদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ করে বিষয়টি ধাপাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন উপাচার্য অধ্যাপক শিরিন আখতার। এছাড়া বিতর্ক এড়াতে ব্যক্তিগত সহকারী পদ থেকে সরিয়ে রবীনকে আবার 'উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক' হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।
ফোনালাপকাণ্ডে ৪ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য ও পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম মাইনুল হক মিয়াজী। কমিটি গত ২৭ জুলাই ৫৩৮তম সিন্ডিকেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনের একটি কপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে রবীন এবং আহমদকে ফোনালাপকাণ্ডের জন্য দায়ী করে তারা ২ জনসহ অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ফৌজদারি মামলা দায়ের করার সুপারিশ করা হয়। বলা হয়, 'নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নামে বেনামে প্রার্থীদের সাথে যোগাযোগসহ অর্থের বিনিময়ে চাকুরি দেওয়ার লোভ প্রদানকারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত চক্রটিকে খুজে রের করে আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে ফৌজদারী মামলা দায়ের করার সুপারিশ করার জন্য কমিটি সর্বসম্মতভাবে সুপারিশ করছে।'
সেখানে আরও বলা হয়, 'রবিন এবং আহমদ ফোনালাপে যে দুঃসাহস প্রদর্শন করে অবলীলায় আপত্তিকর কথাবার্তা বলেছেন তাতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, কারো প্ররোচনা বা প্রনোদনা বা যোগসাজশ ছাড়া তারা এরুপ করেননি।'
এছাড়া প্রতিবেদনে রবিনকে সিইউ এমপ্লয়িজ (এফিসিয়েন্সি অ্যান্ড ডিসিপ্লিন) স্ট্যাটাস-৩ ও ৪ (১) ধারা অনুসারে পদাবনতির যোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি আরও যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে নিরাপত্তা প্রহরী আহমদের চাকরিচ্যুতি এবং রবীনের পদাবনতির জন্য আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা বলে অধ্যাপক মাইনুল হক মিয়াজীর নেতৃত্বাধীন কমিটি।
সে অনুসারে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহকে আহ্বায়ক করে ৪ সদস্যের নতুন একটি কমিটি গঠন করা হলেও সেই কমিটি এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের কয়েকজন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, উপাচার্যের 'কাছের লোক' হওয়ায় অর্থের বিনিময়ে চাকরির প্রলোভন দেখানোর সাহস করেছেন রবীন। এই শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ভাষ্য, রবীনকে দায়মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদের ডিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখন প্রমান থাকার পরও মামলা দায়ের করা হচ্ছে না এবং নানা দোহাই দিয়ে তা বিলম্ব করা হচ্ছে, তার মানে এর পেছনে আরও কেউ আছে। রবীন গ্রেপ্তার হলে জড়িতদের নাম বের হয়ে আসবে। তিনি উপাচার্যের কাছের লোক হওয়ায় বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন- এতে কারো কোনো সন্দেহ নেই।'
উল্লেখ্য, নিয়োগ বাণিজ্যের বিরোধের জের ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ গত ১৭ই অক্টোবর রবীনকে টেনে-হিঁচড়ে প্রশাসনিক ভবনে উপাচার্যের কক্ষে নিয়ে যায় এবং শারীরিকভাবে হেনস্তা করে।
রবীনের বিরুদ্ধে এখনো কেন কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি- জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান দ্যা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা আসলে দ্বিতীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি। ওটার প্রতিবেদন পেলেই আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো। মামলা করতে দেরি হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়।'
মনিরুল হাসান আরও বলেন, 'আদালতের অর্ডার নিয়ে সে (রবীন) কাজে যোগদান করেছে। আমরা তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিলাম। এ বিষয়ে উপাচার্য আরও ভালো বলতে পারবেন।'
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি দ্বিতীয় তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ। আর এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য উপাচার্য শিরিন আখতারের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি এর কোনো জবাব দেননি।
Comments