কনুইবাজীর কাফফারা একটি সেমিস্টার

একটি পুরো সেমিস্টার নষ্ট হতে যাচ্ছে বলে শিক্ষার্থীরা শঙ্কায় আছেন। এতে তাদের অ্যাকাডেমিক ও আর্থিক চরম ক্ষতি হচ্ছে। যদিও এ ব্যাপারে প্রশাসন নির্বিকার, নির্লিপ্ত।

কতটা কলহপ্রবণ, অসংবেদনশীল আর স্বার্থপর হলে দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে হাজারো শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি করা সম্ভব? কতটা নির্লিপ্ত হলে অবলীলায় ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রেখে একে অপরের বিরুদ্ধে বিশ্রী বিষোদগার চালিয়ে যাওয়া সম্ভব? এসবের জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় এক মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। জুনের শুরুতে গ্রীষ্মকালীন ছুটি। তাই ঈদুল আজহার আগে ক্যাম্পাস খোলার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে শিক্ষক নেতারা উপাচার্যের কুশপুত্তলিকা ঝুলাচ্ছেন। আর উপাচার্য দিচ্ছেন দায়ী শিক্ষকদের শাস্তির হুমকি।

২৮ এপ্রিল উপাচার্য ও শিক্ষকদের মধ্যে নজিরবিহীন কনুইবাজীর পর থেকেই বন্ধ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষক-উপাচার্যের দ্বন্দ্বে এতদিন ধরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার বিষয়টি সত্যিই অকল্পনীয়। আমাদের ছাত্রজীবনে ছাত্রদল-ছাত্রলীগ সংঘাতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থেকেছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাসখানেক বন্ধ ছিল। আর ২০২৪ সালে এসে দেখছি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ উপাচার্য ও শিক্ষকদের কলহে। ভেবেছিলাম শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কুৎসিত এই কলহের অতি দ্রুত অবসান হবে। দায়িত্বশীল মন্ত্রী বা উপদেষ্টা বা রাজনীতিবিদ হস্তক্ষেপ করবেন। কিন্তু হায়! সবাই কেন যেন নির্বিকার। সবাই নিশ্চুপ। অচল অবস্থা চলছেই। যার মাশুল দিচ্ছেন ছয় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী।

গত ৩০ এপ্রিল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির অ্যাকাডেমিক, প্রশাসনিক কার্যক্রম ও আবাসিক হলগুলো বন্ধ। মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় সচল করতে একটি সিন্ডিকেট বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এখন অপেক্ষা চলছে, তদন্ত কমিটির রিপোর্টের। এটা আরেক সার্কাস। খুব সম্ভবত বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭৫ জন শিক্ষক রয়েছেন। তাদের প্রতিনিধি শিক্ষক নেতাদের ভাষ্য, যৌক্তিক দাবিগুলো মানলে শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরবেন। এ ছাড়া তাদের ওপর সংঘটিত দুই দফা হামলারও বিচার হতে হবে।

অন্যদিকে উপাচার্য বসে আছেন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের জন্য। যতদূর জানা যায়, কনুইবাজীর ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট চলে এসেছে। আরেকটি কয়েকদিনের মধ্যেই আসবে। অন্যদিকে উপাচার্যও চান, তার ওপর হওয়া হামলার যথাযথ শাস্তি।

এমন পরিস্থিতিতে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যাই আসুক না কেন, অচল অবস্থা নিরসনের কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, 'স্বার্থবাদী' শিক্ষকরা উপাচার্যের কোনো সিদ্ধান্তই মানবেন না। আর নিজ অবস্থানে অটল, অনড় কিছুটা অভিমানী উপাচার্যও তার ওপর হওয়া হামলার একটা শেষ দেখে ছাড়বেন।

কুৎসিত এই কলহের শেষ অঙ্কে কে কাকে দেখে নেবেন, সেটা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু এর কাফফারা যে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন দিচ্ছেন, তার কোনো সমাধান নেই। যতদূর জানি, এই অচল অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি বিভাগের চূড়ান্ত পরীক্ষা আটকে গেছে। চলতি মাসের শেষে অনেক বিভাগে পরীক্ষা শুরুর কথা ছিল—তাও এখন অনিশ্চিত। ক্লাস ও মিডটার্ম পরীক্ষার কথা তো বাদই রাখলাম। আর শিক্ষাদান, শিক্ষাগ্রহণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন তো অনেক দূরের কথা।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অচল অবস্থার শুরুতে দ্য ডেইলি স্টার বাংলায় একটা মতামত লিখেছিলাম। তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী ফেসবুক ইনবক্সে বর্তমান উপাচার্য ও শিক্ষকদের স্বার্থবাদী রাজনীতি নিয়ে বেশ কিছু হতাশার কথা বলেছিলেন। কিছু অভিযোগ তুলেছিলেন, যেগুলো উপাচার্য ও শিক্ষক কারও জন্যেই খুব একটা প্রীতিকর নয়। এখনো তারা ইনবক্সে আকুতি জানাচ্ছেন। স্যার, কিছু একটা করেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টা খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তারা বলছেন, ঈদের আগে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কোনো ইঙ্গিত নেই। তার মানে প্রায় দেড় মাস অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ। এ অবস্থায় একটি পুরো সেমিস্টার নষ্ট হতে যাচ্ছে বলে শিক্ষার্থীরা শঙ্কায় আছেন। এতে তাদের অ্যাকাডেমিক ও আর্থিক চরম ক্ষতি হচ্ছে। যদিও এ ব্যাপারে প্রশাসন নির্বিকার, নির্লিপ্ত।

গত ২৫ মার্চ এক অনুষ্ঠানে কথা হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকারী অধ্যাপকের সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করলাম, কবে বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে? হতাশার সঙ্গে জানালেন, ঈদের আগে নয়। জানতে চাইলাম, অচল অবস্থার কবে অবসান হবে? তিনি স্পষ্ট করে জানালেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সাপেক্ষে কোনো শিক্ষককে সাজা দেওয়া হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। শিক্ষকরা দীর্ঘ কর্মবিরতিতে যাবেন। অচল অবস্থার অবসান হবে না।

জানতে চাইলাম, চলমান সংকটে দুইটি বিবাদমান দলে শিক্ষকদের হার কেমন? জানালেন, ২০-২৫ জন শিক্ষক আছেন উপাচার্যের সঙ্গে। আর আন্দোলনে আছেন অন্তত ৮০-৯০ জন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষক আছেন ২৭৫ জন। তাদের সিংহভাগই দাবি-দাওয়া ও রাজনীতির আশেপাশে নেই। তারা দ্রুত ক্লাসে ফিরতে চান।

কিন্তু ক্লাসে ফেরার তথা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও উপাচার্য অধ্যাপক এ এফ এম আবদুল মঈন অনেকটাই নির্বিকার। আর বর্তমান উপাচার্য এই সংকট সমাধান করতে পারবেন—তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। তাই এই অচলাবস্থা অবসানে উচ্চমহলের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, আপনি একটু বিষয়টা দেখবেন? ছয় হাজার শিক্ষার্থী সীমাহীন ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। দয়া করে, ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ আর নষ্ট হতে দেবেন না, প্লিজ!

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English
Yunus meets Malaysian PM Anwar Ibrahim

Anwar Ibrahim to consider issue of Bangladeshi workers

Malaysian Prime Minister Anwar Ibrahim today promised to consider the issue of 18,000 Bangladeshi workers who missed a deadline to enter Malaysia saying that they need workers, but not "modern slaves"

6h ago