কুয়েট ভিসির পদত্যাগ চায় শিক্ষার্থীরা, বিপক্ষে শিক্ষক-কর্মকর্তারা

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক মো. মাসুদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে এই দাবির বিপক্ষে মানববন্ধন করেছেন কুয়েট শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
আজ বুধবার দুই পক্ষই তাদের কর্মসূচি পালন করেছে।
দুপুর ১২টার দিকে কুয়েটের ভাস্কর্য দুর্বার বাংলার পাদদেশ থেকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলটি বিভিন্ন একাডেমিক ভবন ঘুরে আবার সেখানে গিয়ে শেষ হয়। সেই সময় শিক্ষার্থীরা ভিসিবিরোধী নানান রকমের স্লোগান দিতে থাকেন। শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনসহ বিভিন্ন ভবনের দেয়াল ভিসির পদত্যাগের দাবি সম্মিলিত পোস্টারও লাগান।
বিক্ষোভ মিছিল শেষে শিক্ষার্থীরা স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারে প্রেস ব্রিফিং করেন। সেখানে শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে দেশবাসী, অন্তর্বর্তী সরকার এবং আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের কাছে উপস্থিত হয়েছি। আমরা দেখেছি গত ১৮ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর ভিসি স্যার যখন নিজের দায় স্বীকার না করে তিনি বললেন, তার লেট হয়েছে, তখন থেকেই ভিসির পদত্যাগের দাবির সূত্রপাত ঘটে। অথচ তার এই লেট করার জন্য আমাদের দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর ওপর হামলা হয়। তার এই বক্তব্য আমার ভাইদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি। ঘটনার দুই মাস পরেও ভিসি স্যার তার বক্তব্য প্রত্যাহার করেননি। বরং নানা কৌশলে আমাদের দাবি থেকে সরে আনার চেষ্টা করা হয়।
'শেষে যখন আমাদেরকে মিথ্যা মামলা দেওয়ার পরেও দমন করা যায় নাই। তখন আমাদেরকে বহিষ্কার করা হয়। ৩৭ জন বহিষ্কার করার তালিকা করা হয়। যেখানে ছাত্রদলের ২২ জনের তালিকার পরেও ৩৭ জন হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ফাঁসানো হয়েছে। হল খুলতে আসা শিক্ষার্থীদের হল খুলে না দেওয়ায় রাস্তায় শুয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে। শেষ সিন্ডিকেট মিটিংয়েও কতিপয় শিক্ষকরা ভিসি স্যারের পদত্যাগ থেকে সরে না এলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে এবং আমাদের ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে জানানো হয়।'
তারা আরও বলেন, আমরা খুবই স্পষ্টভাবে বলতে চাই। আমাদের সংগ্রাম শিক্ষকদের সঙ্গে নয়, প্রশাসনের সঙ্গে। আমাদেরকে বারবার শিক্ষকদের সামনে দাড় করাবেন না। বরং আমরা বিশ্বাস করি, যেই শিক্ষকরা প্রকৃতভাবে শঙ্কিত, তারা আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন, আমাদের দাবির সঙ্গে একমত প্রকাশ করবেন। আমাদের অসহায়ত্ব দেখে আপনারা যদি না আসেন, আমাদের সঙ্গে তাহলে কে দাঁড়াবে? আজ সারাদেশ আমাদের সঙ্গে, অথচ আমরা লজ্জিত, আমাদের শিক্ষকরা আমাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন না। আমদের সারা বাংলাদেশ প্রশ্ন করে, তোমাদের শিক্ষকরা কোথায়? আমরা এর কী উত্তর দেবো?
'আমাদের এক দফা দাবিতে যেতে হলো। কারণ আমরা শঙ্কিত, যেই ভিসি স্যার আন্দোলন নস্যাৎ করতে আমাদেরকে বহিষ্কার করতে পারে, সেই ভিসি স্যারের সঙ্গে আমরা এখন আপসে গেলে পরবর্তীতে আমাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কী? আমাদের বেশিরভাগ দাবিই পূরণ হয় নাই দুই মাসে। তাহলে বাকি দাবিগুলো আরও দুই মাসেও যে পূরণ হবে, তার নিশ্চয়তা কী? তাই আমরা বিশ্বাস করি আমাদের বাকি দাবিগুলো পূরণ করা এবং ভবিষ্যতে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কোনো গ্রাউন্ড এই ভিসি রাখেনি। তাই উনার পদত্যাগ অবধারিত। আমরা আরও বিস্মিত ১৮ তারিখের হামলাকে তদন্ত কমিটি সংঘর্ষ বলছে। এইটি কি আসলেই সংঘর্ষ? আর ঘটনা ঘটেছে ১৮ তারিখ। কমিটির কাজও ১৮ তারিখের তদন্ত করা। সেই কমিটি এখন ১৮-১৯ এর কথা কেন বলছে? ১৯ তারিখ কী হয়েছে? আমরা আরও দেখি বটপেজ থেকে আমাদের বিরুদ্ধে পোস্ট দেওয়া হয়। সেখানে আমাদের ক্যাম্পাসের সিসিটিভি ফুটেজ দিয়ে পোস্ট দেওয়া হয়। আমাদের ক্যাম্পাসের সিসিটিভির ফুটেজ, সেটা তদন্ত কমিটি আর সিন্ডিকেট ছাড়া কীভাবে বটপেজের কাছে গেল? আমরা তার জবাবদিহিতা চাই। তাহলে কি প্রশাসনই প্রমাণাদি সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দিয়েছে নিয়ম ভেঙ্গে?'
সবশেষ তারা বলেন, আমরা গতকাল আরও শুনতে পেরেছি ভিসি স্যার মিডিয়াতে বললেন, আমাদের দাবি ইয়ে করে না। সরকার চাইলে তিনি সরবেন। তাহলে আমাদের প্রশ্ন সরকার কেন চাচ্ছে না? যেই অন্তর্বর্তী সরকারকে আমাদের রক্তের বিনিময়ে ক্ষমতায় আসলো, সেই সরকার কি ছাত্রদের বিপক্ষে? আমরা পুরো দেশবাসীকে বলতে চাই, আজ এই সরকার ছাত্রদের পাশে না দাঁড়ালে তাদের ক্ষমতার কোনো ন্যায্যতা নাই। কোথায় আসিফ মাহমুদ? কোথায় মাহফুজ আলম? কোথায় শিক্ষা উপদেষ্টা? কোথায় আসিফ নজরুল যিনি জুলাইয়ে রাজপথে নেমেছিলেন? আপনারা কি দেখছেন না কুয়েটের বুকে আবার জুলাই নেমেছে? হাসিনা আমলেও আন্দোলনকারীদের বহিষ্কার দেওয়ার মতো কথা কোনো ভিসি ভাবেনি। তাহলে এখনকার আমলের ভিসিদের স্বৈরাচারিতার দুঃসাহস কারা যোগাচ্ছে? আমরা সরকারকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছি। গতকাল সারাদেশে কী হয়েছে দেখেন? আপনাদের হুঁশিয়ারি দিচ্ছি, আপনারা আমাদের ভিসিকে অপসারণ করে শিক্ষার্থীদের ওপর বহিষ্কারাদেশ ও মামলা তুলে না দিলে পরবর্তী জুলাই হবে আপনাদের বিরুদ্ধে।

অন্যদিকে উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবির বিপক্ষে মৌন মিছিল, মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে কুয়েট শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দুপুর পৌনে ১টার দিকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে মিছিলটি শুরু হয়। তারপর ভাস্কর্য দুর্বার বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়। সেই সময় শিক্ষক-কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীরা কুয়েট উপাচার্যকে হয়রানি করছে দাবি করে এর প্রতিবাদ জানান। একইসঙ্গে শিক্ষক সমিতি থেকে জানানো হয়, প্রকৃত দোষীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরবেন না।
সমাবেশে কুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি সাহিদুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, শিক্ষার্থীদের ছয় দফা মেনে নিয়েছে প্রশাসন। তারপরও কেন তারা এক দফায় গেল। সিন্ডিকেট ৩৭ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে। ডিসিপ্লিনারি কমিটি আছে, তারা এটি তদন্ত করবে। তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ থাকবে। সেখানে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি হবে। এটা নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার কোনো কিছু নেই।
শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, তোমাদের প্রতি আহ্বান জানাব, তোমরা সিন্ডিকেটের এই সিদ্ধান্ত মেনে নাও। আজকের ভেতরে তোমরা হলগুলো খালি করে দাও। যদি এই ৩৭ জনের কেউ প্রকৃত দোষী না হয়, তাহলে কেউ শাস্তি পাবে না।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষক সমিতির একটি দাবি ছিল প্রকৃত দোষীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্লাসে ফিরব না। শিক্ষক ও ছাত্র কখনো পরস্পরের প্রতিপক্ষ হতে পারে না। কিন্তু কতিপয় দুষ্কৃতিকারী শিক্ষার্থী তাদের নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য শিক্ষকদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন। কিছু দুষ্কৃতিকারী কুয়েটের সুনাম নষ্ট করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। ভিসি স্যার কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি ও দুষ্কৃতিকারীদের প্রশ্রয় দেন না। এই প্রশ্রয় না দেওয়ার কারণেই ছাত্ররা এক দফা দাবি করছে। আমরা শিক্ষক সমিতি এই এক দফার সম্পূর্ণ বিপক্ষে। আমাদের এক দফা হচ্ছে—এই যারা দুষ্কৃতকারী, যারা বিভিন্ন ধরনের অকারেন্স করেছে, তাদের শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমরা ক্লাসে ফিরব না।
সমাবেশে কুয়েট কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসিব সরদার, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক খন্দকার মাহবুব হাসান, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও একাডেমিক কার্যক্রম সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী জুলফিকার হোসেন, বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ শাহজাহান আলী, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক এমএমএ হাসেম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
Comments