জাবিতে ৫ বছরেও শেষ হচ্ছে না স্নাতক, তবে দৃষ্টান্ত আইন ও বিচার বিভাগ
তখন ঘড়িতে দুপুর প্রায় ১২টা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সামনে অপেক্ষায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। কেউ আড্ডা দিচ্ছেন, কেউ এদিক-ওদিক ঘুরছেন। দুই শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখন ক্লাসের সময়, কিন্তু শিক্ষক আসেননি।
তারা জানান, ইংরেজি বিভাগে এটি একটি নিয়মিত চিত্র। বেশিরভাগ সময়ই শিক্ষকরা নির্ধারিত সময়ে ক্লাস নেন না। কেউ কেউ ক্লাসে আসেন নির্দিষ্ট সময়ের এক-দেড় ঘণ্টা পর। নিয়মিত ক্লাস না করিয়ে পরীক্ষার আগে তাড়াহুড়া করে সিলেবাস শেষ করতে ছুটির দিনেও ক্লাস নেওয়ার নজির আছে এই বিভাগে।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দ্বিতীয় বর্ষে থাকতে পরীক্ষার আগে সিলেবাস শেষ করার জন্য শুক্রবার ছুটির দিনে এক শিক্ষক ক্লাস নিয়েছিলেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ক্লাসরুমে। যতদূর মনে আছে, সেই ক্লাসটা আমাদের ওই কোর্সের দ্বিতীয় ও শেষ ক্লাস ছিল। এভাবেই তিনি দুইটি ক্লাস নিয়ে সিলেবাস শেষ করেছেন।'
অন্য বিভাগে ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে তিনি জানান, প্রতি শুক্রবার বিভাগে 'উইকেন্ড প্রোগ্রামের' ক্লাস হয়।
কেবল ইংরেজি বিভাগ নয়, ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থীদের ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও স্নাতক চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা হয়নি অর্থনীতি, নৃবিজ্ঞান, দর্শন, প্রত্নতত্ত্ব, প্রাণিবিজ্ঞান, সরকার ও রাজনীতি, প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ বেশ কয়েকটি বিভাগে।
২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয় ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের।
এই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা শুরু হয়েছে পরিসংখ্যান, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে। অন্যদিকে, ইতিহাস, বাংলা ও গণিত বিভাগের স্নাতক সম্মান পরীক্ষা শেষ। তবে ফল প্রকাশিত হয়নি। এর মধ্যে ব্যতিক্রম আইন ও বিচার বিভাগ। এই বিভাগটি ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা শেষ করে গত ১৯ ডিসেম্বর ফল প্রকাশ করেছে।
জানা গেছে, বিভাগের নিজস্ব কোনো ক্লাসরুম না থাকায় দুটি পৃথক ভবনের অন্য বিভাগে ক্লাসরুমে চলে আইন ও বিচার বিভাগের শ্রেণি কার্যক্রম।
আইন ও বিচার বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতক শেষ করা জান্নাতুন নাইম আনিকা ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে আমরা সবার আগে বের হচ্ছি এবং সমাবর্তন পেতে যাচ্ছি। ক্লাসরুম ও শিক্ষক সংকট নিয়েও শিক্ষকদের সদিচ্ছায় একাডেমিক কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে পেরেছি আমরা।'
আরও জানা যায়, আইন ও বিচার বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের স্নাতক সম্মান পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়ে গেলেও ততদিনে ফল পাননি ইংরেজি বিভাগের তাদের অগ্রজ ব্যাচ ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা।
এমনকি সেসময় ইংরেজি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা তৃতীয় বর্ষেরও ফলও পাননি, যদিও ততদিনে অনেক বন্ধু হয়ে গেছেন গ্র্যাজুয়েট। নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা চাকরির পরীক্ষায় বসতে পারছেন না।
পরীক্ষা শেষের ৩ মাস মধ্যে ফল প্রকাশের নিয়ম থাকলেও ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল শেষ করা তৃতীয় বর্ষের ফল প্রায় ৯ মাস পর ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি প্রকাশ করেছে ইংরেজি বিভাগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগের শিক্ষকরা 'নিয়মিত কোর্স নিয়ে অতিরিক্ত চাপে' থাকার কথা জানান।
তবে, 'অতিরিক্ত চাপের' কথা উল্লেখ করলেও উইকেন্ড প্রোগ্রামে প্রায় সব শিক্ষকই অতিরিক্ত ১ থেকে ৩টি কোর্স নিচ্ছেন। জানা গেছে, সেখান থেকে বড় অঙ্কের পারিশ্রমিক পান শিক্ষকরা।
ইংরেজি বিভাগের চেয়ারপারসন সাবেরা সুলতানা বলেন, 'এসব সমস্যা এই বিভাগে নতুন কিছু নয়। আমরা শিক্ষকরা অতিরিক্ত চাপে আছি। শিক্ষকরা খাতা জমা দিতে দেরি করায় রেজাল্ট দিতে দেরি হয়।'
২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক সম্মান চুড়ান্ত পরীক্ষা শুরু হয়নি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগেও। কবে শুরু হতে পারে সে বিষয়েও নিশ্চিতভাবে কিছু জানাতে পারেননি বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক জয়ন্ত সিংহ রায়।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিভাগের একাডেমিক কার্যক্রম পিছিয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের ফিল্ডওয়ার্ক বাকি আছে। সেটা শেষ করে পরীক্ষা হবে।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশন জট সমস্যা নিয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, 'এক্ষেত্রে "শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি" উপকারী হতে পারে। শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে পারে তাহলে আর এসব সমস্যা থাকবে না। মূল্যায়ন বলতে একটা মার্কিং ব্যবস্থা যেখানে শিক্ষকদের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা মার্কিং করবে। তাছাড়া ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের কথা বলার জায়গা নেই। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদসহ সব বিভাগের ছাত্রসংসদগুলো অচল। দীর্ঘদিন নির্বাচন হয় না।'
উইকেন্ড ক্লাসের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিভাগগুলোর বাণিজ্যিকীকরণ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর অনেক মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। শিক্ষকরা ওই বাণিজ্যিক প্রোগ্রামগুলোর দিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। এটা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।'
উপাচার্য অধ্যাপক ড. নুরুল আলম বলেন, 'আমরা শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে ভাবছি। তবে, সারা দেশে চালু হলে আমাদের চালু করা সুবিধা হতো। আর শিক্ষকদের জবাবদিহি দরকার। আমি সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখার চেষ্টা করি, ডিনরা আমাকে তথ্য দেন। আশা করি সেশন জট শিগগির কাটাতে পারব।'
Comments