বিদেশে মাস্টার্স: আবেদনের জন্য যা করবেন
মাস্টার্স করতে দেশের বাইরে যাবেন কি না, তা একান্তই নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তবে, যদি ভিন্ন দেশে পড়াশুনার অভিজ্ঞতা পেতে চান বা পড়ার পরিবেশে পরিবর্তন চান, তাহলে মাস্টার্স করতে বিদেশে যাওয়া যেতেই পারে।
এর জন্য আপনার কাছে রয়েছে হাজারো বিকল্প। শুধু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এগোতে হবে। সঠিক নির্দেশনা এবং পর্যাপ্ত সময় দিলে এটা মোটেই অসম্ভব কিছু নয়।
সঠিক বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন
হাজারো বিকল্প আপনার সামনে থাকবে এবং একেকটির একেক রকমের সমস্যা থাকবে। ফলে, এটা বুঝে ওঠা কঠিন যে আবেদনের জন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়টি সঠিক হবে। সবচেয়ে জনপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানি, ইতালির মতো কিছু ইউরোপীয় দেশে।
নিজের পরিস্থিতি, আর্থিক সামর্থ্য, পড়াশুনার বিষয়, ভবিষ্যৎ চাকরির সম্ভাবনা এবং অগ্রাধিকারের ওপর নির্ভর করে ঠিক করতে হবে কোন দেশ বা অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয় আপনি নির্বাচন করবেন। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সবচেয়ে বেশি স্কলারশিপের ও আয়ের সুযোগ রয়েছে। আবার ইউরোপ সাংস্কৃতিকভাবে সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং সেখানে বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা পাবেন। এমনকি, এসব দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই সামান্য টিউশন ফি দিতে হয়, অনেক সময় কিছুই দিতে হয় না। কানাডায় যেতে চাইলে খুব সহজে ও দ্রুততম সময়ে পিআর পাওয়া যায়, কিন্তু আবহাওয়া একটি সমস্যার কারণ হতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া ভালো হলেও সেখানে স্কলারশিপ বা টিউশন ফি ছাড়ের মতো সুযোগ খুবই কম।
যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক গবেষণা বা শিক্ষকতা সহকারী হিসেবে পড়াশুনার অর্থ যোগাড়ের সুযোগ করে দেয়। যে বিষয়ে পড়াশুনার জন্য আবেদন করছেন, তার জন্য কেন্দ্রীয় তহবিল না থাকলে সেই অধ্যাপকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, যাদের গবেষণার বিষয় আপনার সঙ্গে মিলবে। তাহলেই স্নাতক গবেষণা বা শিক্ষকতা সহকারী হিসেবে কাজের সুযোগ পাওয়া সম্ভব।
কিছু ইউরোপীয় দেশে টিউশন ফি নেই বা খুবই কম ফি দিতে হয়। যাদের আর্থিক বিষয় নিয়ে চিন্তা রয়েছে তাদের জন্য এসব বিশ্ববিদ্যালয় সঠিক পছন্দ হতে পারে। জার্মানি, ইতালি ও অস্ট্রিয়ায় এসব বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যাবে। এমনকি, বিনা খরচে মাস্টার্স করার চেষ্টা করা যেতে পারে কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়েও।
স্থায়ী বসবাস বা পিআর পাওয়া লক্ষ্যের অংশ হয়, তাহলে কানাডার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেওয়া যেতে পারে। যদি যুক্তরাজ্য বা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে মাস্টার্স করতে চান, তাহলে ইরাসমাস মুন্ডাস, কমনওয়েলথ বা ডিএএডি বৃত্তির মাধ্যমে সুযোগ নেওয়া যেতে পারে।
দেশ বা অঞ্চল নির্বাচনের পর গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আপনি যে বিষয় নিয়ে মাস্টার্স করতে চান সেই অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে বের করা। বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করার সময় টিউশন ফি, আবহাওয়া, গবেষণার সুযোগ, চাকরির সুযোগ, পরিবহন, জীবনযাত্রার খরচ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
সঠিক সময়
যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রধানত উইন্টার ও ফল সেশনে আবেদন গ্রহণ করে। ফল সেশনের আবেদন আগের বছরের আগস্টে জমা নেওয়া শুরু হয়। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত তারা আবেদন গ্রহণ করে। অনেক সময় ফেব্রুয়ারি পর্যন্তও আবেদন জমা নেয়। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য ফল সেশনটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়। কারণ, এই সেশনের সময় বেশিরভাগ আর্থিক সুবিধা পাওয়ার সুযোগ থাকে।
উইন্টার সেশনের আবেদন আগের বছরের এপ্রিল দিকে জমা নেওয়া শুরু হয় এবং মে মাসের শেষ পর্যন্ত নেওয়া হয়। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় উইন্টার সেশনে সব কোর্স অফার করে না। কাজেই, আপনি যে বিষয়ে পড়তে চাচ্ছেন সেটি কোন সেশনে আছে, সে দিকেও নজর রাখতে হবে।
ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টাইমলাইন কিছুটা ভিন্ন। দেশ ভেদে এগুলো ভিন্ন হয়। এর ফলে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজ রাখাটাও একটু কঠিনই বটে। কিন্তু আপনি যদি ১০ থেকে ১২ মাস সময় নিয়ে শুরু করতে পারেন, তাহলে যে দেশেই যেতে চান না কেন, পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে যথেষ্ট সময় পাবেন।
বৃত্তি বা আর্থিক সুবিধার খোঁজ
আপনি যেখানেই আবেদন করেন বা যে ধরনের আর্থিক সুবিধাই পান না কেন, অনিবার্যভাবে পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ করতে বেশ বড় অংকের টাকা প্রয়োজন। আইইএলটিএস বা টোফেল বা জিআরই বা জিএমএটির মতো প্রয়োজনীয় পরীক্ষা দিতে যথেষ্ট টাকা খরচ হয়। কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর স্টাডি পারমিট বা ভিসা আবেদনের সময় আপনাকে আর্থিক সক্ষমতার প্রমাণও দিতে হবে।
সুতরাং, দেশ বা অঞ্চল ও বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দের ওপর নির্ভর করে অবশ্যই আগে থেকে আর্থিক প্রস্তুতি নিতে হবে। যদি পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় খরচ আপনি নিজে বহন করতে না পারেন, তাহলে পরিবারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে এবং তারা কতটা সহযোগিতা করতে পারবে সেটা জেনে সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পরীক্ষা
বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন প্রক্রিয়ায় অন্তত একটি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। সেটা আইইএলটিএস বা টোফেলের মতো ইংরেজি ভাষার দক্ষতার পরীক্ষাও হতে পারে। এ ছাড়া, কিছু কোর্সের জন্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের জিআরই বা জিএমএটি পরীক্ষা দিতে হয়।
এ ধরনের পরীক্ষা বছরে মাত্র কয়েকবার হয়। সেই হিসাব করে এসব পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। পরীক্ষা দিতে চাইলে অন্তত এক মাস আগে এর জন্য রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের আগে এর ফলাফল পেতে হবে।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত
যেকোনো কোর্সের আবেদনের জন্য কিছু কাগজপত্র প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে রয়েছে ট্রান্সক্রিপ্ট, মূল সনদপত্র, মার্কশিট। সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন, সেখান থেকে এগুলো সংগ্রহ করতে হবে।
অধ্যাপক, নিয়োগকর্তা বা তত্ত্বাবধায়কের কাছ থেকে সুপারিশপত্রের প্রয়োজন হতে পারে। সুপারিশপত্রের জন্য এমন কাউকে বেছে নেওয়া উচিৎ, যার সঙ্গে আপনার চমৎকার পেশাদার বা অ্যাকাডেমিক সম্পর্ক আছে এবং যিনি আপনার কাজ সম্পর্কে জানেন। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় সুপারিশকারীকে একটি লিংক পাঠায়, যেখানে তারা সুপারিশপত্র জমা দিতে পারেন।
আবেদন করা ও বিশ্ববিদ্যালয় লিংক পাঠানোর আগে সুপারিশকারীকে এই বিষয়ে জানিয়ে রাখতে হবে। যদি তিনি এ বিষয়ে সম্মত হন, তবেই তার নাম সুপারিশকারী হিসেবে বেছে নিতে পারেন। যাকে সুপারিশকারীর করতে চান, তার কর্মক্ষেত্রের অফিসিয়াল ইমেইল থাকলে সবচেয়ে ভালো হবে। কারণ, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যক্তিগত ইমেইল আইডির মাধ্যমে পাঠানো সুপারিশপত্র অনেক সময়ই গ্রহণ করে না।
এর পাশাপাশি একটি সিভি বা জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে হতে পারে। অ্যাকাডেমিক সিভি নিয়মিত সিভি থেকে আলাদা হয় এবং অঞ্চল ভেদে এর ভিন্ন ফরমেট থাকতে পারে। আবেদন জমা দেওয়ার আগে সেই অনুযায়ী সিভি প্রস্তুত করতে হবে।
প্রবন্ধ বা স্টেটমেন্ট
আবেদন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে স্টেটমেন্ট অব পারপাস (এসওপি), রিসার্চ স্টেটমেন্ট কিংবা কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতে হতে পারে। আপনার ব্যক্তিগত, পেশাদার ও অ্যাকাডেমিক অভিজ্ঞতাকে কীভাবে আবেদনকৃত কোর্সে ব্যবহার করে ভবিষ্যৎ লক্ষ্য পূরণ করতে চান, তা নিয়ে লিখতে হয় এসওপি। রিসার্চ স্টেটমেন্ট সাধারণত পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য। তারপরও কিছু থিসিসভিত্তিক মাস্টার্স প্রোগ্রামে আপনার গবেষণার উদ্দেশ্য, বিষয়সহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে রিসার্চ স্টেটমেন্ট চাইতে পারে।
মনে রাখতে হবে, এই ক্ষেত্রে কোনোভাবেই অন্য কারো কাজের নকল করা যাবে না। অর্থের বিনিময়ে অন্য কাউকে দিয়ে এগুলো তৈরি করে নেওয়াও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কারণ পেশাদার এসওপি বা রিসার্চ স্টেটমেন্ট লেখকরা এগুলো নিজেরাও লিখতে পারেন কিংবা অন্য কোথাও থেকে কপি-পেস্টও করতে পারেন। অনলাইনে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটগুলোতে নমুনা নথি বা ওয়েবসাইটের লিংক আছে, যেখান থেকে আপনি প্রবন্ধ বা স্টেটমেন্ট লেখার বিষয়ে সহযোগিতা পেতে পারেন।
আবেদনপত্র জমা
বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন, সব কাগজপত্র সংগ্রহ ও পরীক্ষার শেষে আবেদন করতে হবে। এর জন্য বিদেশি মুদ্রায় অর্থ পাঠাতে পারবেন এমন একটি ক্রেডিট কার্ড প্রয়োজন হবে। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব সহজে নেভিগেট করা যায় এমন অনলাইন আবেদনের ব্যবস্থা রয়েছে। আবেদন জমা দেওয়ার পর নিয়মিত ইমেইল দেখতে হবে।
প্রতিটি ধাপ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারলে বিদেশের কোনো স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় আপনার অপেক্ষায় থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তারপরও, সাফল্য কখনোই নিশ্চিত করা যায় না। মনে রাখা দরকার, যদি একটি স্বপ্ন পূরণ না হয়, তাহলে নতুন স্বপ্ন দেখতেই পারি।
তাজরীন জাহান বারী; [email protected]
অনুবাদ করেছেন কেএম সজল
Comments