বছরে ৫ মাস পানিবন্দী থাকে গাজনার বিলের ৩ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

অথৈ পানিতে নিজেরাই নৌকা চালিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যাতায়াত করছে সুজানগর উপজেলার শারির ভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়, বস্তাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পাইকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী।

ঋতুচক্রের পরিক্রমায় বর্ষা শেষ হয়ে গেলেও বর্ষার পানিতে থৈ থৈ করছে পাবনার সুজানগর উপজেলার বিস্তীর্ণ গাজনার বিল। বিলের অথৈ পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আধুনিক সুসজ্জিত এসব স্কুল ভবনের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বর্ষার পানি।

অথৈ পানিতে নিজেরাই নৌকা চালিয়ে বিশাল বিলের পথ পেরিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যাতায়াত করছে সুজানগর উপজেলার শারির ভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়, বস্তাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পাইকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৫ শতাধিক ছাত্রছাত্রী।

সরেজমিনে এসব স্কুল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, স্কুলের নিচে সাইকেলের পরিবর্তে বাধা রয়েছে নৌকা। বিশাল বিলের পথ পেরিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে অনেক সময় নৌকা থেকে পড়ে যায় শিক্ষার্থীরা, ভিজে যায় পরনের কাপড়, নষ্ট হয় বই-খাতা। অনেকেই ভেজা কাপড়েই ক্লাসে আসে, অনেক সময় আবার বাড়িতেও ফিরে যেতে হয়।

এভাবেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করায় এসব ছাত্রছাত্রীর পরিবার প্রতিনিয়ত থাকছে দুশ্চিন্তার মধ্যে।

বস্তাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী আরিফা খাতুন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গত মাসে বাড়ির কাছে খেলার সময় তার ছোট বোন পানিতে ডুবে যাওয়ার পর থেকে তার পরিবার তাকে একা ছাড়তে ভয় পায়।

আরিফার নিজের কোনো নৌকা নেই, সে অন্যদের সঙ্গে নৌকায় চড়ে স্কুলে আসে। বেশিরভাগ সময় পরিবারের কেউ তাকে দিয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত সে বাড়িতে না ফেরে ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবারের সবাই তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন বলে সে জানায়।

একই স্কুলের আরেক ছাত্রী রিয়া খাতুন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তার নিজের নৌকা না থাকায় নৌকা ভাড়া করে তাকে স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। এ জন্য দরিদ্র পরিবারের প্রতি মাসে বেশ কিছু টাকা ব্যয় হয়। তারওপর সময় মতো নৌকা না পেলে স্কুলে পৌঁছাতে পারে না।

বস্তাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মমিন উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিতে আধুনিক দ্বিতল সুসজ্জিত ভবন থাকলেও স্কুলে আশানুরূপ শিক্ষার্থী নেই। মাত্র ৬৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুল চালাতে হচ্ছে তাকে, প্রতিদিন প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকায় স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলেও জানান প্রধান শিক্ষক।

স্কুলটিতে যাতায়াতের সু-ব্যবস্থা না থাকায় এবং বছরের ৫ মাসের বেশি সময় পানিবন্দী হয়ে থাকায় এ স্কুলে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করতে আগ্রহী হয় না বেশিরভাগ অভিভাবক। শুধু বস্তাল এলাকার গুটি কয়েক পরিবার ছাড়া আশেপাশের এলাকা থেকে কোনো শিক্ষার্থী সেখানে ভর্তি হয় না বলে জানান প্রধান শিক্ষক।

সম্প্রতিকালে সরেজমিন শারির ভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করে দেখা গেছে ভেজা কাপড় নিয়েই শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করছে অনেক ছাত্র ছাত্রী। কথা বলে জানা গেছে, স্কুলে আসার পথে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় ভিজে যায় তারা।

শারির ভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র রোহিত খান দ্য ডেইলি স্টারকে জানায়, নৌকা নিয়ে স্কুলে আসা যাওয়ার পথে অনেক সময় বৃষ্টির মধ্যে পড়তে হয়, আবার অনেক সময় বিলের মধ্যে নৌকা উল্টে যায়, সে সময় পুরোপুরি ভিজে যায় তারা। নৌকা উল্টে গেলে কাপড় চোপড়ের সঙ্গে বই পুস্তক ভিজে নষ্ট হয়ে যায়।

তবে এসব শিক্ষার্থীরা সাঁতার জানে বলে নৌকা ডুবে গেলেও বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয় না বলে জানায় স্কুলের শিক্ষকেরা।

শারির ভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানকার শিক্ষার্থীরা সবাই সাঁতার জানে, ফলে নৌকা চালাতে গিয়ে পড়ে গেলেও বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয় না, তবে বই খাতা সব নষ্ট হয়ে যায় তাদের।'

শুধু শিক্ষার্থী নয় শিক্ষকরাও সময়মতো স্কুলে পৌঁছাতে পারে না। স্কুলের শিক্ষিকা কাজী ফাহমিদা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিদিন দূর থেকে স্কুলে আসার জন্য বিলের পাড়ে দীর্ঘক্ষণ নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। সময়মতো নৌকা না পেলে স্কুলে পৌঁছাতে দেরি হয়।'

শারির ভিটা স্কুলের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম বলেন, 'গাজনার বিলে প্রতিবছর পাঁচ মাসের বেশি সময় পানির নিচে থাকে এ সময় স্কুল পানিবন্দী থাকায় দুর্ভোগ নিত্যসঙ্গী তাদের।'

পানিবন্দী এসব স্কুলে যাতায়াতের দুর্ভোগের কারণে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। বেশিরভাগ সময় অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী স্কুলে না আসায় শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

পানিবন্দী স্কুলের শিক্ষক আশরাফুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুধু যাতায়াতের দুর্ভোগই নয় বরং স্কুলে নেই খেলার কোনো পরিবেশ। স্কুলের মাঠ বছরের ৬ মাস পানিবন্দী থাকে আর পানি নেমে যাওয়ার পর ওই মাঠে খেলা দুষ্কর। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছে পানিবন্দী স্কুলের শিক্ষার্থীরা। 

পানিবন্দী এসব স্কুলে যাতায়াতের জন্য সরকারি উদ্যোগে নৌকার ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছে শিক্ষক ও অভিভাবকরা। সরকারি উদ্যোগে নৌকার ব্যবস্থা করা হলে বর্ষার সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুব্যবস্থা হবে বলে মনে করেন শারির ভিটা ও বস্তাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকেরা।

প্রাকৃতিক কারণে গাজনার বিলের দুর্গম এসব স্কুলের সমস্যা এখনই সমাধান করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সুজানগর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল জব্বার।

তিনি জানান, সঠিকভাবে পাঠদান করার জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতন করে তোলা হচ্ছে। পানিবন্দী এসব স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের চলাচল সহজতর করতে নৌকার প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেলে নৌকার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি। 

 

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

6h ago