আমাদের পক্ষে কি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব?

সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ‘গণতন্ত্রের বিকাশে’ সবগুলো রাজনৈতিক দলকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন। নাম উল্লেখ না করলেও তিনি মূলত বিএনপির উদ্দেশেই এমন বক্তব্য দিয়েছেন। কারণ, দলটি বর্তমান ব্যবস্থায় কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে জানিয়েছে। তাদের দাবি, একটি নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।

সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) 'গণতন্ত্রের বিকাশে' সবগুলো রাজনৈতিক দলকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন। নাম উল্লেখ না করলেও তিনি মূলত বিএনপির উদ্দেশেই এমন বক্তব্য দিয়েছেন। কারণ, দলটি বর্তমান ব্যবস্থায় কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে জানিয়েছে। তাদের দাবি, একটি নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।

আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সবশেষ নির্বাচন বয়কট করা বিএনপির জন্য ছিল সাংঘাতিক এক ভুলের গোড়াপত্তন। যা তাদের বর্তমান অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে তারা কী শিখেছে, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

আমরা একদিকে যেমন কোনো রাজনৈতিক দলের জাতীয় নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নই, অন্যদিকে এটাও অস্বীকারের কোনো উপায় নেই যে, বিগত দুটি নির্বাচনে গুরুতর অনিয়ম হয়েছে। এ ছাড়া কারচুপি, ভীতি প্রদর্শন, অর্থ ও পেশীশক্তির ব্যবহার, আগের রাতে ভোট এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সরকারি সংস্থার অযাচিত হস্তক্ষেপের বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ সবার সামনে উঠে এসেছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নির্বাচন ডিএনএর মতো। নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া তারা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে এবং একসময় তারা অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ে। একটি রাজনৈতিক দল অধীর আগ্রহে নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করে, কারণ তারা জানে, শুধু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমেই তাদের ক্ষমতায় আসার কিছুটা সম্ভাবনা থাকে। আর কিছু না হোক, তারা অন্তত এর মাধ্যমে মানুষের হৃদয় ও মনে জায়গা করে নিতে পারে। সুতরাং, যখন একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, বিএনপি আবারও যেমনটা করার কথা ভাবছে, তখন আমাদের এর কারণ বিশ্লেষণ করতে হবে এবং ভেবে দেখতে হবে কোনো মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কি না।

সব গণতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচন হয়, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এটিকে প্রায় অসম্ভব একটি কাজে পরিণত করেছি। আমাদের নির্বাচনগুলো কেন বিতর্কে ভরা? কেন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আমাদের মাঝে এত তিক্ততা? আমাদের প্রতিবেশী, যারা বেশ কয়েক মাস ধরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্বাচনের আয়োজন করে, তাদের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে কখনো কোনো ধরনের বিতর্ক দেখা দেয় না বললেই চলে। কোনো রাজনৈতিক দল, এমন কি কংগ্রেসের মতো দল, যারা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রাজ্য নির্বাচনে প্রায় ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে, তারাও নির্বাচন কমিশনের দিকে কখনো অভিযোগের আঙ্গুল তোলে না।

বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাহলে বিষয়টি আমাদের ক্ষেত্রে কেন এত ঝামেলাপূর্ণ? সবার বিশ্বাস, ক্ষমতাসীন দল আমাদের নির্বাচনগুলোতে কারসাজি করে। নির্বাচন নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রক্রিয়াটি কি সফল হয়েছিল?

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল, তখন তারাই কার্যকর আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, রাজনৈতিক সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় (১৯৯১ সালের নির্বাচনের আয়োজন করে একটি 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকার')। সবশেষ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল। (যদি ২০০৮ সালের নির্বাচন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের অধীনে অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে খুব সম্ভবত আওয়ামী লীগ জিততেই পারতো না। কারণ ৮ কোটি ১১ লাখ ভোটারের তালিকা থেকে পরবর্তীতে ১ কোটি ২০ লাখ ভুয়া ভোটার বাদ দেওয়া হয়।)

এই নির্বাচনগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য ছিল বহুসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি, তুলনামূলকভাবে পেশীশক্তির কম ব্যবহার, কারচুপি ও ভুয়া ভোটের অভিযোগ কম আসা এবং সার্বিকভাবে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সহিংসতা না হওয়া। পরাজিত দলের প্রথমদিকের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বাদ দিলে, সব অংশগ্রহণকারী দল ফলাফল মেনে নেয় এবং তাদের নিজ ভূমিকা সুষ্ঠুভাবে পালন করে। এই নির্বাচনগুলো তুলনামূলকভাবে মুক্ত ও নিরপেক্ষ ছিল এবং বৈশ্বিক মানদণ্ড রক্ষা করে আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিল।

কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজিত নির্বাচনগুলো বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে? এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে, সে সময়ের সরকার, অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারগুলো এ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। এ ক্ষেত্রে, ১৯৯৪-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলনকারী আওয়ামী লীগের দেওয়া মূল যুক্তি— 'রাজনৈতিক সরকারের অধীনে আয়োজিত নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে পারে না' এখন দৈববাণী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি 'সংক্ষিপ্ত রায়ের' ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নাম মুছে দেয়। এমন কী তারা এ ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ, লিখিত রায়ের জন্যও অপেক্ষা করেনি, যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে আরও ২ মেয়াদ পর্যন্ত চালু রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল। মূলত এরপর থেকেই জনমনে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিতে শুরু করে। এর আগে শুধু পরাজিত দলগুলোই এ ধরনের প্রশ্ন তুলতো।

২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য 'বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায়' নির্বাচিত হন। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সবগুলো নির্বাচনে, সবগুলো আসনে একাধিক প্রার্থী থাকলেও এ নির্বাচনে ১৫৩ আসনে শুধু একজন করেই প্রার্থী ছিলেন। বিশ্বাসযোগ্য করতে কষ্ট হলেও এমনটাই ঘটেছে। এত সংখ্যক সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে আইনের দৃষ্টিতে 'বৈধ' ছিল, কিন্তু পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে এটি প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। তবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) একে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেনি। সংস্থাটির আজ্ঞাবহ মনোভাব তার সুনাম ধ্বংস করেছে।

২০১৮ সালের নির্বাচন নির্ধারিত দিনে ভোটগ্রহণের চেয়ে আগের রাতের 'ভোটগ্রহণের' জন্য বেশি পরিচিতি পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইসির নীরবতা আরও বড় আকারে তাদের সুনাম ধ্বংস করেছে।

নতুন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল এবং নির্বাচন কমিশনারদের এই সংস্থার সুনাম পুনরুদ্ধারে পর্বতসম কাজে নিয়োজিত হতে হচ্ছে, যার বিশ্বাসযোগ্যতা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। তবে এখানেও এ টি এম শামসুল হুদার (২০০৭-২০১২) নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের ইতিহাস রয়েছে। যেটি গত ২ কমিশনের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের মাঝে উজ্জ্বল তারার মতো জ্বলজ্বল করছে।

(দৈবক্রমে, আমার সঙ্গে গত মার্চে জয়পুর সাহিত্য উৎসবে ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাভিন চাওলার দেখা হয়েছিল, যিনি ২০০৯ সালে ভারতের ১৫তম লোকসভা নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তার বই 'এভরি ভোট কাউন্টস: দ্য স্টোরি অব ইন্ডিয়াস ইলেকশনস' বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাকে জানান, সিইসি শামসুল হুদা সার্কভুক্ত দেশগুলোর তৎকালীন সিইসিদের মধ্যে একজন তারকা হিসেবে বিবেচিত এবং তিনি (নাভিন)-সহ অন্যান্য সব দেশের সিইসিরা তার দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের জন্য তাকে শ্রদ্ধা করতেন। গর্বে আমার বুক ভরে ওঠে এবং আমি মনে মনে সবশেষ সিইসি নুরুল হুদার সঙ্গে তুলনা করি। যিনি ভেবেছিলেন রাশিয়া গিয়ে সরেজমিনে নির্বাচন পরিদর্শন করা প্রয়োজন। তিনি নিঃসন্দেহে সেখান থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন, যা পরবর্তীতে স্পষ্ট হয়েছে)

শামসুল হুদা কমিশনের এক সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন নিয়ে ৩টি মূল্যবান বই লিখেছেন। নতুন সিইসি এবং অন্যান্য কমিশনাররা এই বইগুলো থেকে অনেক কিছু শিখতে পারেন।

সবশেষ সংবাদ অনুযায়ী, সিইসি আউয়াল তার ওপর অর্পিত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব সবচেয়ে ভালোভাবে পালনের জন্য বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলোচনা করে মতামত সংগ্রহ করছেন। আমরা তার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই, কিন্তু আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, এসব আলোচনা এবং উপদেশ-সুপারিশের আতিশয্য তাকে খুব একটা সহায়তা করতে পারবে না। তিনি যা শুনছেন, তা তিনি ইতোমধ্যে জানেন—অন্তত তার জানা উচিৎ, যেমনটা আমরা সবাই জানি। কেননা, আমরা সবাই বিগত ২টি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গেছি।

এর পরিবর্তে তার যেটা করা উচিৎ তা হলো, বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি, অথবা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে সরকারের সঙ্গে কথা বলা। যাতে তিনি জানতে পারেন তার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ঠিক কতটুকু স্বাধীনতা তিনি পাবেন। তাকে কী যথেষ্ট পরিমাণ উপকরণ, জনবল ও স্বাধীনতা দেওয়া হবে, যাতে তিনি তার পছন্দের ব্যক্তিদের তার কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ পান? তিনি কি প্রকৃতপক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষমতা পাবেন, যে ক্ষমতা তাকে এবং তার অধীনে থাকা কমিশনকে সংশ্লিষ্ট আইনগুলো দিয়েছে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সহায়তা প্রদানকারী জেলা প্রশাসন ও পুলিশের মতো প্রশাসনিক সংস্থাগুলো কি কার্যত ইসির কর্তৃত্বাধীন থাকবে, নাকি এ বিষয়টি শুধুই নামসর্বস্ব হবে?

নিঃসন্দেহে বলা যায়, সরকারকে যেটাই জিজ্ঞেস করা হোক না কেন, উত্তর আসবে 'হ্যাঁ'। নির্বাচনের দিনের কার্যক্রমের মাধ্যমে এর প্রকৃত পরীক্ষা হবে। তবে ততদিনে নির্বাচন কমিশনের আর কিছু করার সুযোগ থাকবে না।

আরেকটি সমপরিমাণে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, যদি আমি সরাসরিই বিষয়টি বলি—সিইসি এবং অন্য কমিশনারদের কি যথেষ্ট পরিমাণ সদিচ্ছা ও সাহস আছে আইন অনুযায়ী কাজ করার, যে আইন তাদেরকে এতটা ক্ষমতা দিয়েছে?

তবে এ ক্ষেত্রে আরও সহজ একটি বিকল্প রয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা আছেন, তাদেরকে আমরা সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারি, 'আপনারা কি একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চান?' যদি উত্তর হয় 'হ্যাঁ', তাহলে ইসির কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু এটি যদি একটি জনসংযোগমূলক বার্তা হিসেবে দেওয়া 'হ্যাঁ' হয়, তাহলে ইসি যাই করুক না কেন, এতে প্রত্যাশিত ফল আসবে না। সুতরাং জনগণের মতামত চাওয়া, তা কাগজে-কলমে যতই ভালো শোনাক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তা তেমন কোন গুরুত্ব বহন করে না।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments