চিত্রাপারের কান্না থামাতে কী করছি আমরা
চিত্রা নদীর পারে এখন বিরাজ করছে ভয়, আতঙ্ক আর অজানা শঙ্কা। কাঁদছে চিত্রাপারের মানুষ-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। কাঁদছে বিবেক-মানবতাবাদী মন-প্রগতিপন্থায় সমর্পিত হৃদয়। এই কান্না, বেদনা ও দুঃখ লাঘব করার জন্য কাজ করছে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যদিও সেটা ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর। এ দেশে 'ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যান'। আর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার পর নড়েচড়ে বসেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনীতিক ও প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট সব মহল।
প্রশ্ন হলো, চিত্রাপারের কান্না স্থায়ীভাবে থামাতে, কান্নার ঘটনা কোনোভাবেই যেন সংঘটিত হতে না পারে তার জন্য দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই ব্যবস্থা হিসেবে কী করেছি আমরা? রামু থেকে নাসিরনগর হয়ে নড়াইল, ধর্ম অবমাননার অভিযোগে এই সব হামলা থেকে শিক্ষা নিয়ে কী করেছেন রাষ্ট্র-সমাজ-রাজনীতি ও সংস্কৃতির নীতিনির্ধারকরা। কী করেছেন আমাদের লেখক-কবি-সাংবাদিক-অধ্যাপক-আইনজীবী, সর্বোপরি আমাদের বুদ্ধিজীবী-বিদ্বৎ ও সুশীল সমাজ। কী করা হয়েছে স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে? এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে যে চিত্র মেলে, তা আশাব্যাঞ্জক তো নয়ই, উপরন্তু অনেক বেশি হতাশা, বেদনা ও লজ্জার।
ফেসবুকে দেওয়া একটা পোস্টের জের ধরে নড়াইলের লোহাগড়ায় যে ঘটনা ঘটেছে, সেই কলঙ্ক সহসা মোচন হওয়ার নয়। এর ভেতর দিয়ে সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের শেকড় ধরে যে টান দেওয়া হয়েছে, তার ক্ষত থাকবে আজীবন-বছরের পর বছর। শুক্রবারের ওই ঘটনা- ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ কেবলই অজুহাত, নাকি পেছনে রয়েছে অন্য কারণ তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। অবশ্য এ ধরনের ঘটনায় প্রকৃত কারণ নির্ণয় হওয়ার নজির যেমন নেই, তেমনি বিচারের মধ্য দিয়ে কারও শাস্তিই নিশ্চিত করা যায়নি আজ অবধি। ফলে ঘটনার ক্ষত যতক্ষণ জিয়ন্ত, ততক্ষণই নানা প্রকারের আলোচনা ও তোড়জোড়। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, কোনো ঘটনা থেকেই শিক্ষা নেওয়া হয় না এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য নেওয়া হয় না টেকসই কোনো উদ্যোগ।
চিত্রাপারের মানুষের চিত্রা নদীকে নিয়ে, নড়াইলকে নিয়ে কত গর্ব-কত অহংকার। কিছুদিন পরপর সেসব ধুলায় মিশে যায় কতিপয় মানুষের কারণে। যেমনটা আমরা দেখেছিলাম- তানভীর মোকাম্মেলের চলচ্চিত্র 'চিত্রা নদীর পারে'-তে। অসম্ভব বেদনা ও লজ্জার যে, সেদিনের সেই বাস্তবতা থেকে আজও আমরা মুক্ত হতে পারিনি। স্বাধীন-সার্বভৌম একটা দেশকে সব মানুষের নিরাপদ বাসযোগ্যরূপে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। চলচ্চিত্রের দৃশ্য আর বাস্তবতা আজ এক হয়ে গেছে। শশীকান্ত উকিলের সে কী ইচ্ছে এই দেশে থেকে যাওয়ার জন্য। প্রতিবেশীদের প্রায় সবাই চলে গেলেও মনের জোরে থেকে যান তিনি। কিন্তু না, তাকে বাঁচতে দেওয়া হয়নি। প্রতি পদে পদে অপমান-উপেক্ষা আর রাতের অন্ধকারে বাড়িতে ঢিল ছুঁড়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার সব পথ। দৃশ্যত স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও নীরব লাঞ্ছনা-যন্ত্রণা সম্পাদন করে তার মৃত্যুর সব আয়োজন। শশীকান্ত মারা গেলে ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যান মিনতি ও তার পিসি। বর্ডার পার হওয়ার কালে পিসির জিজ্ঞাসা, 'কী হয়ে গেল-রে মিনতি?'
পুড়ে যাওয়া ভিটেমাটির দিকে তাকিয়ে কান্নারত দীপালি সাহার ছবিও যেন একই কথা বলে উঠে। শশীকান্তর বাড়ির নাম 'পান্থনীড়', প্রতিষ্ঠা ১৩২৭। এখন চলছে বঙ্গাব্দ ১৪২৯। একশ বছরেরও বেশি ব্যবধান। অথচ দীর্ঘ পথ পরিক্রমাতেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটলো না। তখন না হয় শাসন ক্ষমতায় ছিল ব্রিটিশ-পাকিস্তানের মতো পরদেশীয় শাসক। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে তো আমাদের দেশ আমরাই শাসন করছি, তবুও কেন এ দেশ সংখ্যালঘুর নিরাপদ বাসস্থান হয়ে উঠছে না। কেন আমরা ব্যর্থ হচ্ছি তিস্তাপারের কান্না থামাতে। এই প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে রাজনীতির ভেতর, পুরো বিষয়টাই রাজনৈতিক।
'চিত্রা নদীর পারে' যে সময়কালকে সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দি করেছে, সেটা আইয়ুবের সময়কাল। রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন ঘোলাটে মারমুখী এবং গভীর সংকটে পড়ে ঘূর্ণায়মান এক অচলায়তনে বন্দি। সারাদেশ ফুঁসে ওঠেছে গণতন্ত্রের জন্য, আইয়ুবকে হঠানোর জন্য। গণতন্ত্র এলে আইয়ুব গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে, সংখ্যালঘুরা নিজভূমে নিরাপদবোধ করবেন, আমাদের দেশ আমরাই শাসন করবো। বিচারক-আমলা-প্রশাসক-পুলিশ যেহেতু আমাদের মধ্যে থেকেই হবে। ফলে সব কিছুতেই ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে। আইনের শাসন মিলবে। শিক্ষা-দীক্ষায়-জ্ঞানে-বিজ্ঞানে আমরা উন্নত রুচির-মানবিক মানুষ হয়ে উঠবো। কুসংস্কার দূর হবে-ধর্মীয় গোঁড়ামির শেকড় উপড়ে ফেলে তৈরি হবে অসাম্প্রদায়িক এক দেশ। যার মূলমন্ত্র হবে হবে সাম্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সহাবস্থান। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে প্রাণ দিলো চিত্রাপারের সন্তান বাদল-মিনতিদের প্রতিবেশী-বন্ধু। আইয়ুব গেল, মাথার ওপরের ছবি বদলে নতুন ছবিই শুধু এলো না, দেশ স্বাধীনও হলো। কিন্তু চিত্রাপারে শান্তি এলো না। চিত্রাপারের কান্না স্থায়ীভাবে দূর করার জন্য নেওয়া হলো না টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী কোন উদ্যোগ।
ভারতীয় উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক ঘটনা কালের বিচারে দীর্ঘদিনের নয়। ব্রিটিশের ভেদবুদ্ধিজনিত নীতিই এ অঞ্চলে রোপণ করে সম্প্রদায়গত বিভাজন ও দাঙ্গাজনিত বিষবৃক্ষের বীজ। ব্রিটিশ বেনিয়ারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল ও ঔপনিবেশিক শাসন চিরস্থায়ী ও পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে, ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দু ও মুসলমানের বিভেদকে স্থায়ীভাবে উসকিয়ে রাখে। ব্রিটিশের দেখানো পথে হাঁটে পাকিস্তানও, তারাও মানুষকে মানুষে হিসেবে না দেখে হিন্দু ও মুসলমানের নিরিখে বিচার ও বিভাজনের নীতি গ্রহণ করে। এ কারণে পাকিস্তানের শাসনের ২ যুগে একেরপর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। আইয়ুবী শাসনের মাঝামাঝি সময়ে কাশ্মীরের হযরতবাল মসজিদের একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশেও সংঘটিত হয় ভয়াবহ এক দাঙ্গা। যার বিস্তার ঘটে চিত্রাপারেও। মিনতিরা দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় এসময়ই।
নড়াইলে সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে, পরাধীন দেশে এ ঘটনা ঘটলেও হয়তো তা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু স্বাধীন দেশে যখন এ ঘটনা ঘটে এবং সেই পুরনো কায়দায়, যা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের সময়ে, পাকিস্তানের ২ যুগের শাসনকালে- স্বৈরশাসক আইয়ুবের শাসন নীতির অঙ্গুলি হেলনে। সেই করুণ বাস্তবতা-লজ্জাকর অধ্যায় যদি এখনো রচিত হয়, তাহলে দীপালি সাহাদের সান্ত্বনার জায়গা কোথায়? আমরা কি ভুলে যেতে বসেছি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই পোস্টার, 'বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি'।
ভিটেমাটি পুড়ে যাওয়া ও চোখের সামনে সেই দৃশ্য দেখা এবং প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়ানোর ঘটনা যে কতোটা বেদনার-হৃদয়বিদারী ও মর্মান্তিক তা ভুক্তভোগী ব্যক্তি ছাড়া অন্যের পক্ষে কল্পনা করা দুরূহ নয় কেবল, অসম্ভবও বটে। মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতা। শেক্সপিয়ার এ কারণেই বোধকরি বলেছিলেন, 'মৃত্যুর চেয়ে ভয়ঙ্কর হলো জীবন, কেননা দুঃখ-কষ্ট-বিপদ-আপদ জীবনেই ভোগ করতে হয়, আর মৃত্যু তা থেকে মুক্তি দেয়'। শেক্সপিয়ারের এই উপলব্ধি এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ অক্ষরে অক্ষরে বোঝে, হাড়ে হাড়ে টের পায়। শুধু হামলা-আক্রমণের ঘটনা নয়, কতোভাবে যে তাদেরকে নিপীড়ন করা হয় তার তল খুঁজে পাওয়া যাবে না। শশীকান্তর ছোট ছেলেটা যে দেশ থেকে একেবারে চলে গেল, তার কারণ তো ওর বাবাকে 'মালাউন' বলেছিল বলে। আমরা কি এই সব শব্দ ব্যবহার ও প্রয়োগের সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছি? যদি না পারি তাহলে মনে রাখতে হবে, এ দেশের সংখ্যালঘুদের দৃশ্যমান আক্রমণগুলো তো আমরা গণমাধ্যমের বদৌলতে দেখতে পাই, কিন্তু অদৃশ্যমান আক্রমণগুলোও অনেক বেশি যন্ত্রণা ও লজ্জার।
সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা মাঝে মাঝে সংঘটিত হলেও এটা বন্ধে কোনো দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের বালাই নেই। ফলে ধর্ম অবমাননার নামে এ ঘটনা ঘটছেই কেবল, অথচ কোনো ঘটনা থেকেই আমরা কোন ধরনের শিক্ষা নিচ্ছি না, প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছি না। প্রত্যেকটি ঘটনাতেই 'ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যাওয়ার' ঘটনা ঘটছে। ঘটনা ঘটার আগে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে না।
স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই যে ঘটনার ক্ষত আমরা বহন করে চলেছি। স্বাধীনতার পর কেন সেই ক্ষত দূর করার জন্য কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হলো না। এই প্রশ্নের উত্তর গত ৫০ বছরে যারা শাসন ক্ষমতায় ছিলেন এবং ক্ষমতা বলয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নানা সুযোগ-সুবিধা ও পদ-পদবী-উপঢৌকনের বদৌলতে তারা ভালো দিতে পারবেন। কিন্তু তারা যে সদর্থক অর্থে ইতিবাচক কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেননি, সেটা স্পষ্ট। রামুর ঘটনা, নাসিরনগরের ঘটনা আমাদের কাছে এখনো জীবন্ত, অবশ্য এই ধরনের ঘটনার প্রতিটিই জীবন্ত। কেননা, এটা এমন এক ক্ষত যা কোনোদিন উপশম হওয়ার নয়, হয়তো সময় পরিক্রমায় তাতে প্রলেপ পড়ে কিন্তু ভেতরের ক্ষত ঠিকই থেকে যায়।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় এবং সব ধর্ম-মত-বর্ণ-শ্রেণি পেশার মানুষের নিরাপদ সহাবস্থানের লক্ষ্যে কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন আশু প্রয়োজন। এগুলো হলো:
এক. পাঠ্যপুস্তকে এতদ্বিষয়ক লেখালেখি সংযুক্ত করা। প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রমে এ সংক্রান্ত লেখালেখি আবশ্যক পাঠ হিসেবে অন্তর্ভূক্তপূর্বক গুরুত্বের সঙ্গে পাঠদান করা।
দুই. প্রতিটি গ্রামে-নিদেনপক্ষে প্রতি ওয়ার্ডে সরকারিভাবে পাঠাগারের ব্যবস্থা করা এবং এ সম্পর্কিত বইপত্র পাঠের ব্যবস্থা করা। প্রতিটি শিক্ষার্থীর শ্রেণিকক্ষের পাঠের সঙ্গে পাঠাগার পাঠকে যুক্ত করা।
তিন. রাজধানী ঢাকাসহ সব জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন-ওয়ার্ড-গ্রামে ক্লাবভিত্তিক সংস্কৃতি চর্চার ব্যবস্থা করা। যাত্রাপালা থেকে শুরু করে সব ধরনের সংস্কৃতি চর্চাকে উৎসাহিত করা। যাত্রাপালায় কিংবা সংস্কৃতি চর্চায় অসামাজিক কিংবা আইনবিরুদ্ধ কাজ হচ্ছে এই অভিযোগ এনে এগুলোকে বন্ধ করা যাবে না। যদি এরকম কিছু অভিযোগ থাকে তাহলে তা দূর করার কাজ করতে হবে, কিন্তু কোনোভাবেই বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। প্রশাসনের চ্যালেঞ্জ হলো সেটাকে চালু রাখা বন্ধ করা নয়।
চার. সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পাঠ নিশ্চিত করতে হবে। প্রার্থনালয়গুলোতে এসব বয়ান যেন প্রতিনিয়ত চর্চা হয় তার জন্য নির্দেশনা জারির পাশাপাশি তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে।
পাঁচ. সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষায় সরকারের ব্যবস্থাসমূহ গণমাধ্যমসহ সব উপায়ে সর্বস্তরের জনগণের মাঝে জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
ছয়. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীর এবং বিনষ্টকারীদের শাস্তি কী কী তাও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে হবে এবং এ ধরনের ঘটনাসমূহের বিচার দ্রুত করার ব্যবস্থা করতে হবে।
সাত. সরকারি-বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত সব প্রতিষ্ঠানে সরকারের নির্দেশনাসমূহ জানিয়ে দিতে হবে।
আট. যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত, এ ক্ষেত্রে তাদেরতে স্পষ্ট করে নির্দেশনা দিতে হবে। তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে কোনোপ্রকার অপরাধে যুক্ত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কেবল বিভাগীয় তদন্ত নয়, বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে।
নয়. এ ধরনের কাজের জন্য স্পেশাল টিম গঠন করতে হবে। প্রয়োজনে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলতে হবে, যারা দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম হবে। তাদের নিজস্ব একটা নম্বর থাকবে, যাতে যে কারও অবহিত করার সুযোগ থাকতে হবে।
দশ. সরকারিভাবে একটা দিনকে সম্প্রীতি দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে হবে এবং সেদিন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতে দিবসটি পালনের ব্যবস্থা করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি কেন জরুরি এবং দেশটাকে সব ধর্মের-বর্ণের-শ্রেণি-গোত্র-পেশা-সম্প্রদায়ের মানুষের বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে, তার শিক্ষা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। বিচ্ছিন্নতা কিংবা বিচ্ছেদে নয়, মিলনেই যে সব মানুষের মুক্তি ও শান্তি নিহিত, এই বার্তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।
চিত্রাপারের কান্না থেকেও যদি সদর্থক অর্থে কোনো ভূমিকা পালন না করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে, যতই মুখে বলি না কেন, আমরা এখনো সভ্য হয়ে উঠতে পারিনি। একটা রাষ্ট্র-একটা সমাজ কতোটা সভ্য-মানবিক-ন্যায়বিচারী তা বোঝা যায় সেখানকার সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানকালীন সময়ে আমরা যেমনটা দেখেছি। এখন স্বাধীন বাংলাদেশেও যদি সেরকমটাই হয়, তাহলে শশীকান্তদের দীর্ঘশ্বাস আমাদের ক্ষমা করবে না কখনো।
মিনতি যখন বলে, 'কলকাতায় দম বন্ধ হয়ে যায়, ওখানে তো চিত্রা নদী নেই'। একেই বলে দেশপ্রেম, একেই বলে নিখাদ ভালবাসা। ওই চলচ্চিত্রেই তো আমরা বলতে শুনি, নড়াইলের মতো সুন্দর জায়গা পৃথিবীর কোথাও নেই। চিত্রা স্বর্গের চেয়েও সুন্দর। শেকড়ের প্রতি প্রণয়ের দ্ব্যর্থবোধক এই প্রকাশ কি আর কোনোভাবে হতে পারে? সেই চিত্রাপারের একজন অধ্যক্ষকে যখন গলায় স্যান্ডেলের মালা পরিয়ে প্রকাশ্যে ঘোরানো হয়, দীপালি সাহাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে, চিত্রাপারের মানুষের কান্নাকে এ দেশের রাজনীতিবিদগণ পুঁজি করেছে কেবল, তা দূর করার জন্য নেয়নি কোনো ব্যবস্থা।
চিত্রা নদী বিধৌত নড়াইল নানা কারণে বিখ্যাত, শ্রদ্ধা ও সমীহ জাগানিয়া এক জনপদ। বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জন্মভূমি। মাশরাফির মতো একজন ক্রিকেটারের আঁতুড়ঘরের সাক্ষী, দিলীপ সাহাদের সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্যও তিনি। এই ঘটনায় তিনিও ব্যথিত। বলেছেন, খতিয়ে দেখবেন। রাজনীতিবিদদের খতিয়ে দেখার আশ্বাসে আমরা দ্বিধান্বিত থাকলেও মাশরাফির কাছে আশা জিইয়ে রাখতে চাই, কারণ তিনি শুধুই একজন রাজনীতিক নন, একজন খ্যাতিমান ক্যাপ্টেনও।
ওয়াল্ট হুইটম্যানের 'O Captain! My Captain!' কবিতার একটা পঙক্তির উচ্চারণ এরকম, 'O Captain! my Captain! rise up and hear the bells.' আমাদের ক্যাপ্টেন কী শুনতে পেয়েছেন চিত্রাপারের কান্না। আমরা এখন দেখার অপেক্ষায় আছি, ক্যাপ্টেনের ভূমিকায় তিনি কী করেন- চিত্রাপারের দুঃখ দূর করতে, চিত্রা নদীর কান্না লাঘবে।
কাজল রশীদ শাহীন: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments