ইসিআর থেকে ইএফডি: ভ্যাট আদায়ে আশানুরূপ ফল দিচ্ছে না কোনোটিই

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ৫ এপ্রিল খুচরা দোকান থেকে ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইসের (ইএফডি) মাধ্যমে সংগৃহীত বিক্রয় রশিদ নিয়ে একটি লটারির আয়োজন করে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ৫ এপ্রিল খুচরা দোকান থেকে ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইসের (ইএফডি) মাধ্যমে সংগৃহীত বিক্রয় রশিদ নিয়ে একটি লটারির আয়োজন করে।

দোকান থেকে কেনাকাটা করার পর ভোক্তারা যাতে ইএফডি রশিদ চেয়ে নেয়, সে বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এনবিআর এই লটারি চালু করে। এ পর্যন্ত এ লটারির ১৫টি ড্র অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং প্রায় ১ হাজার ৫০০ জন বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে।

প্রথম ও দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে যথাক্রমে ১ লাখ ও ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত মাত্র ১০০ জন পুরস্কার বিজয়ী পাওয়া গেছে। বাকি ১ হাজার ৪০০ মানুষ এখনও পুরস্কার নিতে আসেননি।

লটারি চালুর সময় কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন পুরস্কারের অর্থের পরিমাণ ভোক্তাদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করবে এবং তারা দোকান বা রেস্তোরাঁর বিল পরিশোধের পর ইএফটি রশিদ চেয়ে নেবেন। ফলে সার্বিক ভাবে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার ঘটনাগুলো কমে আসবে।

২৪ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইএফডি বসানোর কার্যক্রম শুরুর পর এনবিআর এই লটারি চালু করে। খুচরা দোকান থেকে মূল্য সংযোজিত কর বা ভ্যাট সংগ্রহ নিশ্চিত করতে দোকান, হোটেল, রেস্তোরাঁ, মিষ্টির দোকান, কাপড়ের দোকান, আসবাবপত্র ও ইলেকট্রনিক্স বিক্রির দোকান এবং গয়নার দোকানে এই প্রযুক্তি চালু করেছে এনবিআর।

ইএফডি প্রযুক্তির নেপথ্যের চিন্তা ছিল, এর ব্যবহার বাড়লে রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিক্রির প্রকৃত পরিমাণ দেখতে পাবেন, কারণ এটি এনবিআরের ইএফডি ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকবে।

ভ্যাট আদায় বাড়ানোর জন্য রাজস্ব বিভাগ এর আগে ২০০৭-২০০৮ সালে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টারের (ইসিআর) প্রচলন করার চেষ্টা চালিয়েছিল। তবে এটি ব্যবসায়ীদের মধ্যে সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়।

প্রচলনের কয়েক বছর পর এ সংক্রান্ত সব ধরনের প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। মূলত প্রয়োগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা এবং রাজস্ব কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের অবৈধ যোগসাজশের কারণেই এই উদ্যোগটি সফল হয়নি।

এছাড়াও, ব্যবসায়ীরা তাদের প্রকৃত লেনদেনের তথ্য প্রকাশ করছেন কী না, সেটা যাচাই করার কোনো উপায় ছিল না, কারণ ইসিআরগুলো এনবিআরের কোনো কেন্দ্রীয় সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত ছিল না।

ফলে রাজস্ব কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালে ইসিআরের পরিবর্তে ইএফডি বসানোর উদ্যোগ হাতে নেয়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এই প্রযুক্তি কেনার জন্য টেন্ডার ছাড়ে এনবিআর।

চীন ভিত্তিক এসজেডজেডটি ও বাংলাদেশের সিনেসিস আইটির কনসোর্টিয়ামের কাছে ১০ হাজার ইএফডি মেশিনের অর্ডার দেওয়া হয়। মোট ১ লাখ ইএফডি কেনার পরিকল্পনা করা হয়।

প্রতিটি ইএফডির ক্রয় মূল্য ছিল ৩২ হাজার টাকা।

২০২০ এর আগস্টে রাজস্ব কর্তৃপক্ষ পরীক্ষামূলক ভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৫টি ভ্যাট কমিশনারেটে ইএফডি চালু করে। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০২১ এর জুনের মধ্যে ১০ হাজার দোকানে ইএফডি বসানো।

এই ১০ হাজার মেশিন সাফল্যের সঙ্গে বসিয়ে কার্যক্রম শুরু করতে পারলে কনসোর্টিয়ামকে বাকি ৯০ হাজার ইএফডির জন্য অর্ডার দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল এনবিআরের।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে ইএফডি নিয়ে এতটাই উৎসাহ ছিল, যে তারা সারা দেশেই ইএফডি চালু করে সব খুচরা দোকানকে এর আওতায় আনার পরিকল্পনা করছিলেন।

মাঠপর্যায়ে যা দেখা যাচ্ছে

প্রায় ২ বছর পর, ব্যবসায়ী, এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তা ও রাজস্ব কর্মকর্তাদের অনীহার কারণে মাত্র ৪ হাজার মেশিন বসানো হয়েছে এবং তা মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামে। তবে এ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ মেশিন বসানো ও এর ব্যবহারের কারণে অনেক দোকান থেকে রাজস্ব আয় বেড়েছে।

এনবিআর কর্মকর্তাদের বর্তমান আলোচনার বিষয় হচ্ছে, ব্যবসায়ীদেরকে বিনামূল্যে ইএফডি দেওয়ার যৌক্তিকতা। এ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রদের দাবি, এই আলোচনার কারণে নতুন করে ইএফডি বসানোর উদ্যোগে ভাটা পড়েছে।

দোকানীরাও এই মেশিন গ্রহণ করে এর মাধ্যমে বিক্রির হিসাব রাখতে অনিচ্ছুক ছিলেন। কিছু দোকানে ইএফডির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনায় এ বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বিভিন্ন দোকান ও রেস্তোরাঁয় একাধিকবার সরেজমিনে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিনিধিরাও ভোক্তাদেরকে ইএফডি বিক্রয় রশিদ দেওয়ার বিষয়ে খুব কম আগ্রহ দেখতে পান।

গত ১৭ এপ্রিল বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের শর্মা হাউজে দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিনিধি সরেজমিনে পরিদর্শনে যান। এ দোকানটিতে এনবিআর ইএফডি বসিয়েছে।

স্ন্যাকস এর বিল দেওয়ার পর বিক্রেতা বাকি টাকা ফেরত দেন, কিন্তু কোনো রশিদ দেননি।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিক্রেতা বলেন, সেদিন সকাল থেকে শুরু করে তখন পর্যন্ত কোনো ক্রেতা রশিদ চাননি।

পরে আরও ২ জন ক্রেতা বিল দেন, কিন্তু তাদেরকেও কোনো রশিদ দেওয়া হয়নি। এর আগে, ১০ জানুয়ারি এই প্রতিনিধি একই ফুড কোর্ট পরিদর্শনে যান। সেবারও তিনি একই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন।

অপর একজন প্রতিনিধি একই শপিং মলের অন্য কিছু দোকানে সরেজমিনে পরিদর্শন করেন, কিন্তু দোকানে ইএফডি মেশিন থাকা সত্ত্বেও কোথাও বিক্রেতাদের ইএফডি রশিদ দিতে দেখা যায়নি।

ঢাকা ও চট্টগ্রামের অন্যান্য অংশেও দোকানে ইএফডি মেশিন থাকার পরেও বিক্রেতারা যন্ত্রে বিক্রয় তথ্য প্রবেশ করান না, বা ক্রেতাদের রশিদ দেন না।

এই উদাহরণগুলো দোকানীদের নিয়ম ভঙ্গ করার এবং রাজস্ব প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মীদের দায়িত্বে অবহেলার চরম নিদর্শন।

দোকানীরা জানান, অনেক ভোক্তা ভ্যাট দিতে চায় না দেখে তারা ইএফডি ব্যবহার করেন না।

কিছু বড় দোকানে ইএফডি বসানোতে তারা অন্যান্য দোকানে, যেখানে এ মেশিন বসানো হয়নি, তাদের তুলনায় অসুবিধাজনক অবস্থায় আছেন বলে দাবি করেন।

রাজধানীর অরচার্ড পয়েন্ট শপিং মলের পাইকারি ও খুচরা ফ্যাশন হাউজ গ্যালাক্সির সত্ত্বাধিকারী সুলতানা পারভিন পিয়া জানান, অনেক গ্রাহককে ভ্যাট চালানসহ বিল দেওয়া হলে তারা দামাদামি করার চেষ্টা করেন।

'শপিং মলটি গাউসিয়া মার্কেট ও নিউ মার্কেটের কাছে। তারা একই পণ্য সেসব জায়গা থেকে আরও কম দামে কিনতে পারেন, কারণ সেখানে ভ্যাট দেওয়া লাগে না', যোগ করেন তিনি।

তবে এই উদ্যোক্তা দাবি করেন, তিনি ভোক্তাদের ভ্যাট দেওয়ার আবশ্যকতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে তাদেরকে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেন।

চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় একজন বিক্রেতা একটি বিল দেন, যেখানে ভ্যাট সংক্রান্ত তথ্য নেই। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে রেস্তোরাঁ মালিক জানান, ইএফডি রশিদ দেওয়া হলে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হন।

বিক্রেতা বলেন, কোনো ক্রেতা নিজে থেকে না চাইলে তারা কখনো ভ্যাট চালান দেন না।

চট্টগ্রামের ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মোহাম্মাদ আকবর হোসেনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইএফডি রশিদ না দিয়ে ভোক্তাদের কাছ থেকে বিল নেওয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

'আমরা অভিযোগ প্রাপ্তি সাপেক্ষে আইন অমান্যকারী দোকানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি, যখনই কোনো ভোক্তা অভিযোগ জানান, আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই', যোগ করেন তিনি।

এনবিআরের এক কর্মকর্তা জানান, কর প্রশাসনের সদর দপ্তর অবগত আছেন যে অসংখ্য ব্যবসায়ী ইএফডি রশিদ দিচ্ছেন না।

তিনি বলেন, 'দোকানীরা আমাদেরকে জানায়, তাদের বিক্রি নেই। কিন্তু আমরা যখন কোথাও সরেজমিনে পরিদর্শন করি, তখন তারা তাদের মেশিনগুলো ব্যবহার করে মেমো দেয়। আমরা সেখান থেকে চলে গেলে তারা আবার তা বন্ধ করে দেয়।'

ধারণা করা হয়েছিল, ইএফডি বাংলাদেশে ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। কিন্তু ইএফডি ব্যবহারের করুণ চিত্র দেখে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বাধ্য হয়ে স্বীকার করেন, এই মেশিনগুলো বসানো ও এর রক্ষণাবেক্ষণ একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি এ মন্তব্য করেন।

ফলে এনবিআর ইএফডি, এসডিসি (সেলস ডাটা কন্ট্রোলার) এবং ইএফডি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম আউটসোর্স করার জন্য আরও একটি টেন্ডার আহ্বান করে। টেন্ডারে অংশ নেওয়ার সময়সীমা বাড়িয়ে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নেওয়া হয় এবং এনবিআর মোট ৫টি প্রস্তাব পায়।

তবে এখনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।

নাম না প্রকাশের শর্তে এনবিআরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ইএফডি আউটসোর্স করার পরিকল্পনাটি একটি সরকারি সিদ্ধান্ত।

তিনি বলেন, 'অনেক সরকারি প্রকল্প সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে। দেশ জুড়ে লাখো দোকান আছে। সেগুলোকে সঠিকভাবে নিরীক্ষা করা হচ্ছে না। এ জন্য আমরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এই সেবা নেব।'

'তবে প্রশাসনিক বিষয়গুলো আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকবে', যোগ করেন তিনি।

তবে সব কর কর্মকর্তারা এই চিন্তাধারার সঙ্গে একমত নন।

ইএফডি বসানোর কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকা অপর এক এনবিআর কর্মকর্তা জানান, ক্রেতারা যাতে ইএফডি রশিদ চেয়ে নেন, সেজন্য লটারির আয়োজন করা হয়েছে।

'এ ক্ষেত্রে যা নেই, তা হল ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য একটি শক্তিশালী প্রচারণা। যদি মেশিনের নিরীক্ষণ করার দরকার হয়, তাহলে ইএফডির কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকে না', যোগ করেন তিনি।

কর কর্মকর্তারা ইএফডি ব্যবহারের নিরীক্ষার যে কাজ সঠিক ভাবে করতে পারেনি, সেটা বেসরকারি সংস্থা কীভাবে করবে, সে বিষয়ে কিছু কর্মকর্তা তাদের সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

 

Comments