গরমে শীতল থাকবেন যেভাবে

সূর্যের প্রচণ্ড দাবদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন। রিমঝিম বর্ষার সেই সজীবতা আর নেই প্রকৃতিতে। প্রচণ্ড দাবদাহে বাড়ছে পানিশূন্যতা, ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব। এ সময় শরীরকে শীতল রাখার উপায়গুলো জানা থাকলে গরমের অস্বস্তিকে মোকাবিলা করা কিছুটা হলেও সম্ভব।
ঢাকার গেণ্ডারিয়া এলাকায় মুখে পানি দিয়ে শরীর শীতল করার চেষ্টা করছেন এক শিশু। ছবি পলাশ খান/স্টার

সূর্যের প্রচণ্ড দাবদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন। রিমঝিম বর্ষার সেই সজীবতা আর নেই প্রকৃতিতে। প্রচণ্ড দাবদাহে বাড়ছে পানিশূন্যতা, ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব। এ সময় শরীরকে শীতল রাখার উপায়গুলো জানা থাকলে গরমের অস্বস্তিকে মোকাবিলা করা কিছুটা হলেও সম্ভব।

চলুন জেনে নেই শরীর শীতল রাখার কয়েকটি কার্যকর উপায়-

গরমে যা খাবেন

আয়ুর্বেদ বলে, গরমে মানুষের পিত্ত তীব্র হয়ে ওঠে। তাই শরীরে শীতলভাব বজায় রাখতে চাইলে সবার আগে খাদ্যতালিকা থেকে পিত্তবর্ধক খাবারগুলো বাদ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পাকস্থলী বা পেট গরম হলেই শরীরে অস্বস্তিভাব বেশি অনুভূত হয়।

তেঁতুলের ঠাণ্ডাই। ছবি: সংগৃহীত

সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী তবে কোন কোন সবজি ও ফল পাকস্থলী ঠাণ্ডা রাখে আসুন জেনে নেই।

সবজি

শীতের দিনের সবজি গাজর, ফুলকপি, বিট, বাঁধাকপি গ্রীষ্মের খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। মেনুতে রাখুন শসা, ঝিঙা, পটল, কুমড়া, ঢেঁড়সের মতো সবজি। এই সবজিগুলো সহজে পরিপাকযোগ্য তাই পেটকে তুলনামূলক ঠাণ্ডা রাখতে পারে।

ফলমূল

গরমে প্রচুর মৌসুমি ফল পাওয়া যায় যা শরীরকে শীতল রাখতে ও লবণাক্ততা ধরে রাখতে খুবই কার্যকর।

কাঁচা আম

কাঁচা আমের মৌসুম এখন না থাকলেও কিছু দোকানে এখনো কাঁচা আম পাওয়া যাচ্ছে। কাঁচা আমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম। এ ছাড়া রয়েছে ভিটামিন সি ও ম্যাগনেশিয়াম যা শরীর ঠাণ্ডা রাখতে সহায়তা করে।

তরমুজ

ছবি: সংগৃহীত

তরমুজ খুবই সুস্বাদু ও জনপ্রিয় একটি ফল। তরমুজের ৯১ দশমিক ৫ শতাংশই পানি। যা শরীর ঠাণ্ডা করতে সাহায্য করে। আরও আছে ভিটামিন ও খনিজ লবণ যা এই গরমে আপনার শরীরে লবণাক্ততা ধরে রাখবে। তাই নিয়মিত খাদ্যতালিকায় এই সময়ে তরমুজ রাখতে পারেন। তরমুজ জুস করেও খেতে পারেন। তবে রাতের দিকে তরমুজ খেলে অনেকের হজমে সমস্যা হয়। কারণ এর মধ্যে প্রচুর ফাইবার থাকে। সে রকম কোনো সমস্যা থাকলে রাতে তরমুজ খাওয়া এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

বাঙ্গি

বাঙ্গি একটি খুবই পুষ্টিকর একটি ফল যা খুবই সহজলভ্য এবং দামেও তুলনামূলক সস্তা। শরীর ঠাণ্ডা রাখতে বাঙ্গির তুলনা নেই। বাঙ্গিতে রয়েছে প্রচুর পটাশিয়াম ও মিনারেল। তাই গরমে বাঙ্গি খেলে শরীরের গরমভাব দূর হয়ে যাবে। তাছাড়া নিয়মিত বাঙ্গির শরবত খেলে খাবারে অরুচি, অনিদ্রা, আলসার ও অ্যাসিডিটি দূর হয়।

শসা

শসা একটি বারোমাসি ফল বা সবজি। খুবই সহজলভ্য এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এতে রয়েছে ৯৬ দশমিক ৭ শতাংশ পানি। যা শরীরের পানির অভাব মেটাতে সাহায্য করে।

আখের গুড়

আখের গুড়ের চাহিদা শীতকালে পিঠা বানাতে ব্যবহার হলেও গরমে এটার উপকারিতা অনেক। আখের গুড় দিয়ে শরবত পান করলে শরীর শীতল থাকে। তাছাড়া আখে রয়েছে ফ্রুকটোজ ও গ্লুকোজ রয়েছে। যা আমাদের শরীরের তাপমাত্রা কমাতে কার্যকর।

পানীয়জল হিসেবে যা খাবেন

কোমল পানীয় হিসেবে বাজারে কোকা কোলা, পেপসি, সেভেন আপ, স্প্রাইট, মাউন্টেন ডিউ এর মত অনেক কার্বনেটেড বেভারেজের বিরাট বাজার রয়েছে বাংলাদেশে। তবে এই বাজারজাত পানীয়গুলো শরীরকে সাময়িক চাঙ্গাভাব দিলেও এর কোনো পুষ্টিগুণ নেই বরং শরীরকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

প্রাকৃতিক অনেক পানীয় বা শরবত রয়েছে যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। শরীরে শীতলভাব ধরে রাখে দীর্ঘক্ষণ। এই শরবতগুলো কারখানায় তৈরি কোমল পানীয়ের মতো পুষ্টিবিহীন মিষ্টি কার্বনেটেড পানীয় নয়।

প্রাকৃতিক পানীয় পান করার একটি বড় সুবিধা হলো, এটি শুধুমাত্র শরীরকে হাইড্রেট করে না, সেইসঙ্গে প্রয়োজনীয় খনিজ লবণ ও পুষ্টিও পৌঁছে দেয়। এর আরেকটি বাড়তি সুবিধা হলো যে বাড়িতে তৈরি প্রাকৃতিক পানীয়তে কোনো কৃত্রিম উপাদান যোগ করা হয় না। বিধায় সব বয়সীদের জন্যই এটি উপকারী।

আখের রস

আখের রস শরীরকে ঠাণ্ডা রাখতে খুবই কার্যকরী। কাঁচা আখ থেকে চেপে প্রাপ্ত রসের সঙ্গে বিট লবণ, পুদিনাপাতা এবং লেবুর রস মিশিয়ে খেলে এর সঠিক স্বাদ পাওয়া যায়। এক কাপ আখের রসে ১৮০ ক্যালোরি ও ৩০ গ্রাম সুক্রোজ থাকে।

ডাবের পানি

ছবি: সংগৃহীত

গরমে ডাবের পানি নিমিষেই শরীরে চাঙ্গা ভাব নিয়ে আসে। ডাবের পানিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে। যা আপনার শরীরকে সতেজ করতে দারুণ কার্যকর। এক কাপ ডাবের পানিতে থাকে ৬০ ক্যালোরি, ১৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৮ গ্রাম চিনি এবং পর্যাপ্ত পটাসিয়াম থাকে। তাছাড়া ডাবের পানির ৯৪ শতাংশই পানি।

বেলের শরবত

গরমে শরবত তৈরির জন্য বেল বেশ পরিচিত ফল। যা পাকস্থলী ঠাণ্ডা রাখতে খুব কার্যকর। বেলে রয়েছে বিটা-ক্যারোটিন, প্রোটিন, রিবোফ্লাভিন, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি১ এবং বি২, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম এবং ফাইবারের মতো পুষ্টিকর উপাদান।

পুদিনার শরবত

ছবি: সংগৃহীত

শরীরকে ভেতর থেকে ঠাণ্ডা রাখতে এবং সতেজ অনুভূতির জন্য খাওয়া হয় পুদিনা। পুদিনায় রয়েছে ফসফরাস, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন সি, ডি, ই এবং এ সমৃদ্ধ উপাদান। পুদিনার শরবত গরমে দেবে শীতল অনুভূতি।

জিরাপানি

নোনতা স্বাদযুক্ত পানীয় জিরাপানি। এটি বেশ জনপ্রিয়। এক গ্লাস জিরাপানিতে থাকে ৬৯ ক্যালরি, ১ দশমিক ৯ গ্রাম প্রোটিন, ৫ দশমিক ৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট এবং ১ দশমিক ৪ গ্রাম ফাইবার যা পেটকে ঠাণ্ডা রাখে। হজমে সাহায্য করে।

লেবুর শরবত

লেবুর শরবত হলো প্রচণ্ড ব্যস্ততা, ক্লান্তি কিংবা অবসাদে সতেজতা ফেরানোর সবচেয়ে প্রচলিত প্রাকৃতিক পানীয়। ১০০ গ্রাম লেমনেডে ২৯ ক্যালোরি, ১ দশমিক ১ গ্রাম প্রোটিন, ২ দশমিক ৫ গ্রাম চিনি, ২ দশমিক ৮ গ্রাম ফাইবার এবং ৯ দশমিক ৩ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট রয়েছে। তাছাড়া লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি।

পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান

তাপদাহের সময় প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা খুবই জরুরি। তাপদাহে গরম পানি পান করা অস্বস্তিকর হলেও গরম পানি পান করতে অনেকেই পরামর্শ দেন।

এর যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, গরম পানি পানে অল্প সময়েই শরীরের উষ্ণতা বেড়ে যায়। ফলে প্রচুর ঘাম ঝরতে থাকে শরীর থেকে। এতে করে শরীরও ঠাণ্ডা হয়ে যায় খুব দ্রুত, থাকা যায় সতেজ। উল্লেখ্য, প্রতি ঘণ্টায় মানবদেহ দুই লিটারের বেশি ঘাম ঝরাতে পারে। ফলে শরীরের তাপমাত্রা কমাতে এটি একটি ভালো পদ্ধতি হতে পারে। আবার অনেকে গরমে ঠাণ্ডা পানি পানের পরামর্শ দেন। এ নিয়েও কিছু গবেষণা হয়েছে। ফলাফলে দেখা গেছে, ঠাণ্ডা পানি পানে সতেজ হওয়া যায় দ্রুত। যে কারণে পুষ্টিবিদরা ঠাণ্ডা পানি পান করতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

তবে জাপানের অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের থার্মোরেগুলেটরি ফিজিওলজি'র সহযোগী অধ্যাপক ওলি জে ও তার দল শরীরে বিভিন্ন স্থানে ৮টি থার্মোমিটার রেখে একটি পরীক্ষা করেন। ফলাফলে দেখা যায়, গরম পানি দ্রুত শরীর শীতল করে থাকে। কারণ গরম পানিতে শরীর থেকে ঘাম নির্গত হয় বেশি।

জীবনযাত্রায় আনুন পরিবর্তন

গরমে হালকা রংয়ের পোশাক পরতে হবে। গাঢ় রংয়ের পোশাক তাপমাত্রা শোষণ করে বলে গরম অনুভূত হয় বেশি। গরমের সবচেয়ে উপকারী পোশাক হলো সাদা রংয়ের পোশাক। গরমে সিনথেটিক পোশাক এড়িয়ে চলবেন। সবসময় সুতি ও লিনেনের ঢিলা পোশাক পরার চেষ্টা করুন।

গরমে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করুন। রোদে গেলে মাথায় রাখুন চওড়া ক্যাপ, স্কার্ফ অথবা সঙ্গে রাখুন ছাতা। ত্বকে মাখুন সানস্ক্রিন ক্রিম কিংবা লোশন। গোসলে যাওয়ার আগে নারকেল তেল মাখতে পারেন।

খুব ভোরে বা সূর্য ডোবার পরই একমাত্র ভারী ব্যায়াম করতে পারেন। রোদের মধ্যে ভারী ব্যায়াম করলে মাসলে ক্র্যাম্প ধরা থেকে হিটস্ট্রোকসহ আরও নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। এতে উপকারের থেকে অপকারই বেশি হওয়ার সম্ভাবনা।

সিগারেট, জর্দা বা নেশাজাতীয় দ্রব্য খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তা এখনই ত্যাগ করুন। ধূমপানে শরীরকে আরও গরম করে তোলে।

Comments