সুখী হবেন যেভাবে

সুখী হওয়ার বাধা-ধরা কোনো নিয়ম বা তত্ত্ব। সুখ নিয়ে তাই কবিতা, গল্প, উপন্যাস কিংবা রূপকথারও শেষ নেই।
প্রতীকী ছবি।

সুখী হওয়ার বাধা-ধরা কোনো নিয়ম বা তত্ত্ব নেই। সুখ নিয়ে তাই কবিতা, গল্প, উপন্যাস কিংবা রূপকথারও শেষ নেই।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 'তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও।' অর্থাৎ সুখ কখনো নিজে নিজে হাতের কাছে এসে ধরা দেয় না, সুখের সন্ধান করতে হয়, অর্জন করতে হয়।

 অন্যদিকে, মনোবিজ্ঞানী কাহনেম্যান বলেছেন, 'লোকেরা নিজেদের জন্য কী চায়, তারা কীভাবে তাদের লক্ষ্যগুলো অনুসরণ করে তা আপনি যখন দেখেন, তখন দেখবেন তারা সুখের সন্ধানের চেয়ে সন্তুষ্টির সন্ধানে বেশি চালিত বলে মনে হয়।'

প্রতীকী ছবি।

২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'ইন্টু দ্য ওয়াইল্ড' সিনেমার শেষভাগে মৃত্যুপথযাত্রী নায়ক তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন, 'অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারাই প্রকৃত সুখ।' মনের আনন্দ, সুখ অন্যের সাথে ভাগাভাগি না করতে পারলে সেটা কোনো আনন্দই নয়।

অনেক মনোবিজ্ঞানী বলেন, সুখ হল জেনেটিক বা বংশানুগতিসম্বন্ধীয় একটি বিষয়। গবেষকরা শনাক্ত করেছেন যে ৫-এইচটিটি বা 'হ্যাপি জিন' হিসেবে চিহ্নিত একটি নির্দিষ্ট জিনের কারণে গর্ভধারণের সময় থেকেই সুখী হওয়া আমাদের ডিএনএ-তে নিহিত আছে। এর মানে আমাদের সবারই এই জিন আছে।

প্রতীকী ছবি।

মিশিগানের হোপ কলেজের সাইকোলজি বিভাগের প্রফেসর ডেভিড মায়ার বলেন, 'যে যাই বলুন না কেন, সুখ অনেকাংশেই মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি অনুভূতি। এটি অনেকটা মানুষের কোলেস্টেরল লেভেলের মতো, যা জেনেটিক্যালি প্রভাবিত হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষের আচার-আচরণ বা লাইফস্টাইল এবং খাদ্যাভ্যাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।'

হার্ভার্ডের মনোবিজ্ঞানী ড্যান গিলবার্ট বলেন, 'আপনার সুখ আপনাকেই সংশ্লেষণ (Synthesize) করতে হবে। নতুন কাপড়-চোপড় কেনা বা লটারির অগাধ টাকা অর্জন আপনার জীবনের সব দুঃখ দূর করে দিয়ে অনাবিল আনন্দ ও সুখ বয়ে আনবে, এ ধরনের কল্পনা মানুষের চিন্তাশক্তিকে ভুল পথে পরিচালিত করে।'

সুখের সংজ্ঞায় কেউ এক সারিতে দাঁড়াতে পারেনি কারণ সুখের সঠিক সংজ্ঞায়ন করা অসম্ভব। সুখ একটি আপেক্ষিক ধারণা বা ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা যা ব্যক্তিভেদে, পরিস্থিতি ও বয়সভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। তবে একটি বিষয় এখানে ধ্রুব যে সুখকে অর্জন করতে হয়, অর্জন করতে জানতে হয়, সুখ নিজে থেকে ধরা দেয় না। কিছু কিছু বিষয় অনুসরণ করলে জীবনে সুখী হওয়াটা তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে যেতে পারে। এগুলো হলো-

ইচ্ছাশক্তি

লিও তলস্তয় সুখী হওয়া নিয়ে বলেছিলেন, 'তুমি যদি সুখী হতে চাও, পারবে।' অর্থাৎ সুখী হওয়াকে তিনি ব্যক্তির ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। ইচ্ছা না থাকলে কেউ সুখী হতে পারে না। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা মানসিকভাবে সহজে ভেঙ্গে পড়েন বা দুঃখের স্মৃতি সহজে ভুলে যেতে পারেন না। তাদের জন্য সুখী হওয়াটা কঠিন। ইচ্ছাশক্তির ফলে তারা যাবতীয় বিড়ম্বনাকে দূরে সরিয়ে জীবনের ইতিবাচক দিকগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে পারেন। এতে করে দুঃখের স্মৃতিগুলো আস্তে আস্তে মুছে যাবে। জীবন সহজ হবে।

নিজেকে জানো

নো দাইসেলফ সক্রেটিসের একটি বিখ্যাত উক্তি যার অর্থ 'নিজেকে জানো'। যে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে জানে না, যে জানে না সে কী চায়, কোন কাজে সে আনন্দিত হয়, কী করলে সে মানসিকভাবে শান্তি পেতে পারে, তার পক্ষে সুখী হওয়া অসম্ভব। কেননা এতে সর্বদাই সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে। সুখী হওয়ার জন্য নিজেকে জানার কোনো বিকল্প নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ারেন বাফেট পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় ধনীদের মধ্যে অন্যতম। প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক এই মার্কিনীর জীবনদর্শন, কাজ-কর্ম, টাকা-পয়সা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। বলা হয়, এখনো তিনি ৫০ বছর আগে কেনা তিন কক্ষবিশিষ্ট একটি বাড়িতে বাস করেন এবং খুব আনন্দের সঙ্গে তিনি অনলাইন ব্রিজ খেলেন।

ওয়ারেন বাফেট বলেন, আমি সপ্তাহে ১২ ঘণ্টা অনলাইনে ব্রিজ খেলি। অনেকের কাছে এটি সাধারণ বিনোদন বলে মনে হতে পারে। তবে সাধারণ এমন অনেক কিছু আছে যা আমাদের বিপুল আনন্দ দিতে পারে। আমি স্বভাবত ওই সব কাজ করায় বিশ্বাস করি যা আমার কাছে অর্থবহ। আমার ব্যক্তিগত জীবনেও আমি অন্য ধনী ব্যক্তিরা কী করেছেন তা নিয়ে পরোয়া করিনি। কারো কাছে ৪০০ ফুট দীর্ঘ প্রমোদতরী আছে বলে আমার ৪০৫ ফুট দীর্ঘ প্রমোদতরী থাকতে হবে এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণায় আমি বিশ্বাস করি না।

ইতিবাচক মনোভাব

জীবনের প্রতি, চারপাশের মানুষের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করলে মানসিক শান্তি লাভ করা সহজ হয়ে যায়। সবসময় নেগেটিভ কিছু ভাবলে, মানুষের সঙ্গে মেশার আগেই তার প্রতি বাজে ধারণা রাখলে ব্যক্তির নিজস্ব জগৎ দিন দিন সংকীর্ণ হতে থাকে। নিজস্ব সৃষ্টিশীলতা দিয়ে তৈরি ক্ষুদ্র জগতে নিজেরই মানসিক দহনে হাসফাস করা ছাড়া তখন আর কিছুই করার থাকে না। তাই জীবনে 'সুখ' নামক সোনার হরিণ পেতে চাইলে প্রথমেই নিজের প্রতি, জীবনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব রাখতে হবে।

আশাবাদী হওয়া

'আশাবাদী হওয়া ভালো দিক, সম্ভবত সবচেয়ে ভালো।' শোওশাঙ্ক রেডেম্পশন সিনেমার এই বিখ্যাত উক্তি অনেক নৈরাশ্যবাদী মানুষের মনেও আশার আলো সঞ্চার করে। আশাবাদী হওয়া জীবনে সুখী হওয়ার অন্যতম মূলমন্ত্র। কোনো কাজ শুরু করবার আগে আমরা যদি আশাবাদী থাকি, তবে সেই কাজে উদ্যম, শক্তি ও আত্মবিশ্বাস ৩টিই সমানভাবে থাকে। ফলে কাজে সফলতার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক শান্তিও অর্জন করা যায়।

নিন্দায় কান না দেওয়া

'করিতে পারি না কাজ

সদা ভয়, সদা লাজ,

সংশয়ে সংকল্প সদা টলে

পাছে লোকে কিছু বলে!'

কামিনী রায়ের এই বিখ্যাত কবিতা পড়েনি এমন লোক কমই আছে। সমালোচনা নামের এই অদৃশ্য জুজুর ভয়ে অনেকেই জড়োসড়ো হয়ে থাকে। লোকে কী ভাববে, এই চিন্তা থেকে আমরা অনেক কিছু থেকে দূরে থাকি। হতে পারে, কেউ সাইন্স পড়তে পছন্দ করে না, কিন্তু আমাদের দেশের একটি প্রচলিত 'মাইন্ড সেটাপ' হচ্ছে সাইন্স যারা পড়ে না, তারা ভালো ছাত্র নয়। সে কারণে অন্যের চোখে 'ভালো ছাত্র' ট্যাগটি ধরে রাখার আশায় কেউ কেউ কষ্ট করে হলেও সাইন্স বিভাগে পড়ে। অন্যের কথায় সহজে বিচলিত হয়ে গেলে জীবন কাটে আমার আশপাশের মানুষ কীভাবে মূল্যায়ন করছে সে ভাবনা ভেবে ভেবে। এটি একধরনের মানসিক জটিলতা যা কাটাতে না পারলে জীবনে সুখী হওয়া কঠিন হয়ে যায়।

সমালোচনা গ্রহণ করতে শেখা

একজন মানুষ কখনো নির্ভুল হতে পারে না। ভুল করা তার মজ্জাগত স্বভাব। ভুল করলে সমালোচনা হবেই। তবে অনেক সময় ভুল না করলেও অনেকে সমালোচনার শিকার হোন। সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে অন্যের নামে সমালোচনা করা বর্তমানে ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। তবে কেউ গঠনমূলক সমালোচনা করলে সেটি সহজে গ্রহণ করতে পারা একটি অন্যতম শক্তিশালী গুণ। অনেকেই আছেন যারা কেউ সমালোচনা করলে বা ভুল ধরিয়ে দিলে তাতে ভীষণরকম রেগে যান বা প্রতিক্রিয়া দেখান। এটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

ইতিবাচক কথার সঙ্গে নেতিবাচক মন্তব্যও গ্রহণ করতে পারা, ব্যক্তিত্বের অন্যতম অর্জন, এতে করে জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে কাটে।

সন্তুষ্ট থাকা, সন্তুষ্ট থাকো..

'সন্তুষ্ট থাকার মধ্যেই সুখ' উক্তিটির সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। যার অর্থ সন্তুষ্টির মাঝেই সুখ নিহিত। যেসব মানুষের জীবনে চাহিদা খুব কম, যারা অল্প পেয়েই খুশি হতে জানে, জীবনে তারাই সবচেয়ে বেশি সুখের দেখা পায়। হতে পারে তা ছাদের আকাশ থেকে সূর্যাস্ত দেখে আনন্দিত হওয়া কিংবা নবজাতকের সদ্য ফোটা আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে সৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগ করা। প্রকৃতপক্ষে সুখ সবখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তা ছুঁতে জানা চাই। এখন কেউ যদি বাসার ছাদে বসে সমুদ্র পারের সৌন্দর্য দেখতে পেল না বলে হাহুতাশ করে সে তো বর্তমান সময়টাকেও হারিয়ে ফেললো। এই মুহূর্তটাকেও উদযাপন করতে পারলো না। তাই যখন যা আছে তা-ই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা ও প্রতিটি মুহূর্তে আনন্দ খোঁজার চেষ্টা- জীবনে সুখী হওয়ার অন্যতম কৌশল।

স্রষ্টার অনুসন্ধান

যারা ধর্মে বিশ্বাস করেন তাদের জন্য স্রষ্টার উপাসনা করাও মনের মধ্যে কোমল অনুভূতি জাগায়, হৃদয়কে পবিত্রতা দান করে। ধর্মীয় আচার পালনের মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য ও তার সৃষ্টির প্রতি সদয় থাকার মাধ্যমে অনেকে সুখী হতে পারেন বা সুখ খোঁজার চেষ্টা করতে পারেন।

গবেষণা বলছে, প্রার্থনা এবং বিশ্বাস দ্বারা স্নায়বিক সুবিধা লাভ করা সম্ভব।

দ্য হ্যান্ডবুক অব রিলিজিওন অ্যান্ড হেলথ' বইয়ে ফেইগিলম্যান (১৯৯২) দ্বারা পরিচালিত একটি জরিপের বর্ণনায় বলেছেন, যারা ধর্মকে ছেড়ে দিয়েছে এমন আমেরিকানদের মধ্যে সুখ নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে , যেখানে পাওয়া গেছে যে ধর্ম ত্যাগের সঙ্গে অসুস্থতার সামান্য সম্পর্ক রয়েছে । ১৪৭টি স্বাধীন গবেষণাকারীর এক গবেষণায় দেখা গেছে যারা ধর্মপালন করে তারা বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত হোন তুলনামূলক ভাবে কম, যদিও সেই সম্পর্কের পরিমাণ ০.০৯৬ শতাংশ। ২০০টিরও বেশি সামাজিক গবেষণার বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, 'ধর্মভীরুতা বিষণ্ণতা এবং মাদকদ্রব্যের ব্যবহার, আত্মহত্যার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়, শুধু তাই নয় যৌন জীবন এবং সন্তুষ্টির দিক থেকেও তারা অনেক এগিয়ে থাকে।'

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল

স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে সুখ অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য বলতে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যকেও বোঝানো হয়েছে। শারীরিক অসুস্থতা যেমন মানুষকে মানসিকভাবে অসুস্থ বানিয়ে দেয়, তেমনি মানসিক চাপজনিত কারণে শারীরিক বিভিন্ন অসুবিধা দেখা যায়৷ শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষরাই এই বস্তুজগতে সুখ ও শান্তির জন্য যেসব উপকরণ প্রয়োজন তা সহজে অর্জন করতে পারে। তাই সুখী হওয়ার সঙ্গে সুস্বাস্থ্যের সম্পর্ক চিরন্তন ও সার্বজনীন।

Comments

The Daily Star  | English

Dos and Don’ts during a heatwave

As people are struggling, the Met office issued a heatwave warning for the country for the next five days

3h ago