সিংহল দ্বীপ- যার সৌন্দর্য কল্পনাকেও হার মানায়
সিংহল দ্বীপ বা শ্রীলঙ্কা। যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি সুন্দর দেশটি। সেখানকার মানুষের মিষ্টি ব্যবহার, ঝকঝকে তকতকে রাস্তাঘাট, জিভে জল আনা সব খাবার ও নৈসর্গিক সৌন্দর্য সবই আমাদের অভিভূত করেছে। আর সবচেয়ে অবাক হয়েছি বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন অফিসারদের হাসিমুখ দেখে। আমি চ্যালেঞ্জ করতে পারি, কেউ আর কোন দেশের বিমানবন্দরে এটা দেখেননি।
কলম্বো: শুরুতেই রাজধানী
রাজধানী কলম্বোর বন্দরনায়েক বিমানবন্দরের বাইরে এসেই বুঝলাম আমাদের স্থান বাছাই চমৎকার হয়েছে। গাইড জানালো হোটেলটা সাগর পাড়ে, যানজট পেরিয়ে যেতে একটু সময় লাগবে। কাজেই পথে কিছু খেয়ে নিতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম লংকার ট্র্যাডিশনাল খাবারের স্বাদ নিবো। ঢুকলাম একটি রেস্টুরেন্টে। সেখানে অনেক খাবারের ভিড়ে চোখে পড়ল আমাদের চিতই পিঠার মতো একটি জিনিস-ওপরে ডিমপোচ দিয়ে বিক্রি হচ্ছে আর তাই দেখেই রাফাত হৈ চৈ করে উঠল উহ্ এটাইতো ট্র্যাভেল এন্ড লিভিং এ পিটার কুরুবেদার “মাই শ্রীলঙ্কাতে” দেখেছি – এর নামই “ওপাস ওপাস”। আরে এইতো দেখা যাচ্ছে “মালু পান”, (তিনকোণা এক ধরনের রুটি ) এগুলো কিন্তু খেতেই হবে। নারকেল তেল আর নারকেল দিয়ে রাঁধে বলে অনেকে এর আগে শ্রীলঙ্কান খাবারের নিন্দা করেছে, আর আমরা প্রথমবার খেয়েই জিভে জল আনা সব শ্রীলঙ্কান খাবারের ভক্ত হয়ে গেলাম।
শহরের যানজট পেরিয়ে, চারদিক দেখতে দেখতে যখন আমাদের গাড়িটি এসে পৌঁছলো শহরের শেষ প্রান্তে--- লাভিনিয়ার, হোটেল বারজায়ায়, তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। সাগর পাড়েই হোটেল। সবচেয়ে অবাক হলাম সাগর পাড়ে রেললাইন দেখে। একপাশে উত্তাল সাগর, এরই পাশ দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর হুইসেল বাজিয়ে রেলগাড়ি যাচ্ছে। কী অদ্ভুত একটা ব্যাপার। সাগর আর রেললইনের পাশে সারিবদ্ধ রেস্টুরেন্ট। এরই একটিতে বসে আমরা রাতের খাওয়া সারছি। মিটিমিটি মোমের আলোয় সাগরের গর্জন আর সেই সাথে ভেসে আসা স্প্যানিস আর ইংরেজি গান সব মিলে অপূর্ব এক পরিবেশে ডিনার সারলাম। খাওয়া আর আড্ডা দিতে দিতে অনেক রাত হয়ে গেল।
কলম্বো এতো ঝকঝকে-তকতকে একটি নগরী যে দেখলে মনে হয় পাশ্চাত্যের কোন দেশ। এমনকি সমুদ্র সৈকত সেটাও অত্যন্ত পরিষ্কার। গল ফেইসড সৈকতে অগণিত মানুষ বিকেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে-- কাঁকড়া ভাজা, চিংড়ি ভাজা, পাকোড়া, চিপস, আনারস, মালাই সবই খাচ্ছে কিন্তু কোথাও কোন ময়লা নেই!
শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটার সাঙ্গাকারা খুব জনপ্রিয় একজন- কাজেই দলের ভেতর থেকে দাবি উঠলো সাঙ্গাকারার রেস্টুরেন্ট ‘মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাবে’ যেতেই হবে। শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্র অর্থাৎ মূল বাণিজ্যিক এলাকায় একটি ওপেন মলে এটির অবস্থান। নগরীর ব্যস্ত প্রাণকেন্দ্রে অর্থাৎ আমাদের মতিঝিলে এতোটা খোলা বসার জায়গা দেখে রীতিমত হিংসা হলো।
বলে রাখা ভালো কেউ যদি শ্রীলঙ্কায় গিয়ে কিছু কেনাকাটা করতে চান তাহলে তা কলম্বোতেই সেরে নিতে হবে। ODEL, কটন কালেকশন সহ বেশ কয়েকটি বড় কেনাকাটার দোকান রয়েছে। শ্রীলঙ্কা থেকে কিনতে পারেন- চা পাতা, ভেষজ কসমেটিকস, বিভিন্ন ধরনের পাথর, সুতি কাপড়ের তৈরি পোশাক ও মশলা। ব্যাগ ভরে নিয়ে নিতে পারেন নেচারস সিক্রেটস নানা ধরনের অর্গানিক প্রসাধন সামগ্রী। এখানেও আছে একটি টুইন টাওয়ার, যা বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর এভাবেই হুলুস্থুল ঘোরাঘুরি করে চোখের নিমিষে কেটে গেল কলম্বোর দুটি দিন।
ক্যান্ডি: যে শহরের চূড়ায় বসে আছেন বুদ্ধ
দুই দিন কলম্বোতে ঘোরাঘুরি করে আমরা রওনা দিলাম শৈল শহর ক্যান্ডির দিকে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম পবিত্র ভূমি এই ক্যান্ডি। পর্তুগীজ, ডাচ ও ইংরেজ শক্তির কাছ থেকে সিংহলী রাজা শেষপর্যন্ত শুধু এই ক্যান্ডিকেই ধরে রাখতে পেরেছিলেন। পরে অবশ্য ১৮১৫ সালে এই ক্যান্ডি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
ক্যান্ডি যাওয়ার পথে আমরা গেলাম ‘এলিফ্যান্ট অরফানেজ’ বা হাতিদের আশ্রয়কেন্দ্র দেখতে। ১৯৭৫ সালে পিনাওয়ালাতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় আহত ও অনাথ বাচ্চা হাতিদের রাখার জন্য। আমরা যখন পৌঁছুলাম ওদের তখন গোসল করার জন্যে নদীতে নেয়া হয়েছে। অপূর্ব সুন্দর একটি পাহাড়ি নদী - যেখানে গোসল করছে ২৫/৩০ টি ছোট-বড় হাতি। যে পথ ধরে নদী কিনারে যেতে হয় তার দুপাশ জুড়ে পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। নানা ধরনের মুখোশ, মালা, বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পণ্য, এমনকি আরও বিক্রি হচ্ছে হাতির মল থেকে তৈরি পু পেপারও। দুপুরে হাতিরা ফিরে গেল তাদের থাকার জায়গায়। সেখানে খুবই যত্ন করে তাদের খাওয়ানো হলো। এবার তাদের বিশ্রামের সময়।
ওখান থেকে বের হওয়ার পথে, অনেকটা লোভে পড়ে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিলাম আমরা। হাতিদের আশ্রয়কেন্দ্রের ঠিক গেটের কাছে পৌঁছে দেখলাম কিছু মানুষ একটা খুপড়ি হোটেলের পাশে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে বসে ভাত খাচ্ছে। এক থালা ভাত, চারপাশে একটু একটু সাজানো আলু, মরিচের ভর্তা, শুটকি মাছ, নারকেলের ভর্তা, ডাল চর্চরি, মাছ ভাজা, আর ছোট মাছের ঝোল। মুহূর্তেই আমাদের মনে হলো এই খাওয়াটার স্বাদ হবে অসাধারণ, আর হলোও তাই। একেবারে কব্জি ডুবিয়ে খেলাম সবাই।
এরপর আবার শুরু হল পথচলা। ক্রমশ পথ হয়ে উঠলো পাহাড়ি। পাহাড় বেয়ে আমাদের গাড়ির পাশাপাশি ট্রেনও ছুটে যাচ্ছে। কখনো গাড়ি নীচে, ট্রেন উপরে। আবার কখনো ট্রেন নীচে, গাড়ি উপরে। পথের দু’ধারে চোখে পড়ল চা বাগান, মাটি, বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসের দোকান, নানারকম ফলের দোকান। চলতে চলতে আমরা একটা কফি শপে দাঁড়িয়ে আবার একটু হাত পা ঝেড়ে নিলাম।
ক্যান্ডি শহরটা মূলত একটি লেককে ঘিরে গড়ে উঠেছে। শহরের কেন্দ্রে একদম পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু চূড়ায় বসে আছেন যিনি, তিনি আর কেউ নন, তিনিই গৌতম বুদ্ধ। ওখানে বসেই তিনি বুলিয়ে যাচ্ছেন শান্তির পরশ। --- বহিরাভোকান্ডা বৌদ্ধবিহারে শ্বেতপাথরে নির্মিত গৌতম বুদ্ধের এই মূর্তি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। শহরের সব জায়গায় থেকেই এটি চোখে পড়ে। পাহাড়ি পথ বেয়ে গৌতম বুদ্ধের কাছাকাছি যাওয়া যায় গাড়িতে চড়েই। তবে একেবারে মূর্তির কাছে যেতে এরপর কিছুটা পথ হাঁটতে হয়।
এছাড়াও এখানে রয়েছে গৌতম বুদ্ধের দাঁত সম্বলিত মন্দির। মন্দিরে প্রচুর ভক্ত ও দর্শনার্থীর সমাগম হয়। ক্যান্ডিতে রয়েছে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য লংকাতিলকা মন্দির। এছাড়া আছে চা জাদুঘর, উদাত্তয়াত্তাকেলে জঙ্গল এবং ক্যান্ডি লেক। ক্যান্ডি রাজ্যের সর্বশেষ রাজা ১৮০৭ সালে এই লেকটি খনন করেন।
পাহাড়ের চূড়ায় হোটেলে নেমেই আমাদের মনটাই ভাল হয়ে গেল। শরীরের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। চারিদিকে শুধু সবুজের সমারোহ, নীল আকাশ, উদাত্ত পর্বতমালা। তবে সবচেয়ে মজা লাগলো হোটেলের রুমের দরজায় হুঁশিয়ারি দেখে, সেখানে বড় বড় করে লাল কালিতে লেখা – “দরজা বন্ধ রাখবেন, নাইলে বানর এসে জিনিষপত্র নিয়ে যাবে।” সকালে ঠিকই ঘুম থেকে উঠে তাদের দেখা পেলাম। কী যেন দুরভিসন্ধি নিয়ে দলবেঁধে ঘোরাঘুরি করছিল।
আমরা গেলাম গল এ: ওল্ড টেস্টামেন্টে যার কথা লেখা আছে
ক্যান্ডি থেকে গেলাম সাগর ঘেরা শহর গলেতে। সকলে যাওয়ার যে পথ অর্থাৎ যে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়ি চললো, তা দেখে আবার আমরা অভিভূত। গাড়ি চলছে ১৪০/১৫০ গতিবেগের নীচে নয়। অথচ কী কাণ্ড, একটুও ঝাঁকুনি নেই। হাতে চায়ের কাপ, কিন্তু ছলকে ছলকে পড়ে যাচ্ছেনা! চলতে চলতেই আমরা স্বপ্ন দেখলাম এরকম ৫/৬ টি রাস্তা আমাদের তৈরি করতে হবে বাংলাদেশে। শুধু ঐ বড় রাস্তাই নয়-এদের সব পথই পরিষ্কার ও মসৃণ। গলে ঢোকার মুখে প্রথমেই চোখে পড়ল ভারত মহাসাগর। সাগরের পাড় ঘেঁষেই শহরের রাস্তা। যাচ্ছিতো যাচ্ছিই কিন্তু গল শহরটা কোথায়? এখানেতো সবটাই সাগর। উত্তাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে চারপাশে।
পর্তুগীজ ও ডাচ স্থাপনার অনেক নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় গলে। এই কারণেই এটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। পণ্ডিতরা মনে করেন ওল্ড টেস্টামেন্টে ‘তারনিস’ বলে যে জায়গার কথা উল্লেখ আছে- গল আসলে সেই জায়গা, যেখানে বাদশা সোলায়মান তার বাণিজ্য তরী পাঠিয়েছিলেন।
গলে সবচেয়ে সুন্দর দেখার জায়গা ডাচদের পুরনো নগরী এবং এর পুরনো লাইটহাউস। এখানে এলে মনে হবে ১৫/১৬ শতকের কোন সময়ে চলে গেছি আমরা। বেশ কয়েকটি এনটিকস সামগ্রীর ও মুখোশের দোকান রয়েছে এখানে। গলে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে গেলে সাগরে তিমি দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও সময় থাকলে দেখে আসা যায় রেইন ফরেস্ট, কচ্ছপের হ্যাচারি ও ডাচ মিউজিয়াম। আমাদের সবার কাছে শ্রীলঙ্কা এতোই ভালো লেগেছে যে বারবার যেতে মন চাইছে।
Comments