ক্ষমতাধরদের হাতিয়ার কিশোর গ্যাং

দেশে ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে কিশোর গ্যাংয়ের ৬০৮ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। তাদের মধ্যে ৩০ জনকে অর্থদণ্ড এবং ১০ জনকে মুচলেকা নিয়ে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

দেশে ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে কিশোর গ্যাংয়ের ৬০৮ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। তাদের মধ্যে ৩০ জনকে অর্থদণ্ড এবং ১০ জনকে মুচলেকা নিয়ে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

র‌্যাব সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শুধু ২০২১ সালেই গ্রেপ্তার হয়েছে ২৯০ জন কিশোর। এ ছাড়া, ২০১৯ সালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদক সেবন, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ১২৯ কিশোরকে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে।

কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তার ঘটছে কেন এবং তাদের মদদ দিচ্ছেই বা কারা—তা জানেতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা, র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন খন্দকার ফারজানা রহমানের সঙ্গে।

তারা বলেছেন, সামাজিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্বল ভূমিকা, পারিবারিক শিক্ষার অভাব এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে কিশোররা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তৈরি হচ্ছে কিশোর গ্যাং। এই গ্যাংয়ের সদস্যরাই পরবর্তীতে অনেক বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পরে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, 'এমনিতেই অপরাধ বেড়ে গেছে। কিশোর গ্যাং বিস্তারের অন্যতম কারণ হচ্ছে সন্তানের ওপর পরিবারের নিয়ন্ত্রণ কম থাকা। বাবা-মা সন্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখছে না বা রাখতে পারছে না। তাছাড়া করোনার একটা প্রভাব আছে। কিশোরদের মেধা বিকাশে যেসব কর্মসূচি প্রয়োজন, করোনার সময় তা হয়নি। অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ কমে গেছে—এটাই মূল কারণ।'

তিনি বলেন, 'কিশোর অপরাধের দ্রুত তদন্ত ও বিচার হচ্ছে না। এটাও একটি কারণ হতে পারে। কিশোর অপরাধ নতুন কিছু না। সারা বিশ্বেই এটি হয়। তবে অবশ্যই এটি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। কারণ পরবর্তী জীবনে কিশোর অপরাধীরাই আবার বড় ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়। কিশোর অপরাধ কমাতে প্রতিটি এলাকায় সাংস্কৃতিক, সামাজিক অনুষ্ঠান বাড়ানো প্রয়োজন।'

কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার কোনো সম্পর্ক আছে কি না জনাতে চাইলে তিনি বলেন, 'এই অপরাধগুলো কিশোর গ্যাংয়ের যারা করে তারা ক্ষমতাবান হয়ে থাকে। এই ক্ষমতা আসে রাজনৈতিক যোগসাজশ থেকে। যারা ক্ষমতাসীন, তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বেশি থাকে।'

বড় ধরনের অপরাধের পর কিশোর গ্যাং প্রকাশ্যে আসার বিষয়ে তিনি বলেন, 'কিশোররা ছোটোখাটো অপরাধ করলে তা তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আনা হয় না। তাই তারা অপরাধ করতেই থাকে এবং বড় কোনো অপরাধ করার পর জানা যায় যে তারা আগেও বিভিন্ন অপরাধ ও কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল।'

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিশোর অপরাধ বাড়ার পেছনে সব স্টেকহোল্ডারেদের ভূমিকা আছে। মূলত সমাজের বিভিন্ন ছোটো ছোটো অপরাধ করতে করতেই কিশোররা বড় ধরনের অপরাধ করে থাকে। নৈতিক শিক্ষার অভাবে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। তাছাড়া পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে ভূমিকা রাখতে পারছে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীরও কিছু ঘাটতি আছে।'

কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'শুধু কিশোর অপরাধ নয়, সব ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে আমরা প্রতিনিয়তই কাজ করি। আমরা সামাজিক বিভিন্ন কর্মসূচি যেমন সাইক্লিং, ম্যারাথন, লিফলেট বিতরণসহ বিভিন্ন কাজ করছি।'

বড় ঘটনার পর কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি জানতে পারি, তার আগে জানা যায় না কেন—প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'কিশোর বয়সেই বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা দেওয়া, ধূমপান, ইভটিজিং, চুল বড় রাখা, দ্রুত গতিতে বাইক চালানো, মারামারিতে জড়িয়ে পড়া—এসব বিষয় তুচ্ছ মনে করে কেউ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানায় না। বড় কোনো ঘটনা হলে তারপরেই জানানো হয়। তাছাড়া, আমাদের যে লোকবল তা দিয়ে প্রতিটি এলাকায় তেমনভাবে নজরদারি করা সম্ভব হয় না। যদিও আমরা প্রতিটি এলাকার বিভিন্ন রিপোর্ট তৈরি করি। এসব কারণে কারা কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত তাদের তথ্য পাওয়া যায় না।'

কিশোর অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার কোনো সম্পর্ক আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এর সঙ্গে আধিপত্য বিস্তারের সম্পর্ক আছে। সমাজে যারা আধিপত্য বিস্তার করতে চায় তারা কিশোরদের নানাভাবে মদদ দেয় এবং তাদেরকে দিয়ে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অন্যায় কাজ করায়। অনেক সময় দেখা যায় তারা গ্রেপ্তার হলেও আদালত থেকে জামিন পেয়ে যায়। পরিবার ও ক্ষমতাবানরা অপরাধীদের দ্রুত জেল থেকে বের করতে নানা উপায় অবলম্বন করেন।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন খন্দকার ফারজানা রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিশোর অপরাধ অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। তবে কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি আলোচনায় আসে ২০১৭ সালের শুরুতে উত্তরায় স্কুল ছাত্র আদনান কবীর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। কিশোর গ্যাং বিস্তারের অন্যতম কারণ হলো সামাজিকভাবে তাদের প্রতিহত করার জায়গাটি অনেক দুর্বল। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারছে না।'

তিনি বলেন, 'ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থার কারণে অনেক সময় দেখা যায় শিশু-কিশোররা প্রয়োজনের সময় বাবা-মাকে পাশে পায় না। তাদের মনজাগতিক যে চাহিদা তা পূরণ হয় না। তখন ধীরে তারা আশেপাশের সমবয়সী বা সিনিয়র কোনো ভাইয়ের সঙ্গে মিশতে থাকতে। এভাবে তারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়। শুরু দিকে কিশোররা এই অপরাধগুলো উপভোগ করে এবং এক পর্যায়ে বড় ধরনের অপরাধে যুক্ত হয়।'

কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি বড় অপরাধ সংগঠিত হওয়ার আগে কেন সামনে আসে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'কেউ এগুলো রিপোর্ট করে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও তেমন একটা ভূমিকা রাখে না। পরিবারও বিষয়গুলো শুরুতে তেমনভাবে গুরুত্ব দেয় না। এ কারণেই আগে কোনো তথ্য জানা যায় না।'

কিশোর অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, 'অনেক সময় কিশোরদের নানা অপরাধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে জেলে যাওয়ার পর তারা আবার দ্রুত বের হয়েও আসে।'

'কিশোর অপরাধ কমাতে, তাদের শুধু জেলে দিলেই হবে না। মানসিকভাবে বিভিন্ন সহযোগিতা করতে হবে, কাউন্সিলিং করতে হবে, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা আরও জোরালো করতে হবে,' তিনি যোগ করেন।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিশোর অপরাধ কমাতে যারা দায়িত্বপূর্ণ জায়গায় আছে তাদের আগে শোধরাতে হবে। মসজিদ কমিটি থেকে স্কুল কমিটি, রাজনীতি, পরিবার সব জায়গায় দ্বন্দ্ব, মারামারি, কলহ। আমাদের শিশু কিশোররা এসব সংস্কৃতির মধ্যে বড় হচ্ছে। তাই তারাও নানাভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।'

Comments