সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ড: কম্বোডিয়ায় অগ্নিকাণ্ডের পরও সতর্ক হয়নি আল-রাজি কেমিক্যাল

গত মে মাসে কম্বোডিয়াগামী একটি জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়েছিল চট্টগ্রামের আল-রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সকে।
অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের পর ডিপোতে ছড়িয়ে পরে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডবাহী জেরি ক্যানগুলো। ছবি: রাজিব রায়হান

গত মে মাসে কম্বোডিয়াগামী একটি জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়েছিল চট্টগ্রামের আল-রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সকে।

তাদের পাঠানো হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের চালানে অননুমোদিত প্লাস্টিকের জেরি ক্যান (ছোট কনটেইনার) ব্যবহার করার কারণেই আগুন লেগেছে জানিয়ে গত মে মাসের শেষের দিকে সতর্কও করা হয়। কিন্তু তা আমলে না নিয়ে একই জেরি ক্যানে ৩৩ কনটেইনারে প্রায় ৪০০ টন হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড আনা হয় সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে। এসব কনটেইনার বিস্ফোরণ থেকেই ৪ জুন ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড কোনো দাহ্য পদার্থ নয়। তবে এটি আগুনের তীব্রতা বাড়াতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

আগুন এই হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ভর্তি জেরি ক্যানগুলোর সংস্পর্শে আসায় সেখানে একাধিক বিস্ফোরণ ঘটে, যা আগুনের তীব্রতা অনেক বেশি বাড়িয়ে তোলে। ফলাফল, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ৩ দিন সময় লেগে যায় এবং অন্তত ৪৬ জনের প্রাণহানি হয়।

এই দুর্ঘটনাটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল আল-রাজির। কারণ এর আগে গত মে মাসে একইভাবে কনটেইনারে আগুন লাগার ঘটনায় মার্কস (কম্বোডিয়া) লিমিটেড এর একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড পরিবহন ও সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক নিয়ম মানার অনুরোধ জানানো হয়েছিল।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে হাং হসিং গার্মেন্টস (কম্বোডিয়া) কোং-এর জন্য পাঠানো আল-রাজির একটি রপ্তানি চালান জাহাজে থাকা অবস্থায় আগুন ধরে যায়। জাহাজটি কম্বোডিয়ার সিহানউকভিল বন্দরে ছাড়পত্রের অপেক্ষায় ছিল।

অগ্নিকাণ্ডে জাহাজটির মেঝে পুরোপুরি পুড়ে গেছে এবং এর ছাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

কার্গো পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান কে২এ ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রতিবেদন অনুসারে, এই অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ ছিল অনুমোদনহীন জেরি ক্যানে ১০২ টন হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রাখা।

দ্য ডেইলি স্টারের কাছে গত ২৫ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির একটি অনুলিপি রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেরি ক্যানগুলো রাসায়নিকের কারণে সৃষ্ট চাপ ধরে রাখতে পারেনি। যার ফলে সেগুলো বিস্ফোরিত হয় এবং জাহাজে আগুন ধরে যায়।

জাহাজটিতে মোট ৩ হাজার ৪০০ জেরি ক্যান ছিল। যার প্রতিটিতে প্রায় ৩০ কিলোগ্রাম হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ছিল।

মে মাসের শেষ সপ্তাহে পরিদর্শন প্রতিবেদনটি আল-রাজি এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন মার্কস বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অফিসের অফিসার (অপারেশনস) মোহাম্মেদ চৌধুরী।

নিয়ম অনুযায়ী, দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়।

মোহাম্মদ চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কম্বোডিয়ায় দুর্ঘটনার পর আল-রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সকেও এ বিষয়ে জানানো হয়েছে। আমরা তাদেরকে পরিদর্শন প্রতিবেদনও দিয়েছি।'

যোগাযোগ করা হলে আল-রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের পরিচালক মুজিবুর রহমান পরিদর্শন প্রতিবেদনের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তিনি টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি কথা বলার মতো শারীরিক অবস্থায় নেই। ডাক্তার আমাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন।'

মুজিবুর রহমান আগুন লাগা বিএম কনটেইনার ডিপোরও একজন পরিচালক এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে অনুরোধ করেন, এ বিষয়ে কথা বলার জন্য যেন আল-রাজি ও বিএম ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর মূল সংস্থা স্মার্ট গ্রুপের মহাব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

স্মার্ট গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী কম্বোডিয়ার জলসীমায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি গুরুতর কিছু নয় বলে জানান।

তিনি বলেন, 'আমি আল-রাজি কেমিক্যালের দায়িত্বে না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি যে দুর্ঘটনাটি খুবই সামান্য। তারা বলেছেন, একটি কনটেইনার থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল।'

তিনি জানান, আল-রাজি কর্মকর্তারা মার্কসের তদন্ত বা অন্য কোনো তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতেন না।

'এই রাসায়নিকগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ প্লাস্টিকের জেরি ক্যানে রপ্তানি করা হচ্ছে। কম্বোডিয়ায় এর আগে কখনো কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি,' যোগ করেন তিনি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে আল-রাজি কেমিক্যাল বিএম ডিপো ব্যবহার করে ১২টি দেশে প্রায় ৯ হাজার ৬৩৫ টন হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রপ্তানি করেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএম ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর একজন কর্মচারী বলেন, যে চালানটিতে আগুন ধরেছে ও বিস্ফোরিত হয়েছে সেটি গত ৪ জুন দুর্ঘটনার অন্তত ৫ দিন আগে ডিপোতে এসেছে।

তিনি বলেন, 'কম্বোডিয়ায় দুর্ঘটনার পর কোনো শিপিং কোম্পানি প্লাস্টিকের জারে রাসায়নিক পরিবহন করতে রাজি ছিল না।'

এই কারণেই চালানটি অন্যান্য সাধারণ পণ্য পরিবাহী কনটেইনারের সঙ্গে ডিপোতেই রয়ে গেছে। যদিও রাসায়নিক পণ্যবাহী কনটেইনার পৃথক শেডে রাখার নিয়ম রয়েছে।

আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার শহীদুল ইসলাম বলেন, 'আমরা ডিপোতে রাসায়নিক থেকে লাগা আগুন নেভানোর জন্য কোনো অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম পাইনি এবং কোনো কনটেইনারে কোনো ধরনের সতর্কতামূলক স্টিকার নেই।'

তিনি জানান, ডিপোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা না থাকা, রাসায়নিক তথ্য গোপন করা এবং অরক্ষিত অবস্থায় রাসায়নিক রাখার কারণেই আগুন থেকে এই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে।

এই ঘটনার পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষসহ (সিপিএ) বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে পৃথক ৬টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Secondary schools, colleges to open from Sunday amid heatwave

The government today decided to reopen secondary schools, colleges, madrasas, and technical education institutions and asked the authorities concerned to resume regular classes and activities in those institutes from Sunday amid the ongoing heatwave

3h ago