যে কারণে বিশ্বজুড়ে টয়োটা এত জনপ্রিয়
ট্রাফিক জ্যামে বন্দি ঢাকা শহরের সড়কে নিত্য বসে টয়োটার মেলা। যেকোনো রাস্তায় তাকালে টয়োটার কোনো না কোনো গাড়ি চোখে পড়বেই, শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্ব বাজারের অন্যতম জনপ্রিয় গাড়ি এই টয়োটা।
বিজ্ঞানের বহু আবিষ্কারে জাপানের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও গাড়ির বাজারে ইউরোপ-আমেরিকার প্রভাব বরাবরই বেশি ছিল। তবে জার্মানি, আমেরিকা, কিংবা যুক্তরাজ্যের বাঘা বাঘা কোম্পানির গাড়িকে পেছনে ফেলে তুলনামূলক নবীন কোম্পানি হিসেবে জাপানের টয়োটা বেশ কয়েকবার শীর্ষ গাড়ি বিক্রেতার মুকুট দখলে নিয়েছে।
টয়োটার নামকরণ
'জিদোকা', জাপানের এই শব্দ ইংরেজিতে অটোমেশন এবং বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়ায় 'স্বয়ংক্রিয়তা'। বিংশ শতকের গোঁড়ার দিকে এক জাপানি শিল্পপতির হাত ধরে শব্দটি পরিচিতি পায়। এটা আসলে একটা পদ্ধতির নাম, যা এই শিল্পপতি তার তাঁত শিল্প 'টয়োটা অটোমেটিক লুম' শিল্পের মেশিনের কার্যকারিতা মূল্যায়ন ও মান নিয়ন্ত্রণ বোঝাতে ব্যবহার শুরু করেন। এই শিল্পপতির নাম সাকিচি টয়োডা', হ্যাঁ, এই টয়োডা থেকেই বর্তমান অটোমোবাইল জায়ান্ট টয়োটা মটর করপোরশনের নামকরণ করা হয়েছে। যা ২০২১ সালে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ শেয়ার নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি ব্র্যান্ডগুলোর র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ অবস্থান দখল করে নেয়।
মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার পেছনে যে আবিষ্কারগুলোর অবদান সর্বোচ্চ, তাদের মধ্যে চাকা অন্যতম। মানুষ ও পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থায় গতির সঞ্চার করেছে চাকা, যা আবার যন্ত্রের সংযোজনার মাধ্যমে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে ঝড়ের গতিতে। বর্তমান যুগে গাড়ির বিকল্প ভাবাও অসম্ভব। মানুষের দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততার নিত্য সারথি গাড়ি, যাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসা, অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি। এই ইন্ডাস্ট্রিতে দাপটের সঙ্গে অবস্থান করছে জাপানি ব্র্যান্ড টয়োটা, যা কি না এককালে তাঁত শিল্প থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল।
টয়োটার উত্থান
গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ভয়াবহ কান্টো ভূমিকম্প, এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে জাপানের তাঁতশিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। অন্যদিকে, ভূমিকম্পের প্রভাবে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হলে জাপানে গণপরিবহণসহ গাড়ির ব্যাপক চাহিদার সৃষ্টি হয়, ফলে দেশটি ফোর্ড মটর কোম্পানির কাছ থেকে বাসের জন্যে চেসিস আমদানি শুরু করে।
সাকিচির ছেলে কিচিরো টয়োডা ১৯৩৩ সালে টয়োডা অটোমেটিক লুম ওয়ার্কসের একটি ডিভিশন হিসেবে টয়োটা অটোমোটিভ প্রোডাকশন ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করেন। গাড়ি শিল্পে শূন্য অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি গাড়ি উৎপাদনের একটা ফ্যাসিলিটি চালুর পরিকল্পনা করেন। এ কারণে ফোর্ড, শেভ্রোলেট, কিংবা ক্রাইসলারের গাড়িগুলো আমদানি করে নতুন এক মডেলের সন্ধান করেন। এই ৩টার সংমিশ্রণে গাড়ির মডেলটির নকশা ও উৎপাদনের জন্য দেশের বিভিন্ন গাড়ি কারখানা, জেনারেল মটরসসহ অন্যান্য বিদেশি কোম্পানির সাবসিডিয়ারিগুলোতে কর্মরত সব প্রকৌশলীদের তার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেন।
এভাবেই যাত্রা শুরু হয়েছিল আজকের টয়োটার। যার ফলে ১৯৩৬ সালে এসে তারা তাদের প্রথম 'মডেল এএ' গাড়িটি বাজারে ছাড়ে। পরের বছর, ১৯৩৭ সালে এসে গঠিত হয় টয়োটা মটর। একই বছর জাপান অক্ষ শক্তি হিসেবে অংশ নেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, যা টয়োটার জন্য ব্যাপক বিপর্যয় টেনে আনে। উৎপাদনে লাগাম টানা, যুদ্ধের সরঞ্জাম তৈরি, কাঁচামালের সংকট এমনকি যুদ্ধে একটা কারখানাও ধ্বংস হয়ে যায়।
এমন ভয়াবহ অবস্থা থেকে উঠে এসে বর্তমান বিশ্বের অটোমোবাইল শিল্পের সর্বোচ্চ স্থানে অধীন হওয়া খুব সহজ ছিল না। জাপানিদের মেধা ও সততার পাশাপাশি বিশেষ কিছু কৌশল ও সুযোগ কাজে লাগিয়োই টয়োটা আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে। সেসব কৌশল নিয়েই আজকের আলোচনা।
কোরিয়া যুদ্ধ
পৃথিবীতে জাপান একমাত্র দেশ যারা পারমাণবিক হামলার শিকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তছনছ হয়ে যাওয়া জাপানের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করে। দেশ গঠনের কাজে টয়োটা তখন ট্রাক নির্মাণের দিকে ঝুঁকেছিল। গাড়ি শিল্পে টয়োটার মতো এক অনভিজ্ঞ কোম্পানির জন্য ঠিক তখনই আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল কোরিয়া যুদ্ধ। সিএনবিসির তথ্যসূত্রে, যুদ্ধের প্রভাবে মাসে ৬৫০টি থেকে হাজার খানেক গাড়ি উৎপাদন শুরু করে টয়োটা।
কোরিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও নিকট নজরদারির জন্য জাপানের বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যে কারণে দরকার পড়ে বিপুল পরিমাণে যানবাহনের, বিশেষ করে ট্রাক। এই সুযোগটাই দরকার ছিল টয়োটার, ততদিনে কোম্পানির নির্বাহী কর্মকর্তারা আমেরিকার বিভিন্ন গাড়ি কারখানা সফর করে কারিগরি ও ব্যবস্থাপনার বিষয়টি রপ্ত করে আসে। কোরীয় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মার্কিন সামরিক বাহিনী থেকে টয়োটা বিপুল পরিমাণের ক্রয়াদেশ লাভ করে, যা প্রতিষ্ঠানটিকে একটা মজবুত ভিত গড়ে দেয়।
টয়োটার নীতি ও মূল্যবোধ
জাপানিদের সংস্কৃতি, নীতি, মূল্যবোধ এখন জগৎবিখ্যাত। টয়োটার ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে উৎপাদন কৌশলে সেসব মূল্যবোধের দারুণ চর্চা হয়। প্রতিটি ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়াটা বুদ্ধিদীপ্ত কাজ, টয়োটার নীতিমালায় এই শিক্ষা নেওয়ার বিষয়টা উল্লেখ করা আছে।
কোম্পানিটি শুরু থেকেই একটি গাইডিং নীতি হিসাবে টিমওয়ার্কের ওপর জোর দিয়েছে। যখন একটি সমস্যা দেখা দেয়, দলের প্রতিটি সদস্য নিজেদের দায়ী ভেবে দলবদ্ধ হয়ে একটি সমাধান খুঁজে বের করার তাগিদ অনুভব করে। ফলে, যেকোনো ভুলের দায় যেমন সবার, তেমন যেকোনো সাফল্যের ভাগীদার ও সবাই। এই চর্চাটা মূলত কারখানার মেঝেতে শুরু হয়ে পুরো করপোরেশনে ছড়িয়ে পড়েছে।
এ ছাড়া টয়োটার প্রতি মানুষের আস্থাটা তৈরির আরেক মূল কারণ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির 'গ্রাহক-পাইকার-উৎপাদক' সম্পর্ক। টয়োটার কাছে এর সাফল্য পাইকার এবং গ্রাহকদের আস্থা বজায় রাখার ওপর নির্ভর করে। এটা হতে হবে সুসম্পর্ক যা দীর্ঘস্থায়ী হবে।
'আজকের থেকে আগামীকাল আরও ভালো হবে', টয়োটার দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের অন্যতম একটি কারণ প্রতিষ্ঠানটির এমন আশাবাদী নীতি। এখানে কর্মীদের মনস্তত্বকে এমনভাবে প্রশিক্ষিত করা হয় যাতে তারা সব বাধাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখে আরও ভালো করতে উৎসাহিত হয়। তারা সফল হওয়া মানেই সন্তুষ্টি অর্জনে বিশ্বাসী না, ক্রমাগত উন্নয়ন, আগামীকালকে আজকের চেয়ে আরও ভালো কিছু করার বিশ্বাস তাদেরকে উন্নত করতে সহায়তা করে। যা অনেকের কাছে কাইজেন-এর প্রভাবিত মনোভাব।
জাপানি ব্যবসার বহুল ব্যবহৃত কাইজেন দর্শন, সাচিকি টয়োডা'র জিদোকা' পদ্ধতি, গেঞ্চি জেনবুতসুসহ নানামাত্রিক পদ্ধতি ও নীতি অনুস্মরণ করে আসছে টয়োটা, যা সম্মিলিতভাবে প্রতিষ্ঠানটির টয়োটা প্রোডাকশন সিস্টেম (টিপিএস) হিসেবেও পরিচিত।
টিপিএস
টিপিএস হচ্ছে টয়োটা প্রোডাকশন সিস্টেমের সংক্ষিপ্ত রূপ, যাকে প্রতিষ্ঠানটির মূলমন্ত্র হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। আর এর সঙ্গে জড়িত আছে প্রতিষ্ঠাতার নীতি জিদোকা। গাড়িতে যখন কোনো অস্বাভাবিকতা ঘটবে তখনই এটাকে নিরাপদে থামাতে হবে। ত্রুটি খুঁজে বের করতে হবে, মূল সমস্যার সমাধান না হওয়া, নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত যন্ত্রটির উন্নতি করাকে জিদোকা বলে। টিপিএস-এর ক্ষেত্রে এটা প্রথম ধাপ হিসেবে দেখা হয়।
এরপর আসে কাইজেন বা নিরন্তর উন্নতি ধাপ। যার মাধ্যমে প্রোডাকশনের প্রতিটা কাজের অনবরত উন্নয়ন ঘটানো হয়। কাইজেন শব্দটিও জাপানি যা কাই (উন্নয়ন) ও জেন (ভালোর জন্য) শব্দের সংমিশ্রণ। সার্বিকভাবে কাইজেন শব্দের অর্থ ক্রমাগত উন্নয়ন। টয়োটার প্রোডাকশন সিস্টেমে কাইজেন খুব গুরুত্ব সহকারে অনুস্মরণ করা হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উৎপাদনের একটি কাজ ১০ মিনিটে করা সম্ভব, টয়োটা প্রথমে তা ৮ মিনিট, পরে ৬ মিনিট, এভাবে একদম সর্বনিম্ন সময়ে করার ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যায়। এই পথে তারা সব ভুল খুঁজে বের করার চেষ্টা করে, সেই ভুলের মূলে যে কারণ তা উদঘাটন করে সংশোধন করে এবং সেটার নিরন্তর উন্নতির মাধ্যমে কাজটি নির্ভুল অবস্থায় রূপ দেয়। টয়োটার সাফল্যের মূলে তাই টিপিএসকে বিবেচনা করা হয়, যা বিশ্বের অধিকাংশ অটোমোবাইল কোম্পানি থেকে শুরু করে অন্যান্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও অনুস্মরণ করে।
উন্মুক্ত যোগাযোগ
জাপানের বাইরে প্রতিষ্ঠানটির অন্তত ৫০টি কারখানা আছে যা থেকে ১৭০টির বেশি দেশে গাড়ি বিক্রি করা হয়। আর এই কাজে কর্মরত আছে ৩ লাখের বেশি শ্রমিক। এত বিশাল কর্মযজ্ঞ এবং লোকবলের পরও টয়োটা যেন একটা ছোট্ট শহরের মতো কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ নির্বাহীদের বিশ্বাস, প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাজ সম্পর্কে অবগত।
এখানে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা হয়। শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে একদম প্রান্তিক শ্রমিক, ক্রেতা থেকে পাইকার, কিংবা সরবারহকারী, সবার মধ্যে তথ্য অবাধে প্রবহমান। টয়োটাতে ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়, আর এই যোগাযোগ ভার্চুয়ালের পরিবর্তে একটু বেশি মানবিক।
কর্মচারীদের মতামত প্রকাশের জন্য এখানে উন্মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়, তাদের কথা মনোযোগ সহকারে শুনতে হয়। যার ফলে একটা সম্পর্কের জাল সৃষ্টি হয়েছে, যাকে এর প্রাক্তন নির্বাহী ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইয়োশিমি ইনাবা 'স্নায়ুতন্ত্র' বলে অভিহিত করেছেন। মানবদেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের মতো, টয়োটা পুরো সংস্থায় দ্রুত তথ্য প্রেরণ করে।
টয়োটার উত্থান ও সাফল্যের পেছনে এমন আরও বহু কারণ রয়েছে। যার মধ্যে ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে বর্তমানে দেশটির সর্বাধিক বিদেশি গাড়ি বিক্রেতায় পরিণত হওয়া অন্যতম। টয়োটা মূলত আকারে ছোট এবং সাশ্রয়ী গাড়ি দিয়েই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
ক্রমাগত জ্বালানির দাম বাড়ার প্রভাবে গ্রাহকরা মার্কিন ও জার্মান গাড়িগুলোর থেকে তুলনামূলক সস্তা গাড়ির দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। টয়োটা তাদের মডেল ও ইঞ্জিনকে এভাবেই উন্নত করেছে। বিভিন্ন অঞ্চলের পরিবেশ, সংস্কৃতি, এবং সুবিধা বিবেচনায় রেখে একেকটি মডেল বের করেছে, যা প্রতিষ্ঠানটিকে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে।
টয়োটার এসইউভি থেকে শুরু করে লেক্সাসের জনপ্রিয়তা উন্নত বিশ্বে ব্র্যান্ডের কদর অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। এশিয়ার গ্রাহকদের কাছে দাম ও মানের সমন্বয়ে টয়োটার থেকে বেশি আস্থা কেউ অর্জন করতে পারেনি। আর এর ফলে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ১০টা গাড়ির মধ্যে অন্তত একটা টয়োটা করোলার দেখা মিলবে, যা ১৯৬৬ সালে বাজারে আসে। সেই থেকে ১২ প্রজন্মের করোলা মডেল ২০২১ পর্যন্ত ৫ কোটির বেশি ইউনিট বিক্রি নিয়ে বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত গাড়ির মডেলে পরিণত হয়েছে।
তথ্যসূত্র: সিএনবিসি, সিএনএন, ফোর্বস, স্ট্যাটিস্টা, হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ, টয়োটা, ইনভেস্টোপিডিয়া
Comments