অনন্য প্রতিভাবান শিল্পী কমল দাশগুপ্ত

‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রাণী/তোমারই দুয়ারে কুড়াতে এসেছি ফেলে দেওয়া মালাখানি’, প্রখ্যাত গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর লেখা বিখ্যাত এ গানটি যার জীবনে বাস্তব উদাহরণ হিসেবে এসেছে, তিনি কমল দাশগুপ্ত।
কমল দাশগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত

'ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রাণী/তোমারই দুয়ারে কুড়াতে এসেছি ফেলে দেওয়া মালাখানি', প্রখ্যাত গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর লেখা বিখ্যাত এ গানটি যার জীবনে বাস্তব উদাহরণ হিসেবে এসেছে, তিনি কমল দাশগুপ্ত।

মজার বিষয় হলো গানটির সুরারোপ করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত নিজেই। কে জানতো গানের প্রথম দুই লাইন তার জীবনের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে মিশে যাবে। ভালোবাসতে গিয়ে ভিখারি হয়েছিলেন। 

যে কমল দাশগুপ্ত নজরুলের ৩ শতাধিক গানসহ সারা জীবনে ৮ হাজার গানে সুরারোপ করেছেন। ১৯৪৬ সালে যে কমল দাশগুপ্ত কেবল ৩৭ হাজার টাকা আয়করই দিয়েছিলেন। আবার এক সময় দেউলিয়া হয়ে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন। জীবিকার তাগিদে বসতে হয়েছিল মুদি দোকানে। মৃত্যু হয়েছিল চূড়ান্ত অবহেলায় ও একপ্রকার বিনা চিকিৎসায়। তার জীবন যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, একদিকে যেমন সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে দেখেছেন বাস্তবতার রণক্ষেত্র।

সঙ্গীত পরিবেশন করছেন কমল দাশগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত

জন্মেছিলেন নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ের বেন্দা গ্রামের এক সঙ্গীত পরিবারে। বাবা তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত ছিলেন ভীষণ সঙ্গীত অনুরাগী। বাড়িতে নিয়মিত জলসা বসতো।  শৈশবে বাবার কাছেই পেয়েছিলেন সঙ্গীতের তালিম। পরবর্তীতে বড়দা বিমল দাশগুপ্তের কাছে ‌'খেয়াল'-এ হাতেখড়ির মধ্য দিয়ে সঙ্গীত জীবন শুরু। এক সময় নড়াইল ছেড়ে তারা চলে যান কলকাতায়। 

মানিকতলায় যে বাড়িতে থাকতেন, সে বাড়ির নিচতলায় ছিল বাবার গুপ্ত প্রেস। বিমল দাশগুপ্তের সঙ্গে নজরুলের ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। যে কারণে তাদের বাড়িতে নিয়মিতই যাতায়াত ছিল নজরুলের। ত্রিশের দশকে তার পরিবার কলকাতা ছেড়ে কুমিল্লায় চলে আসলেও পরবর্তীতে আবার ফিরে গিয়েছিল কলকাতায়। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় কমল দাশগুপ্ত খেয়াল, ঠুমরি, দাদরা ও গজলে তালিম পেয়েছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁ, দীলিপ কুমার রায় ও কৃষ্ণচন্দ্র দে'র কাছে। 

নজরুলের সঙ্গে একসময় গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক থাকলেও ক্রমশ তা পরিণত হয় গভীর বন্ধুত্বে। তাদের ৩ ভাই সুরারোপ করেছিলেন নজরুলের গানে। ভাইদের মধ্যে তিনি এবং সুবল দাশগুপ্ত ছিলেন সবচেয়ে প্রতিভাবান। অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে দুজনই হয়েছিলেন প্রথম।  

নিজের গানে নিজেই সুরারোপ করতেন নজরুল। কদাচিৎ নজরুলের সুরারোপের সময় না থাকলে অন্যরা সুযোগ পেতেন। সুরারোপ করতে গিয়ে ধীরে ধীরে কমল দাশগুপ্ত হয়ে উঠেন নজরুলের আস্থাভাজন সুরকার। ৮ বছরে নজরুলের ৩ শতাধিকের বেশি গানে সুরারোপ করেছিলেন। ১৯৪২ সালে বাকশক্তি হারোনোর পর থেমে যায় নজরুলের সৃষ্টি।

সালটা ১৯৩৪। একদিন নজরুল যূথিকা নামের একটি মেয়ের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তার গান রেকর্ড করার জন্য নিয়ে এলেন গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভিতে। কিন্তু সেই রেকর্ড গ্রামোফোন কোম্পানির বোর্ডে পাশ হলো না। কোম্পানির ডিলাররাই তখন ছিলেন বোর্ডে। তাদের সাফ জবাব, এই গান বাজারে চলবে না। এ ঘটনার ঠিক এক বছর পরের কথা। এইচএমভিতে সদ্য যোগ দিয়েছেন কমল দাশগুপ্ত। একদিন স্টুডিওতে বসে ছিলেন কমল দাশগুপ্ত ও গীতিকার প্রণব রায়। নজরুল যূথিকাকে নিয়ে সরাসরি স্টুডিওতে ঢুকলেন।

স্ত্রী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে কমল দাশগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত

নজরুলের অনুরোধেই কমল দাশগুপ্ত যূথিকার গান রেকর্ডের সিদ্ধান্ত নিলেন। তার গানের খাতাটা টেনে প্রণব রায়ের লেখা দুটো গান লিখে দিলেন। শেখানোর আগে কমল দাশগুপ্ত যূথিকাকে বললেন, 'আমরা এমন গান তৈরি করতে চাইছি, যা হবে সহজ কথায় সুরে-মেলোডিতে ভরা রোমান্টিক বাংলা গান। এ জন্যে তোমার মতো কণ্ঠ  আমার দরকার। যেখানে শাস্ত্রীয়-সঙ্গীতের শিক্ষার ছোঁয়া থাকবে, কিন্তু কখনো তা প্রকট হবে না। গান এমন হবে, যা শুধু সমঝদারদের মধ্যে নয়, ছড়িয়ে পড়বে সব বাঙালির মনে।'

কমল দাশগুপ্তের সুরে যূথিকা রায়ের গাওয়া রাগ ভৈরবীতে 'আমি ভোরের যূথিকা' ও রাগ ইমনকল্যাণে 'সাঁঝের তারকা আমি' গান দুটির রেকর্ড করা হলো। মাত্র ৩ মাসের মধ্যে 'ভোরের যূথিকা' বিক্রি হয়েছিলো ৬০ হাজার কপির বেশি। রাতারাতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল কিশোরী যূথিকা। মজার বিষয় হলো সেবারও এই রেকর্ডটি বোর্ডের ডিলাররা প্রথমে নিতে চায়নি।

বাংলা গানের তখন ছিল স্বর্ণযুগ। হিজ মাস্টার্স ভয়েজের (এইচএমভি) রেকর্ডের ছিল আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। একপর্যায়ে হিজ মাস্টার্স ভয়েজে তবলা বাদক হিসেবে যোগ দেন কমল দাশগুপ্ত। সেখানেই অনাদি দস্তিদার ও ব্রজেন গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও অর্কেস্ট্রার পরিচালক নিউম্যানের কাছে পাশ্চাত্য সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয়েছিল কমল দাশগুপ্তের।

চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের প্রথম ভাগে কমল দাশগুপ্তের এতটাই জনপ্রিয়তা ছিল যে,  মাসে গড়ে ৫০টি গানে সুর দিতেন। তখন তার পারিশ্রমিকও ছিল আকাশচুম্বী। জানা যায় ১৯৪৬ সালে মোট ৩৭ হাজার টাকা আয়কর দিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত। গাড়ি ছাড়া চলার কথা কল্পনাও করতে পারতেন না।

১৯৫৫ সালে তার ছাত্রী প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ফিরোজা বেগমকে বিয়ে করেন কমল দাশগুপ্ত। বিয়ের ৪ বছর পর ধর্মান্তরিত হয়ে গ্রহণ করেন ইসলাম।  

বলে রাখা ভালো, কেবল এইচএমভির জন্যই কমল দাশগুপ্ত সুরারোপ করেছিলেন সাড়ে ৭ হাজারের বেশি গান। ৭ হাজার গানের পূর্তিতে রজত জয়ন্তী পালন করেছিল এইচএমভি কোম্পানি। হায়দরাবাদের নিজামের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ গানও রেকর্ড করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের সঙ্গীতেও সুরারোপ ছিল তার। প্রথম বাঙালি হিসেবে উর্দু ভাষায় কাওয়ালী গেয়েছিলেন তিনি। 

সংগীতের এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে পদার্পণ ঘটেনি কমল দাশগুপ্তের। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, গজল, ভজন, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, হামদ, নাথ, নজরুল গীতি, রবীন্দ্র সঙ্গীত ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতসহ সঙ্গীতের সর্বত্রই ছিল তার বিচরণ। তার হাত ধরে উঠে এসেছিলেন অসংখ্য শিল্পী। ৮০টি বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক। বাংলা ও হিন্দি উভয় ভাষার চলচ্চিত্রেই শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ৫বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত।

এত সাফল্যের পর তিনি দেখেছিলেন মুদ্রার অপরপিঠও। পঞ্চাশের দশকের শেষের  দিকে নাথ ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলে একমুহূর্তেই সমস্ত জমানো অর্থ হারান কমল দাশগুপ্ত। এদিকে ততদিনে কাজও কমে গেছে ৯০ ভাগ। ইতোমধ্যে মরফিনের নেশা ধরেছেন, যার প্রভাবে ভয়াবহ পেটের যন্ত্রণার জন্য ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত ইনজেকশন দিতে হতো। আর্থিক ও মানসিকভাবে কমল দাশগুপ্ত তখন চরমভাবে বিপর্যস্ত। 

পত্রিকার প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল কমল দাশগুপ্তের দুরবস্থার চিত্র

১৯৬৭ সালে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। জীবিকার তাগিদে তাকে মুদি দোকান খুলতে হয়েছিল। একবার পত্রিকার প্রতিবেদনে তার দুরবস্থার কথা উঠলে বাংলাদেশ বেতারের গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী শহীদুল ইসলামের চেষ্টায় বেতারে ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস বিভাগে প্রধান সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তাকে। বাংলা একাডেমি থেকে তখন বের হয়েছিল ফিরোজা বেগমের 'নজরুল গীতিমালা'। স্বরলিপির শর্টহ্যান্ড পদ্ধতির উদ্ভাবকও ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। ফিরোজা বেগমের সেই বইতে স্বরলিপির চিহ্ন তৈরি করেছিলেন।

একটা পর্যায়ে ফের আগের অসুস্থতা ফিরে আসে কমল দাশগুপ্তের। শারীরিক অবস্থা হয়ে উঠে শোচনীয়। মরফিনের নেশা আর শারীরিক দুরবস্থার কারণে তখন চাকরি ছেড়েছিলেন। একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় আর চূড়ান্ত অবহেলায় ১৯৭৪ সালে আজকের দিনে চিরতরে চলে গিয়েছিলেন এই অনন্য প্রতিভাবান শিল্পী।
 
 

তথ্যসূত্র
১. কমল দাশগুপ্ত স্মরণে: অরুণ সেন 
২. সুরকার কমল দাশগুপ্ত: কল্যাণবন্ধু ভট্টাচার্য
৩. বাংলা গানে কমল স্পর্শ: অভীক চট্টোপাধ্যায় শারদীয় আজকাল, ১৪১৯ 
৪. কমল দাশগুপ্ত: হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে/আবুল আহসান চৌধুরী

 

Comments