নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ আয়নায় দেশকে চেনা
শতবর্ষী 'বিদ্রোহী' কবিতার মূল শক্তি অন্তর্নিহিত ভাবসম্পদকে সাক্ষী রেখে গভীরভাবে দেশকে চেনায়। কোন দেশ—যে দেশ পরাধীন, যে দেশে জারি ছিল ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ। এ কারণেই ঘরে ফিরেই নজরুল লিখলেন 'বিদ্রোহী' কবিতা। কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' কবিতার অ্যাকাডেমিক পাঠের বাইরে গিয়ে নন অ্যাকাডেমিক পাঠও জরুরি তথা আবশ্যক। যদিও এখন পর্যন্ত এই কবিতার পাঠমাত্রই মন্ত্রপাঠের মতো মুখস্থ বুলিই আউড়ানো হয়েছে।
বিস্ময়ের হলেও এটাই সর্বাংশে সত্য যে, ব্রিটিশ হটিয়ে, পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে যে স্বাধীন দেশে আমরা বসবাস করছি, সেই দেশের পড়াশোনায় বৌদ্ধিক প্রতিষ্ঠানসমূহে এখনো জারি আছে সেই ঔপনিবেশিক শক্তির ভূত ও তাদের বশংবদেরা। ঔপনিবেশিক শক্তির ভূতেরা থাকা মানে অশুভ-অকল্যাণকর-অমানবিক-অন্যায্য এ সকল কিছুরই হাজির থাকা। কারণ, সে একই অঙ্গে হাজির-নাজেল রাখে সবাইকে, সকল অশুভ শক্তিসমূহকে। গভীরতর বেদনা ও অসীম লজ্জার বিষয় এই যে, দৃশ্যমান বাস্তবতায় এই অদৃশ্যলোকের ভূতেরা এতটাই ভর করে আছে যে, আমরা বুঝতেও অপারগ হয়ে উঠেছি তাদের আছর। ফলে, ভূতময় সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা কেবলই করছি ভূতেরই জিকির এবং তাদের শেখানো-দেখানো-জানানো কৌশলের মধ্যেই খুঁজছি আমার আমিকে। শতবর্ষ আগে যে আমি'র সন্ধান দিয়েছিলেন-উদ্গাতা হয়েছিলেন নজরুল উপমহাদেশ কাঁপানো এক কবিতায়।
'বিদ্রোহী'র নানান আলোচনায় কেবলই খোলতাই করা হয় তার বামনত্ব এবং মুখস্থ ধারাপাতের বিবিধ ভঙ্গির কোশেশ। ভেবে দেখা হয় না, সৈনিক জীবন থেকে ফিরে নজরুল কেনো এরকম একটা কবিতা লিখলেন। অথচ এই কবিতার মূল তাৎপর্য নিহিত আছে কবির ঘরে ফেরা পরবর্তী উপলব্ধিজাত বোধ ও বোধির প্রত্যয়ে।
'বিদ্রোহী' কবিতা আক্ষরিক অর্থেই কাজী নজরুল ইসলামের শ্রেষ্ঠ কবিতা ও সিগনেচার পোয়েম। এই কবিতার শক্তি, সাহস, সৌন্দর্য ও অমরত্বের নেপথ্য কারণ হলো এর বহুধা ও বিস্তৃত পাঠের সুযোগ। নানাভাবে বোঝাপড়ার যে আয়না পাঠকের সামনে হাজির করে এবং জারি রাখে শতবর্ষী 'বিদ্রোহী', তা শুধু অতুলনীয় নয়, তুলনারহিতও বটে। শত বছর পেরিয়েও একটা কবিতা যেভাবে এবং যতোভাবে স্মরিত ও আলোচিত হচ্ছে তা অন্য কোনো কবিতার ক্ষেত্রে ঘটেনি। বাংলা ভাষায় তো বটেই, পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষার কোনো কবিতা এই উষ্ণীষ ও তিলকপ্রাপ্তির সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছে কিনা জানা নেই। এরকম গৌরবের অধিকারী যে কবিতা, সেই কবিতার মূল শক্তি কী, কী তার অক্সিজেন—সেই প্রশ্নের বোধ করি একটাই জবাব। তা হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা হলো দেশকে চেনার ব্যাকরণ।
বিদ্রোহী কবিতা লেখা হয়েছে ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে। এই ডিসেম্বর বাঙালির জীবনে অসম্ভব এক গুরুত্বপূর্ণ মাস। কেন?- সেই কথা বলছি একটু পরে। তার আগে বলে নেওয়া প্রয়োজন ১৯২১ সাল কেনো গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য তারও আগে দেখে নেয়া প্রয়োজন উপমহাদেশের সন-তারিখ পঞ্জির আলোকে ১৯২১ পূর্ববর্তী ঘটনার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শুধু বাংলায় নয়, উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্যও অস্তমিত হওয়ার ক্ষণ হাজির হয় এবং স্বল্পসময়ের মধ্যে পুরো ভারত ব্রিটিশদের কাছে পরাধীনতার দাসত্ব বরণ করে নিতে বাধ্য হলো। তার ঠিক একশ বছর পরে এই উপমহাদেশে সংঘটিত হলো সিপাহী বিদ্রোহ। এই মহাবিদ্রোহের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে প্রথমবারের মতো একটা জাগরণ ঘটল, কিন্তু জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটলো না। তার জন্য অপেক্ষা করতে হলো বিংশ শতকের সূচনা পর্যন্ত। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের হিন্দু ও মুসলমান প্রথমবারের মতো তাদের সম্মিলিত শক্তির সঙ্গে পরিচিত হলো। ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহসহ আরও কিছু বিদ্রোহে এই শক্তির প্রকাশ ঘটলেও তা সীমায়িত ছিল বিশেষ বিশেষ অঞ্চল ও এলাকাসমূহে। কিন্তু তা সর্বভারতীয় রূপ পরিগ্রহ করেনি। মহাবিদ্রোহের মধ্য দিয়ে সংগ্রামের সর্বভারতীয় রূপ প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান হলো- তা সে যত ছোট কলেবরেই হোক না কেন।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে সর্বৈবরূপে দৃশ্যমান হলো জাতীয়তাবাদের স্বরূপ ও শক্তি। বঙ্গভঙ্গ ও পরবর্তীতে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘটনায় হিন্দু-মুসলমানের মিলন ও ফাটলের দ্বৈতরূপ প্রকাশ পেলেও এর সবচেয়ে বড়ো অর্জন হলো জাতীয়তাবাদের সর্বজনীন স্বরূপ প্রত্যক্ষরূপে হাজির হওয়া এবং বাঙালির এই জাতীয়তাবাদেরই শক্তিই সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের আকাঙ্ক্ষারূপে হাজির হয়েছে। তারও আগে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে কংগ্রেস এবং তারও বিশ বছর পর মুসলিম লীগ।
উপমহাদেশে যখন এসব ঘটনা ঘটছে নানা চাপানউতোরের মধ্য দিয়ে, তখন বিশ্বজুড়ে দানা বাঁধছে নতুন ডামাডোল। বিশ শতকের সূচনাতেই বিশ্বকে মুখোমখি হতে হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। যে যুদ্ধের একজন সৈনিক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, হাবিলদাররূপে। এক্ষণে, স্মরণ করা যেতে পারে তার জন্মক্ষণ উনবিংশ শতকের একেবারে শেষের বছরে-১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। মারা যান নতুন শতকের পৌনে শতাব্দী পূরণ হওয়ার লগ্নে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট।
নজরুলের আয়ুষ্কাল পূর্ণতা পেলেও তা সৃজনসময় ছিল একেবারে স্বল্প সময়ের জন্য। মাত্র বিশ বছর কিংবা তার চেয়ে সামান্য একটু বেশি। কিন্তু এই বিশ বছরে তিনি যা ফলিয়েছেন তা যেমন আবেদন-নিবেদন ও সার্থক সৃষ্টি হিসেবে অনন্য, তেমনি পরিমাণগত দিকেও মোটেই কম নয়। এটা সম্ভব হয়েছিল এই কারণে যে, নজরুল সৃষ্টিতেও ছিলেন বাঁধভাঙ্গা এবং ঊর্মিমুখর। এর পেছনে সহজাত প্রতিভা বলে একটা বিষয় যুক্ত থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু যে বিষয়টা স্বীকার করতে হবে কোনোপ্রকার ওজর-আপত্তি ব্যতিরেকেই, সেটি হলো, নজরুল বোধ ও সৃজনশীলতায় ছিলেন বিরলপ্রজ প্রতিভা। সেই প্রতিভার কালজয়ী স্বাক্ষর হলো তার ভুবনজয়ী সৃষ্টি 'বিদ্রোহী' কবিতা।
তখন বঙ্গভঙ্গের কাল শেষ হয়েছে, কিন্তু আগুন জ্বলছে ধিকিধিকি। শেষ হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, কিন্তু তার চাপ ও তাপ রয়ে গেছে বিশ্বজুড়ে। সেই যুদ্ধের সম্মুখ সমরের একজন সৈনিক নজরুল তখন সবে ঘরে ফিরেছেন-কিন্তু সর্বান্তে উপলব্ধি করছেন শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়নের নিগুঢ় নিগ্রহ। এসবে কবির সংবেদনশীল মন তখন ভীষণভাবে ব্যথিত।
ঠিক তার আগে আগে ঘটল নিষ্ঠুর-নির্মম এক হত্যাকাণ্ড। পরাজয় ঘটল মানুষের শুভ শক্তির সত্য উন্মোচনের নিবেদিত প্রয়াস ও প্রচেষ্টা। ১৯১৯ সালে ১৩ এপ্রিলে ঘটলো হৃদয়বিদারক এক ঘটনা। ইংরেজ জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে নির্মমভাবে খুন করা হলো কয়েক শত মানুষকে। অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরের এই ঘটনা জানান দিলো ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে মানুষের প্রাণ কতো তুচ্ছ। যেন তা চাইলেই উড়িয়ে দেয়া যায় হাওয়ার ফুঁৎকারে। সরকারের হিসেবেই মারা যায় ৩০০ মানুষ, আহত হয় দেড় হাজারের অধিক।
ঔপনিবেশক শাসকবর্গের ধারণা হয়েছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে যে জাতীয়তাবাদ জেগে উঠেছে ভারতজুড়ে, তাতে ৬০ বছর আগে সংঘটিত হওয়া সিপাহী বিদ্রোহের মতো সর্বভারতীয় বিদ্রোহ ছড়িয়ে যেতে পারে। এই আশঙ্কাতেই সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে সংঘটিত হয় জালিওয়ানওয়ালাবাগের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। একদিকে মানুষের এই নিষ্ঠুরতা, অন্যদিকে মানুষের বেদনাহত মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে পুরো দেশ। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায় মানবিক মানুষ। প্রতিবাদে রুদ্ররূপ ধারণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রত্যাখ্যান করেন ব্রিটিশের দেওয়া রাজকীয় সম্মান 'নাইটহুড' খেতাব। নজরুল এর সবটাই দেখছেন-শুনছেন-জানছেন। সংবেদনশীল এক কবি হৃদয়ে এই শোক কীভাবে গুঞ্জরিত হচ্ছে, আর তার ব্যথা মোচনের রোদন কীভাবে মুঞ্জরিত হচ্ছে তার প্রকাশ ঘটে কিছুদিনের মধ্যেই।
ইতিহাসের এইসব সন্ধিক্ষণের মধ্যেই সংঘটন ঘটে নতুন বাস্তবতার। বিশ্বমাঝে জন্ম হয় আরেক নতুন ইতিহাসের। উত্থান ঘটে সমাজতান্ত্রিক শক্তির। সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। ক্ষমতাসীন জারের রাজতন্ত্রকে হটিয়ে লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নে সূচনা হয় নূতন দিনের। শুভবোধে ও শুভসংঘে জাগ্রত মানুষের মাঝে নতুন আলোর দিশা দেখা দেয়।
নজরুল তখন জাতীয় জীবনের এসব ঘটনাসমূহ যেমন গভীরভাবে অবলোকন করছেন, তেমনি বৈশ্বিক বাস্তবতাকে যুঝে-বুঝে নিচ্ছেন সর্বৈবরূপে। ইতিহাসের এই পরম্পরাতেই হাজির হয় ১৯২১ সাল এবং নজরুল ডিসেম্বরের একরাতে লিখে ফেলেন তার অমর ও কালজয়ী কবিতা 'বিদ্রোহী'। বলেন, 'বল বীর-/ বল উন্নত মম শির!/, শির নেহারি আমারি, নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির! বল বীর-, বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি'/চন্দ্রসূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি'/ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,/খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,/উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রীর!/মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!/বল বীর- আমি চির উন্নত শির!'
নজরুলের এই কবিতায় যে আহ্বান, সেই আহ্বানকে যদি আমরা দেশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করি তাহলে দেখব যে, এই কবিতার অর্থ কত পরিষ্কারভাবে আমাদের কাছে ধরা দেয়। ছোট পরিসরের এই লেখায় বিস্তারিত বলা সুযোগ নেই। তাই কেবলই এর সুলুকসন্ধান। এই কবিতায় ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের যে পুরাণ ব্যবহৃত হয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্য অর্থাৎ মধ্য এশীয় অঞ্চলের আরবি সাহিত্যের যে পুরাণ নানারূপে হয়েছে হাজির এবং জারি রেখেছে তার সর্ববিধ প্রকাশ ও মাহাত্ম্যের নানান কোশেশ—তা যেমন চমৎকার ও নন্দনীয় তেমনি হিন্দু মুসলমান মিলনের অভীপ্সাও। এখানেই এই কবিতার শক্তি।
নজরুল যখন বলছেন 'মানিনাকো কোনো আইন' তখন তিনি মূলত ব্রিটিশ-ঔপনিবেশিক শক্তির আইনের বিরুদ্ধেই বলছেন। কেননা, তারা আইন তৈরি করে শোষণের জন্য, তাদের দানবীয় শাসনকে পোক্ত রাখার জন্য। সুতরাং এই আইনকে মানার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এমনিভাবে 'বিদ্রোহী' কবিতার প্রতিটি পঙক্তি প্রতিটি শব্দ আসলে আমাদেরকে দেশপ্রেমের বারতা দেয় এবং দেশপ্রেমের ব্যাকরণ শেখায়।
ব্যাকরণকে ভালোভাবে জানলে যেমন ভাষা শুদ্ধভাবে লিখতে-পড়তে-বলতে পারা যায়। জানা যায় ভাষার স্বরূপ, ভাষার আন্তশৃঙ্খলা এবং বোঝা যায় ভাষার মিলনের শক্তি ও তার অন্তর্গত কাঠামো। ঠিক তেমনি 'বিদ্রোহী' কবিতা আমাদের দেশেপ্রেমের অনুরূপ ব্যাকরণ শেখায়।
মনে রাখা প্রয়োজন, এই কবিতা লেখা হয়েছে ১৯২১ সালে। যে সময়ে কলকাতার মাটিতে বসে বাংলার নবজাগরণের সর্বশেষ প্রতিভূ কাজী নজরুল ইসলাম লিখছেন একটা জাতির অনুপম এই ইশতেহার। ঠিক তখন বাংলার আরেক অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যাকে ঘিরে উদিত হচ্ছে ঢাকার নবজাগরণ। ইতিহাসের এ বুঝি অমোঘ বাস্তবতা একদিকে অস্তমিত সূর্য নিভে যাওয়ার আগে জ্বলে উঠছে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে, দাগ রেখে যাচ্ছে তার মহানাক্ষত্রিক শক্তির। অন্যদিকে সে উদিত হচ্ছে, নবজাগরণের বীজ উপ্ত হচ্ছে। সেই বীজ একসময় কুঁড়ি মেলে এবং ঢাকার জাগরণরূপে আবির্ভূত হয়ে একটা স্বাধীন দেশের জন্ম দেয়। দেশ জন্ম দেয়ার আগে বিশ্ব ইতিহাসে সংঘটিত করে নতুন এক অধ্যায়। যার নাম ভাষা আন্দোলন, বায়ান্ন যার সাক্ষী।
বেদনার হলো নজরুল বিদ্রোহীতে যে দেশকে চেনার ব্যাকরণকে হাজির করেছিলেন, সেই দেশ ১৯৪৭ এ অধরা থেকে যায়। সম্প্রদায়ের নিরিখে দেশভাগ নজরুলের কাম্য ছিল না। বিদ্রোহী সেই দেশভাগের ইশতেহার নয়। ফলে, যুদ্ধ ফেরত নজরুল ঘরে ফিরে যে দেশকে খুঁজেছিলেন, যে দেশকে জ্ঞান করে মান্যতা দিয়ে বিদ্রোহী লিখেছিলেন, সেই দেশের জন্য বিদ্রোহীকে অপেক্ষা করতে হয় আরও পঁচিশ বছর। জন্মের রজত জয়ন্তীতে বিদ্রোহীর সে দেশ অপূর্ণ-খণ্ডিত-লেজযুক্ত। সেই দেশ ধরা দেয় তার সুবর্ণ জয়ন্তীতে-ঢাকার নবজাগরণের চূড়ান্ত ও অনিবার্য বিজয়ের মধ্য দিয়ে।
১৯২১ এর 'বিদ্রোহী' তার দেশ খুঁজে পায় ১৯৭১ এসে। তার ব্যাকরণ পূর্ণতা পায় পঞ্চাশ বছর পর। ইতিহাসের কী অমোঘ পরিভ্রমণ! বিদ্রোহী লেখা হয়েছিল ডিসেম্বরে। পঞ্চাশ বছর পরের ডিসেম্বরে এসে একটা স্বাধীন দেশের জন্ম হয়, যে দেশের আকাঙ্ক্ষা থেকেই বিদ্রোহীর জন্ম; যে দেশের ব্যাকরণই শতবর্ষী এই কবিতার অভিমুখ ও অভিলক্ষ্য।
Comments