সাধারণের বাজেট ভাবনা: উৎসাহ কম, আতঙ্ক বেশি

‘বাজেট আসে, বাজেট যায়। আমাদের তো কোনো সুবিধা দেখিনা। জিনিসের দাম খালি বাড়েই। ভাবতে হয় কোন খরচ বাদ দিয়া কোনটা মিটামু।’
বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষের ভাবনা
স্টার ফাইল ফটো | ছবি: মামুনুর রশীদ

অর্থনীতির জটিল হিসাব-নিকাশ বোঝেন না শ্রমজীবীসহ সমাজের নিম্নআয়ের মানুষরা। বোঝেন প্রতি বছর বাজেট মানেই ব্যয়ের নতুন নতুন খাত তৈরি হওয়া। তাই বাজেট নিয়ে তাদের উৎসাহ কম, বরং আতঙ্কটাই বেশি।

নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের কারণে কষ্টে আছে মানুষ। মে মাসেও মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের কাছাকাছি। আছে ডলার–সংকট। এ কারণে পণ্য আমদানি সংকুচিত করে রাখা হয়েছে। গত বছরের মে মাসের তুলনায় এ বছরের মে মাসে রপ্তানি আয় কমে গেছে ১৬ শতাংশ। আবার রাজস্ব আয়েও ভালো প্রবৃদ্ধি নেই। বাড়ছে দেশি-বিদেশি দেনা পরিশোধের চাপ।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দিয়েছে।

এর আগে বাজেট নিয়ে সকাল থেকে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় শ্রমজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অন্তত ১২ জন মানুষের সঙ্গে কথা বলে দ্য ডেইলি স্টার।

বিকেল ৩টায় প্রস্তাবিত এই বাজেট পেশ করা শুরু করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। আজ তার বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম, 'সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার'।

এটি দেশের ৫৩তম, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৫তম ও অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে এবারের বাজেটের আকার বাড়ছে চার দশমিক ছয় শতাংশ।

তবে এ নিয়ে খুব একটা উৎসাহ দেখা গেল না আশকোনার চা-দোকানি স্বপন ঘোষের। সকালে খুচরা টাকা নিয়ে খদ্দেরের সঙ্গে ঝগড়া করতে করতেই তিনি বললেন, 'বাজেট নিয়া আমরা কী করুম। বাজেট আওয়া (আসা) মানেই তো ব্যাকটি (সব) জিনিসের দাম বাড়া। জিনিসপত্রের যে দাম তাতে এমনিতেই কূল পাইনা। আবার বাড়লে কী হইবো কে জানে?'

প্রায় একই রকম কথা বললেন ফার্মগেটের হকার জনি মিয়া। কথায় কথায় জানা গেল, ২০০৯ সালে বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে ফুটপাতে গেঞ্জির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এরপর ২০১৮-১৯ সাল পর্যন্ত মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যেই চলছিল তার। কিন্তু এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খেয়ে চলেছেন তিনি। 

জনি বলেন, 'বাজেট আসে, বাজেট যায়। আমাদের তো কোনো সুবিধা দেখিনা। জিনিসের দাম খালি বাড়েই। ভাবতে হয় কোন খরচ বাদ দিয়া কোনটা মিটামু।' 

জনগণের প্রতিনিধিদের বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত স্বপন ঘোষ কিংবা জনি মিয়ার মতো মানুষদের। কিন্তু কর আরোপ, কর্মসংস্থান, করমুক্ত আয়সীমা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের মতো বিষয়গুলোর কারণে বাজেটে নজর থাকে তাদের মতো সাধারণ মানুষের।

এই বাজেট হলো একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। সরকারকে দেশ চালাতে হয়, সরকারের হয়ে যারা কাজ করেন, তাদের বেতন দিতে হয়, আবার নাগরিকদের উন্নয়নের জন্য রাস্তাঘাট বানানোসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে হয়। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে কোথায় কত ব্যয় হবে, সেই পরিকল্পনার নামই বাজেট।

আবার একজন মানুষকেও আয় ও ব্যয়ের হিসাব করে জীবন-জীবিকা চালাতে হয়। তবে ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের বাজেটের একটি মৌলিক পার্থক্য হলো—সাধারণত ব্যক্তি আগে আয় কত হবে, সেটি ঠিক করেন, তারপর ব্যয়ের খাতগুলো নির্ধারণ করেন। আর রাষ্ট্র আগে ব্যয়ের খাতগুলো নির্ধারণ করে কোন কোন খাত থেকে আয় করা যায় সেটি ঠিক করে থাকে।

কিন্তু এবারের নতুন বাজেট সাধারণ মানুষের জন্য তেমন কোনো সুখবর বয়ে আনছে না। জানা গেছে এবারের বাজেটে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়ছে। প্রতিদিনের জীবনযাপনে ব্যবহৃত হয় এ রকম নানা পণ্য ও সেবার ওপর বাড়তি কর আসছে। মানুষের জীবনধারণ যখন ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে, তখন স্বস্তি দেওয়ার জন্য সাধারণত করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়। কিন্তু এবার তা–ও বাড়ছে না। 

আবার নতুন বাজেটে মুঠোফোনের রিচার্জের ওপ শুল্ক বাড়তে পারে। ফলে ফোনে কথা বলতে গিয়ে মানুষকে আগের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ করতে হবে। 

কথা হচ্ছিল পূর্ব রাজাবাজার এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। পেশায় তিনি একজন সবজি ব্যবসায়ী। আজকের বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে অনেকটা বিরক্তির স্বরেই তিনি বলেন, 'বাজেট নিয়ে এত উৎসাহ নাই ভাই। এইখানে আমগোর জন্য কিছু থাকলে এইডা নিয়া ভাবতাম। পরিবারে মানুষ ছয় জন। আমি ছাড়া আয়ের লোক নাই। যে ইনকাম করি খরচ তার চাইতে দেড়গুণ বেশি। প্রতি মাসে ঋণ থাকে। তাই বাজেট নিয়া চিন্তা করার সময় নাই।'

 

Comments