রপ্তানি তথ্যে অমিল কি হিমশৈলের চূড়া?

অর্থ মন্ত্রণালয়কে তদন্ত করতে হবে কেন ও কীভাবে বছরের পর বছর ভুল তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে এবং দেশব্যাপী এর প্রভাব কী ছিল।
রপ্তানি তথ্যে অমিল
অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

কার্যকর নীতি গ্রহণের পাশাপাশি অর্থনীতিকে সঠিক পথে রাখতে সঠিক তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য সঠিক না হলে বা সময়োপযোগী না হলে নীতিমালা ভুল প্রমাণিত হতে পারে। তখন উন্নয়নের সাফল্য শুধু কাগজে-কলমেই থেকে যাবে। বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটবে না।

অতীতে অর্থনীতিবিদরা নানান অর্থনৈতিক সূচক সম্পর্কিত পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ করেছিলেন। তথ্যের নির্ভুলতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সেগুলো সংশোধনের সুপারিশ করেছিলেন। তবে তাদের কথায় গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বছরের পর বছর ধরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ, অথবা ধান, আলু ও পেঁয়াজের মতো প্রধান ফসলের প্রকৃত উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহ এবং আমদানি পণ্যের সরবরাহ ও চাহিদা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সময়মতো তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ না হওয়া সমস্যাই বটে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রপ্তানিকারক ও পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, রপ্তানির তথ্য বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। উদ্যোক্তা ও শিল্পপতিরা কারখানা চালু রাখতে, বিশ্বব্যাপী ক্রেতা ধরে রাখতে ও উৎপাদন খরচ আকাশচুম্বী হওয়া ঠেকাতে যে কঠোর লড়াই করেন রপ্তানির তথ্য তা তুলে ধরে না।

যখনই রাষ্ট্রায়ত্ত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রপ্তানি থেকে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি আয়ের কথা জানায়, তখনই শিল্পসংশ্লিষ্ট ও উৎপাদকদের ভ্রু কুঁচকে যায়। কিন্তু, কেউই সেদিকে তাকায় না।

সরকার তথ্য গণনা পুনর্বিবেচনার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে কি না তা জানা যায়নি। বরং যেসব রপ্তানিকারক প্রশ্ন তুলেছেন তারা হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

অবশেষে, বাংলাদেশ ব্যাংক যখন আমদানি খরচের (বিওপি) অংশ হিসেবে সংশোধিত রপ্তানি তথ্য প্রকাশ করে তখন রপ্তানি চালান ও প্রকৃত রপ্তানির মধ্যে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের পার্থক্য পাওয়া যায়। তখনই দেখা যায় যে, ভুল তথ্য একটি দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে।

অসামঞ্জস্য তথ্যের কারণে অর্থনীতির আকার ও মাথাপিছু আয় অতীতের মতো 'উজ্জ্বল' নাও দেখাতে পারে। এমনকি, সব সরকারি তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিতে পারে।

ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যে নীতিমালা তৈরি হয়েছে সেগুলো কার্যকারিতা হারাবে। আগামী দুই বছরের মধ্যে ১১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নতুন বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিতে হবে।

খেলাপি ঋণের (এনপিএল) প্রকৃত হিসাব প্রকাশ করা হলে একই ঘটনা ঘটতে পারে।

গত মার্চে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ সর্বকালের সর্বোচ্চ এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায় পৌঁছায়। শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর প্রকৃত পরিমাণ সরকারি হিসাবের তুলনায় বেশি।

২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছিল, খেলাপি ঋণের প্রকৃত হিসাব সরকারিভাবে ঘোষিত হিসাবের দ্বিগুণেরও বেশি। এরপর ব্যাংকিং খাতে সংকট দেখা দেয়।

খেলাপি ঋণ, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), মাথাপিছু আয় ও উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য সামনে এলে তা দেশের উন্নয়নের প্রচলিত আখ্যানটিও বদলে দিতে পারে।

কারণ, জিডিপির হিসাব-নিকাশে নিট রপ্তানি আয় যোগ করা হয়। যেহেতু রপ্তানির মূল্য সংযোজন প্রায় ৬০ শতাংশ, তাই এটি সমন্বয় করা হলে জিডিপির আকারে প্রায় আট বিলিয়ন ডলারের ফারাক দেখা যেতে পারে।

রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সরকার দীর্ঘদিন ধরে নেতিবাচক আর্থিক হিসাবকে ইতিবাচক করার চেষ্টা করছে। আমদানি মূল্য পরিশোধের মূল উপাদানটির গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে আপাতদৃষ্টিতে তা প্রত্যাশিত ফল দেয়নি।

এখন রপ্তানি তথ্য সংশোধনের ফলে আর্থিক হিসাব এক 'অন্ধকার জগতে' ফিরে গেল।

নীতিনির্ধারকরা প্রায়ই দাবি করেন যে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরও খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হচ্ছে।

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার পর এই ভুল হিসাব দেশকে সমস্যাসংকুল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।

শুল্ক সুবিধা ভোগ করেও বিশ্ববাজারে রপ্তানিকারকরা তাদের অবস্থান শক্ত করতে পারেননি। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসলে তাদেরকে তীব্র প্রতিযোগিতায় পড়তে হবে। তখন অনেক দেশে বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া যাবে না।

এখন অর্থ মন্ত্রণালয়কে তদন্ত করতে হবে কেন ও কীভাবে বছরের পর বছর ভুল তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে এবং দেশব্যাপী এর প্রভাব কী ছিল।

রপ্তানি আয়ের তথ্যের অসামঞ্জস্যতা সরকারের জন্য 'বিপদ ঘণ্টা'। এটি দেশের তথ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা ও তথ্য পরিচালনার অদক্ষতাকে তুলে ধরে।

সরকারের উচিত বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া। প্রমাণ-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সঠিক তথ্য নিশ্চিত করা। সত্যিকারের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সহায়তা করা। কিন্তু, এটাকে যদি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তা হলে আমাদের জন্য হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখ অপেক্ষা করছে।

 

Comments

The Daily Star  | English
World Bank’s senior official speaks on lending culture in Bangladesh

Banks mostly gave loans to their owners rather than creditworthy borrowers

Bangladesh’s banking sector was not well-managed in recent years. Banks mostly gave loans to their owners, rather than to creditworthy entities. Consequently, several banks are now in difficulty.

13h ago