পেঁয়াজু থেকে পিৎজা: ঢাকার স্ট্রিট ফুডের পালাবদল

ঢাকার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রাঞ্জল বর্ণনা মেলে হেকিম হাবিবুর রহমানের 'ঢাকা পঁঞ্চাশ বারাস পহলে' বইয়ে। জন্ম ১৮৮১ সালে। ঢাকার ছোট কাটরা এলাকায়। ইউনানি চিকিৎসক হিসেবে বহুল পরিচিত পেলেও তার এই উর্দু ভাষার বইয়ে আছে তৎকালীন ঢাকার জীবনাচার ও খাদ্যাভ্যাসের খণ্ড চিত্র।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নতুন রূপে-গুরুত্বে ঢাকা হয়ে উঠে এই অঞ্চলের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যমণি। যুগে যুগে নানা অঞ্চলের নানান মানুষের ভিড়ে প্রাণ-চঞ্চল হয়ে ওঠা এই শহর নানাদিক থেকে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে।

এইতো দুই দশক আগেও রাজধানী ঢাকার রাস্তার পাশের খাবারের ছোট ছোট দোকানগুলোয় মানুষ যেতেন মূলত পিয়াজু-সমুচা বা পুরি-সিঙ্গারা খেতে। কেউ বা খুঁজতেন ঝাল মুড়ি। শীত এলে বসতো ঐতিহ্যবাহী পিঠার দোকান। এসবই স্থানীয়দের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।

এক সময় সেই স্বাদে গতি আনে চটপটি-ফুচকা। স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের কাছে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠে এসব মুখরোচক খাবার। তখনো চিজি পিৎজা, মশলাদার মোমো বা রাস্তার দোকান থেকে বার্গার খাওয়ার ইচ্ছাটা অনেকের কাছে হাস্যকর বলেও মনে হতো। কারণ তখনো 'রাস্তার খাবার' বলতে বোঝাতো বাড়ির খাবারের কাছাকাছি কিছু। বাড়ির খাবারের স্বাদ খোঁজা হতো পথের খাবারেও।

এক পলকে চলে আসা যাক বর্তমানে। এখনকার ফাস্ট ফুড খোলনলচে পালটে নিয়েছে ভিন্ন রূপ।

গত ২০ বছরে বেড়েছে রাজধানীর পরিধি। শত শত রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে পাড়া-মহল্লায়। অবসরে ঘুরতে বের হওয়া নানান বয়সী মানুষের হাতে মজাদার খাবার তুলে দিতে হাজার হাজার খাবারের গাড়ি নেমেছে রাস্তায়। প্রচলিত দেশি খাবারের সঙ্গে যোগ হয়েছে ভিনদেশি খাবারের স্বাদ-গন্ধ-রূপ।

নতুন প্রজন্মের ভোজনরসিকদের জন্য দোকানিরা সাজাচ্ছেন নতুন নতুন খাবারের পসরা। ঢাকার রাস্তায় পরিবেশন করছেন বিদেশি খাবারও। আনছেন নতুনত্ব। তুলনামূলক কম দামে দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক স্বাদ।

তাসফিয়া সুলতানার ভালোলাগা 'কাবাব-ই-বার্গার' বা 'গ্রিলস অন দ্য হুইল'কে ঘিরে। ২৯ বছর বয়সী এই নারী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রেস্তোরাঁগুলোয় সার্ভিস চার্জ-ভ্যাটসহ বাড়তি খরচ থাকে। অনেকে পথের পাশে খাবারের গাড়ি থেকে তুলনামূলক কম দামে রেস্তোরাঁর খাবার খান। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে-বসে সবাই মিলে আনন্দ করেন।'

এই গাড়িগুলো ভোজনপ্রিয়দের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। মিলছে ভারতীয় দোসা, নেপালি মোমো, পাকিস্তানি চাপ ও তুর্কি কাবাব থেকে শুরু করে বেলজিয়ামের ওয়াফেলসহ অনেককিছু।

শিক্ষার্থী-চাকুরেদের কথা বিবেচনায় রেখে সাধারণত সকাল থেকে খুলতে শুরু করে এসব দোকান। তবে বিকেল থেকে বাড়তে শুরু করে ভিড়। আর সন্ধ্যায় হয়ে উঠে জমজমাট। স্থানীয় বাসিন্দা, পেশাজীবী, শিক্ষার্থী ও বন্ধু-স্বজনরা এসব খাবারের গাড়ি ঘিরে ভিড় জমান। প্রায়শই গাড়ির আশেপাশে বসার ব্যবস্থা থাকে না। তবুও অনেকে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে খাবার খেতে খেতে আড্ডা দেন। কখনো কেউ কেউ রাতে খোলা আকাশের নিচে গেয়ে উঠেন জনপ্রিয় ব্যান্ডের গানের কলি—'চলো বদলে যাই…।'

মজার ব্যাপার হলো—সমুচা-সিঙ্গারা-পুরি-চটপটির মতো ঐতিহ্যবাহী খাবারও পাওয়া যায় কোনো কোনো গাড়িতে। নগরবাসীর রসনা মেটাতে প্রচলিত খাবারের পাশে থাকে ভিনদেশি খাবারও।

স্বাদ-বদল

গত ২০ বছরে ঢাকার খাবারের দৃশ্যপটে কী পরিবর্তন এসেছে? উত্তরটা সহজ: ইন্টারনেট।

ইন্টারনেটের ব্যবহার যত বিস্তৃত হতে থাকে স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়তে থাকে এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে। সেই তালে যোগ হয় ঢাকার খাবারের দৃশ্যপটও।

প্রযুক্তিপ্রেমী কৌতূহলী তরুণরা ইউটিউব ও ফেসবুকের মাধ্যমে খোঁজ নেন অন্য দেশের খাবারের। তারা জাপানি রামেন, ভারতীয় দোসা, নেপালি মোমো ও তুর্কি কাবাবের ভিডিও দেখেন। মুহূর্তেই পৃথিবীটা তুলে নেন হাতের মুঠোয়।

তবে শুধু যে ক্রেতারাই শিখছেন তা নয়। শিখছেন বিক্রেতারাও। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিক্রেতারাও অন্য দেশের খাবার তৈরির কৌশল ও উপস্থাপনা শৈলী আয়ত্ত করে নিচ্ছেন।

ঢাকার অনেক খাবার বিক্রেতা ইউটিউব দেখে শিখে নিচ্ছেন মোমো বা দোসা বানানোর কৌশল। তাই রাস্তার খাবার যেমনি হয়েছে বৈচিত্র্যময় তেমনি হয়েছে সুস্বাদু।

দেশি ফুড ব্লগাররাও এই পটপরিবর্তনে জোরালো ভূমিকা রাখছেন।

রাফসান দ্য ছোটভাই, আদনান ফারুক ও সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহর মতো ব্লগাররা ঢাকার রাস্তার খাবার বহু দর্শকের সামনে তুলে ধরছেন।

এ ছাড়াও, ট্রেভর জেমস (দ্য ফুড রেঞ্জার) ও সনি সাইডের (বেস্ট এভার ফুড রিভিউ শো) মতো আন্তর্জাতিক ব্লগাররা ঢাকার পথ-খাবারকে তুলে ধরছেন সারাবিশ্বে।

ইন্টারনেট শুধু নতুন খাবার নিয়ে আসেনি, তৈরি করেছে নতুন প্রজন্মও। ক্রেতা-বিক্রেতারা একইভাবে অনলাইনে তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন। তাদের 'রিভিউ' নিয়ে আলোচনা হয়। সেই 'রিভিউ' ছাড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে।

আরও কারণ আছে। মানুষের আয়, দ্রুত নগরায়ণ ও অনেক তরুণের উদ্যোক্তা হওয়ায় এই খাত হয়ে উঠছে আরও আকর্ষণীয়।

কম খরচের আনন্দ

ধানমন্ডির ১৬ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ফাইয়াস হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কম টাকায় মোমো খেতে ভালো লাগে। ১০০ টাকায় পাঁচ-ছয়টি মোমো পাওয়া যায়। রেস্তোরাঁয় গেলে দ্বিগুণ টাকা লাগবে।'

তিনি রাস্তার ধারে খাবারে গাড়িতে নানান ধরনের খাবারের কথা উল্লেখ করে জানান—ধানমন্ডি-২৭ এর মতো রাস্তায় ঝাল ফুচকা-চটপটির পাশাপাশি পিৎজাও পাওয়া যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার এক ক্রেতা শরিফা ঐশী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাস্তার খাবারের দোকানগুলোয় দেশি চটপটি থেকে শুরু করে বিদেশি মোমোসহ অনেককিছুই থাকে। মূল্যস্ফীতির এই সময়ে রাস্তার খাবার তুলনামূলক সস্তা।'

তবে স্বাস্থ্যবিধি বা পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত তিনি।

তার মতে, 'স্ট্রিট ফুড ভালো বিকল্প হলেও, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে বিক্রেতাদের আরও মনোযোগ দেওয়া উচিত। ক্রেতারা যেন খাওয়ার সময়ে নিশ্চিত থাকেন যে তারা যা খাচ্ছেন তা নিরাপদ। তাই স্বাস্থ্যবিধি ও খাবারের মান বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'

ঐশী মনে করেন, 'রাস্তার বিক্রেতাদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা থাকলে তা আরও চমৎকার হবে। এটি উপচে পড়া ভিড় ও যানজট কমাতে সহায়তা করবে।'

বসার ব্যবস্থা ও মাথার ওপর চাঁদোয়া থাকা স্টলগুলোয় গ্রাহকরা স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।

দুই সন্তানকে নিয়ে রাস্তার খাবারের গাড়ি থেকে খাবার কিনতে নিয়ে আসা ফাতিমা রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাচ্চাদের জন্য এখান থেকে পিৎজা কিনি। দাম কম। বাচ্চারাও পছন্দ করে।'

প্রতি খাবারের গাড়ির গল্প আলাদা

প্রায় ছয় ফুট বাই তিন ফুট আকারের খাবারের গাড়িগুলোর শুরু, সংগ্রাম, কাজ ও ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গল্প আছে।

যেমন, নাহিদা নওশিনের কথাই ধরা যাক। তিনি ২৭ বছর বয়সে ঢাকার নাখালপাড়া এলাকায় 'ওয়াফেল এন মোমোওয়ালি' নামে খাবারের গাড়ি পরিচালনা করছেন।

মাকে হারানোর পর নাহিদাকে রান্নায় মনোযোগ দিতে হয়। সেই প্রসঙ্গ টেনে বলেন, 'মায়ের সঙ্গে রান্নার কথা মনে আছে। সেসব স্মৃতি বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে উঠেছে।'

এখন তিনি গাড়িতে করে ওয়াফেলস-মোমো বিক্রি করছেন। তার তৈরি এই বিদেশি খাবার স্থানীয়রা বেশ পছন্দ করছেন। নওশিন এখন মাসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আয় করেন। শীতে আয় বেড়ে হয় ৪০ হাজার টাকার মতো।

৩০ বছর বয়সী চাকরিজীবী কামরুল হাসান আয় বাড়াতে ধানমন্ডিতে খাবারের গাড়ি নিয়ে আসেন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুধু বেতনের টাকা দিয়ে খরচ সামলাতে পারছি না।'

তিনি কম দামে বার্গার, পিৎজা ও সাব স্যান্ডউইচ বিক্রি করে শিক্ষার্থীদের কাছে প্রিয় হয়েছেন।

২৭ বছর বয়সী হাফিজুর রহমানকে নতুন উদ্যোক্তাদের প্রতিনিধি বলা যেতে পারে। যারা ৯টা-৫টা চাকরি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজ উদ্যোগে ব্যবসা করছেন তিনি তাদের একজন।

তার খাবারের গাড়ি 'আদ্দুনস প্লেস'-এ পাওয়া যায় বার্গার, মাংস, মোমো ইত্যাদি।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিজে কিছু করার ভাবনা থেকে খাবার বিক্রির কাজ শুরু করি। ব্যবসা বড় হলে চাকরি ছেড়ে দেব। পুরো সময় এই কাজে দেবো।'

১৭ বছর বয়সী আজিজুল ইসলাম ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে পড়ালেখা ছাড়লেও জীবিকার টানে জড়িয়ে পড়েন রাস্তায় খাবার বিক্রিতে। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাস্তার এসব দোকানে খাবারের দাম কম হলেও লাভজনক। এটি এমন ব্যবসা যা বড় করার সুযোগ আছে।'

ক্রমশ বাড়ছে পরিধি

খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের পাশাপাশি স্ট্রিট ফুড ব্যবসা ঢাকার অর্থনীতিতে নতুন পালক যুক্ত করেছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, স্ট্রিট ফুড খাত অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।

'এই খাতটি অনেকের বিশেষ করে তরুণদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করছে' উল্লেখ করে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সঠিক নীতি ও অর্থায়নের ব্যবস্থা করা গেলে তা তাদের সাফল্য-সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হবে।'

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাপস কুমার পাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্ট্রিট ফুড সাধারণ ব্যবসার তুলনায় বড় কিছু। এটা আমাদের পরিবর্তিত সমাজের প্রতিচ্ছবি।'

'যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না থাকলে এর প্রবৃদ্ধি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদও কাজের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনার ওপর জোর দিয়ে বলেন, 'এই খাতটি নারী ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারে। এটি শুধু খাবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়—এটি ক্ষমতায়নের বিষয়ও।'

এরপর?

ঢাকার স্ট্রিট ফুডের দৃশ্যপট প্রসারিত হতে থাকায় অন্তত একটি বিষয় পরিষ্কার: আগামী ১০ বছর পর এই তা একই রকম থাকবে না।

'ওয়াফেল এন মোমোওয়ালি'র নওশিন ১০ বছর পর একাধিক স্টল খুলে ব্যবসা বাড়ানোর আশা করছেন। বিশেষ করে, নারীদের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে চান তিনি।

হাফিজুর রহমান তার 'আদ্দুনস প্লেস' গাড়িটিকে রেস্তোরাঁয় পরিণত করার স্বপ্ন দেখছেন।

'গ্রিলস অন দ্য হুইল'র তাসফিয়া সুলতানা স্বাস্থ্যবিধি ও খাবারের মানের ওপর জোর দিতে চান।

তার লক্ষ্য ক্রেতাদের আস্থা অর্জনে মানসম্মত খাবার পরিবেশনের পাশাপাশি দোকান পরিচ্ছন্ন রাখা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন—প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন বা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই অনানুষ্ঠানিক খাতকে আনুষ্ঠানিক শিল্পে পরিণত করা যেতে পারে। কাজের সুযোগ বাড়ানো যেতে পারে। অর্থনীতিকে চাঙা করার পাশাপাশি ঢাকার খাবারের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

'স্ট্রিট ফুড ইতোমধ্যে অর্থনীতিতে বেশ প্রভাব ফেলেছে' জানিয়ে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'তবে প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে নিবন্ধন, স্বাস্থ্যবিধি ও অর্থায়নের মতো সংকট মোকাবিলা করতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

US opens door to tariffs on pharma, semiconductors

The trade war is raising fears of an economic downturn as the dollar tumbles and investors dump US government bonds, normally considered a safe haven investment.

32m ago