পাতা বেশি মুকুল কম, কপালে চিন্তার ভাঁজ লিচু চাষির

প্রতি বছর ফাল্গুনের শুরুতেই লিচু গাছে আসতে থাকে মুকুল। মুকুল যত বেশি হয়, চাষিদের হাসিও তত বাড়ে। সে সময় গাছের পরিচর্যা বেড়ে যায়। পাশাপাশি মুকুল দেখে গাছ কেনেন লিচু ব্যবসায়ীরা।
তবে এ বছর ফাল্গুনে দেশের অন্যতম বৃহত্তম লিচু উৎপাদনকারী জেলা পাবনার ঈশ্বরদীতে বেশিরভাগ লিচু গাছে মুকুলের পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে নতুন পাতা। মাথায় হাত লিচু চাষিদের।
লিচু চাষিরা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ফাল্গুনের শুরু থেকেই লিচু গাছে মুকুলের পরিবর্তে নতুন পাতা আসলে সে গাছে ফলন পাওয়া যায় না।
প্রাকৃতিক নিয়মে প্রতি বছর নির্দিষ্ট সংখ্যক গাছে মুকুল আসে। বাকিগুলোয় আসে নতুন পাতা। প্রতিটি বাগানে কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ গাছে মুকুল দেখা যায়।

এ বছরের চিত্র একবারেই ভিন্ন। প্রতি বাগানে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ গাছে মুকুলের পরিবর্তে বেড়ে উঠেছে নতুন পাতা। লিচুর উৎপাদনে বড় ধসের আশঙ্কা করছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
ঈশ্বরদীর জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত লিচু চাষি শাজাহান আলী বাদশা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বাগানে ৬০০-র বেশি লিচু গাছ আছে। প্রতি বছর চার থেকে পাঁচ শ গাছে মুকুল আসে। এ বছর ১০০ থেকে ১৫০ গাছে মুকুল এসেছে। বাকি গাছে নতুন পাতা।'
বাদশার মতো অন্য লিচু চাষিদেরও একই অবস্থা।
প্রায় চার দশক ধরে লিচুর আবাদ করা বাদশা জানান, এমন বিপর্যয় কখনো দেখেননি। বাগানের প্রায় ৮০ শতাংশ গাছে লিচুর নতুন পাতা আসায় এবার গ্রীষ্মে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়ার আশা নেই।
ঈশ্বরদীর প্রায় সাড়ে তিন হাজার লিচু বাগান থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে আড়াই হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এ বছর লিচুর উৎপাদন কম হলে এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে এত বিপুল সংখ্যক গাছে কী কারণে মুকুল না এসে নতুন পাতা এসেছে এর সুনির্দিষ্ট কারণ জানা নেই কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের।
ঈশ্বরদী কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার ডেইলি স্টারকে জানান, আশানুরূপ মুকুল না আসায় এ বছর ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা আছে। সুনির্দিষ্ট কারণ জানা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনেই এমনটি হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ঈশ্বরদীতে প্রায় তিন হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়। এ বছরের লিচুর তথ্য এখনো সংগ্রহ করা হয়নি। ফাল্গুন শেষ হওয়ার পর কৃষি বিভাগ যখন গাছের জরিপ করবে তখন সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে।
লিচু গাছে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় এ বছর ব্যবসায়ীরাও দিশেহারা। অতিরিক্ত দামে লিচুর মুকুল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। ফলে এ বছর লিচুর দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
ঈশ্বরদীর সাহাপুর গ্রামের লিচু চাষি ও ব্যবসায়ী মিরাজুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মুকুল দেখে দুই শতাধিক গাছ কিনেছি। গত বছরের তুলনায় দাম প্রায় দ্বিগুণ।'
এ বছর ২০০ লিচু গাছ তাকে কিনতে হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ টাকায়। গত বছর ১০০ গাছ কিনতে খরচ হয়েছিল প্রায় দেড় লাখ টাকা।
এ বছর বেশিরভাগ গাছে মুকুল না আসায় মুকুলসহ গাছের দাম বেড়ে গেছে বলে জানান তিনি।
লিচু ব্যবসায়ীরা জানান, একটি লিচু গাছ মৌসুমে কমপক্ষে তিন থেকে চারবার বিক্রি হয়। প্রথমে মুকুল দেখে গাছ কেনেন ব্যবসায়ীরা। পরে মুকুল থেকে গুটি আসলে গাছ বিক্রি হয়। লিচু পাকার পরও গাছ বিক্রি হয়। দফায় দফায় বিক্রি হওয়ায় বাজারে লিচুর দাম আরও অনেক বেড়ে যায়।
সাহাপুর এলাকার অপর কৃষক রাকিবুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাগানে প্রায় ১০০ গাছ আছে। এর মধ্যে ২৫ গাছে মুকুল এসেছে।'
তিনি প্রতি বছর নিজের বাগানের পাশাপাশি আরও দুই-একটি বাগান কেনেন। এ বছর এত কম মুকুল আসায় তিনি হতাশ। ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় তিনি এ বছর গাছ কিনতে পারেননি।
রাকিবুল ইসলাম আরও বলেন, 'মুকুল থেকে গুটি হওয়ার সময় ৬০ শতাংশের বেশি মুকুল ঝরে যায়। ফলন ভালো হলে একটি গাছে ১০ থেকে ১২ হাজার লিচু হয়।'
এ বছর মুকুল কম আসায় প্রাথমিক পর্যায়েই গাছের দাম দ্বিগুণের বেশি হাঁকা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত লিচুর উৎপাদন খরচ চার টাকার বেশি হতে পারে। এত দামে লিচু কিনে লাভের মুখ দেখা কঠিন হতে পারে এমন আশঙ্কায় তার মতো অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী এবার গাছ কেনা থেকে বিরত আছেন বলে জানান তিনি।
লিচু ব্যবসায়ী ও কৃষকদের ভাষ্য—গ্রীষ্মের শুরুতে লিচু পাওয়া যায় বলে ঈশ্বরদীর লিচুর চাহিদা সারাদেশেই আছে। ভালো মাটি ও অনুকূল পরিবেশ পাওয়ায় লিচুকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে গত কয়েক দশকে বিপুল সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে।
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সূত্র মতে, জেলার প্রায় চার হাজার হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়। এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার হেক্টরের বেশি লিচু আবাদ হয় ঈশ্বরদীতে। লিচুর ফলন বিপর্যয় এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এ ফলন বিপর্যয়ের সুনির্দিষ্ট কারণ কারও জানা নেই।
Comments