হারিয়ে যাওয়া খেলার মাঠ ও ইনডোরের রমরমা ব্যবসা

ছবি: স্টার

২০০০ সাল শুরুর আগে যারা বড় হয়েছেন তাদের কাছে খেলার মাঠ ছিল 'সেকেন্ড হোম'। ফুটবল পায়ে নিয়ে দৌড়ানো শিশুদের চিৎকারে স্কুলের মাঠগুলো মুখরিত থাকতো। বাতাসে ভাসতো ক্রিকেট বল। গাছে রশি দিয়ে বাঁধা হতো ব্যাডমিন্টনের নেট।

সন্ধ্যা তখনই হত যখন সূর্য ডুবে চারপাশ অন্ধকার করে দিত। ঘামে ভেজা শরীরে ধুলাবালি নিয়ে দেরি করে ঘরে ফেরা শিশু-কিশোরদের শুনতে হতো বাবা-মায়ের বকাঝকা।

কিন্তু আজ সেসব মাঠে সুনসান নীরবতা।

নতুন শতাব্দীতে দেখা দেয় ভিন্ন ঘটনা। এখন শিশুদের তিরস্কার করা হয়—ঘরে থাকার জন্য, সারাক্ষণ স্ক্রিনে চোখ রাখার জন্য, স্মার্টফোন ব্যবহারের জন্য ইত্যাদি।

এর দায় শিশুদের দেওয়া ঠিক না। শপিং মল ও অ্যাপার্টমেন্ট মাঠগুলোকে খেয়ে ফেলেছে।

অবশিষ্ট যে কয়েকটি খোলা জায়গা আছে সেগুলো হয় তালাবদ্ধ না হয় জনাকীর্ণ।

রাজধানী ঢাকা এমনকি বন্দরনগরী চট্টগ্রামে খোলার মাঠগুলো নগরায়নের ভারে চাপা পড়ে গেছে। আজকের তরুণদের অভিভাবকরা আক্ষেপ করেন খেলার জায়গার অভাব বলে।

তাই বলা যায়, আজকের শিশুদের ঘরে থাকার সমস্যা তাদের আলস্য নয়; বরং খেলার মাঠের অভাব।

ফুটসালের উত্থান: প্রয়োজনীয়তা থেকে জন্ম নেওয়া ব্যবসা

কিন্তু যেখানে শূন্যতা, সেখানেই উদ্যোক্তারা সুযোগ দেখতে পান।

২০০০ এর দশকে দেশের শহরাঞ্চলে এই নতুন ধারার উদ্ভব ঘটে। নাম ফুটসাল। ফুটবলের ছোট সংস্করণ। খেলা হয় কৃত্রিম মাঠে।

ঐতিহ্যবাহী ফুটবলের জন্য বিশাল খোলা মাঠের প্রয়োজন। ফুটসালের জন্য দরকার ছোট খোলা ছাদ বা সামান্য পরিমাণে খালি জায়গা। একটি বড় ঘরের মেঝেও ফুটসালের মাঠ হতে পারে।

একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন রেজাউল ইসলাম। বয়স ত্রিশের কোঠায়। কুমিল্লায় তার গ্রামে প্রতিদিন বিকেলে ফুটবল খেলার কথা মনে পড়ে। ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা সাধারণ বিষয় ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময়ও তিনি প্রতিদিন খেলতেন।

কিন্তু কাজের খোঁজে যখন ঢাকায় আসেন, তখন ভেবেছিলেন খেলার দিন শেষ। কিন্তু হঠাৎ তিনি একটি কৃত্রিম মাঠের কথা জানতে পারেন। আর ফিরে আসে শৈশবের স্মৃতি।

'খেলা আমাকে প্রশান্তি দেয়। এমন প্রশান্তি কোথাও পাই না। যেহেতু খোলা জায়গা বা সবার জন্য খেলার মাঠ নেই, তাই কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে ব্যক্তিগত মাঠে ফুটসাল খেলি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা সন্ধ্যায় খেলি, কারণ দিনে গরমে খেলা কষ্টকর।'

কৃত্রিম ঘাসের অর্থনীতি

ব্যবসার মডেলটি সহজ: অব্যবহৃত জায়গার খোঁজ নিন, টার্ফ-ফ্লাডলাইট বসান ও সময়ের উপর ভিত্তি করে ভাড়া নির্ধারণ করুন।

অপারেটররা মাঠের জায়গা, সুযোগ-সুবিধা ও বুকিংয়ের সময়ের ওপর নির্ভর করে প্রতি সেশনে সাধারণত দেড় হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করেন। ভাড়া দেওয়া হয় ৯০ মিনিটের জন্য।

বিকেল ৫টায় পিক আওয়ার শুরু হয়ে চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। বাকিটা অফ-পিক হিসেবে বিবেচিত হয়।

সন্ধ্যায় চাহিদা বেশি থাকলে খরচ বেশি হয়। সে সময় বিদ্যুৎ বিলও খরচের সঙ্গে যোগ হয়।

'ইকো স্পোর্টস'র কর্ণধার মো. সাজ্জাদুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চট্টগ্রামে মানুষ বাড়লেও মাঠ প্রায় নেই বললেই চলে। বুঝতে পারি খেলার মাঠের চাহিদা আছে। ২০২৪ সালের মে মাসে হালিশহরে আমার প্রতিষ্ঠান উদ্বোধন করা হয়।'

তার গ্রাহকদের প্রায় ৮০ শতাংশই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। দিনে কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় এখানে প্রশান্তি খোঁজেন।

তিনি আরও বলেন, 'আগে আমাদের মাঠ দিনে তিন থেকে চারটি ও শুক্রবার সাত-আটটি ম্যাচের জন্য বুকিং দেওয়া হতো। এখন প্রতিদিন ছয় থেকে সাতটি দল খেলে। অনেক সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও শিক্ষার্থীদের জন্য মাঠ বুকিং নেয়।'

প্রাথমিক বিনিয়োগ হিসেবে প্রয়োজন জমি, অগ্রিম টাকা, অবকাঠামো ও টার্ফ। আবার টার্ফের মানের ওপর ভিত্তি করে খরচ ভিন্ন হয়।

জমি যদি ভালো না হয়, তাহলে টার্ফের জন্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। প্রতি দুই থেকে তিন বছর পরপর টার্ফ বদলাতে হয়। তাই পুনর্বিনিয়োগের প্রয়োজন।

চট্টগ্রামে এ ধরনের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের দুটি মাঠ আছে। বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩৫ কোটি টাকা।

তিনি জানান, তার প্রকল্পটি নিচু জমিতে হওয়ায় জমির মালিককে প্রায় ১৫ লাখ টাকা অগ্রিম দিতে হয়েছে। এরপর ওয়াশ রুম ও রেস্টুরেন্টসহ দুটি মাঠ প্রস্তুত করতে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ হয়।

শুধু ঢাকাতেই ২০টির বেশি বাণিজ্যিক টার্ফ আছে।

বসুন্ধরা এলাকায় 'অফসাইড', 'জাফ' ও 'দ্য স্টেডিয়াম'র মতো ফুটসাল কোর্ট আছে। এগুলো বিকাল ৫টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত জমজমাট থাকে।

অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে দর্শনার্থীদের বসার ব্যবস্থা আছে। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারে সদস্যদের নিয়ে খেলা উপভোগ করা যায়। ফলে দিন শেষে তা এটি স্মরণীয় অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে।

নতুন খেলার সংস্কৃতি

ফুটসাল খেলা একটি ব্যবসায়ী উদ্যোগের তুলনায় বেশিকিছু। এটি শহুরে ক্রীড়া সংস্কৃতিতে নতুন পালক যোগ করেছে।

ঢাকা ও চট্টগ্রামে লিগ-টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হচ্ছে। অপেশাদার খেলোয়াড়রাও প্রতিযোগিতার স্বাদ পাচ্ছেন। রেফারি, লকার রুম ও দর্শকদের বসার ব্যবস্থা একে একটি অনুষ্ঠানে পরিণত করেছে।

অনেকের জন্য এটি সামাজিক মিলনমেলা। তেজগাঁও ফুটসাল কোর্টে নিয়মিত আসা রিফাত আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। ব্যাংককর্মী, শিক্ষার্থী, এমনকি ছোট ব্যবসায়ীসহ অনেকেই খেলতে আসেন।'

বাংলাদেশে ফুটবল নিয়ে আবেগ বরাবরই আছে। গত বছর আর্জেন্টিনার ফুটবল ফেডারেশন যখন বিশ্বকাপে সমর্থনের জন্য বাংলাদেশি সমর্থকদের ধন্যবাদ জানিয়েছিল, তখন বোঝা গিয়েছিল এ দেশের মানুষ খেলাটি কতটা গভীরভাবে উপভোগ করেন।

শহরে খেলার মাঠের অভাব থাকায় খেলার প্রয়োজন মেটাতে অনেকে ফুটসালকে বেছে নিয়েছেন।

ঢাকার শনির আখড়ার গোবিন্দপুরের রফিকুল ইসলাম রোডে 'স্কাই টার্ফ'র মালিক আব্দুর রহমান মারুফ ডেইলি স্টারকে জানান, গত দুই বছর ধরে ফুটসালের চাহিদা বেড়েছে। ২০২৪ সালের মে-জুনের দিকে তাদের প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে টার্ফ বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

তিনি বলেন, 'আমাদের টার্ফ চালুর পর থেকে খুব ভালো সাড়া পাচ্ছি।'

এ পর্যন্ত তারা এ ব্যবসায় প্রায় ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন।

'ব্যবসার পরিধি ক্রমশ বাড়ছে। নানা পেশার মানুষ খেলাধুলায় আগ্রহী হচ্ছেন। তাই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'

ঢাকায় একটি ফুটসাল ব্যবসায় সাধারণত ৩০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ হয়।

তিনি আরও বলেন, 'দেশে ফুটসাল খাতে ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।'

তার মতে, ২০২৩ সাল থেকে এই খাত গতি পেতে শুরু করেছে।

'টার্ফ নেশন' হওয়ার গল্প

২০২৪ সালের জুনের এক সকালের কথা। নির্মাণ কর্মীরা ঢাকায় একটি মাঠে কৃত্রিম টার্ফ বসাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানটির মালিক প্রথম টার্ফ বসানো দেখে শৈশবের দিনগুলো স্মরণ করছিলেন। সরু গলিতে ক্রিকেট খেলার স্মৃতি। তার সেই প্রচেষ্টা 'টার্ফ নেশন' তৈরিতে সহায়তা করেছে।

'নিজে খেলাধুলা পছন্দ করি। যতদূর মনে পড়ে ছোটবেলা থেকেই আমি ক্রিকেটের ভক্ত। প্রথমদিকে আমারও উদ্যোক্তা হওয়ার ভাবনা ছিল। যখন দেখলাম এখানে বিনিয়োগের সুযোগ আছে তখন স্পোর্টস কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার ধারণাটি মাথায় আসে। আমার অংশীদাররাও এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে অনেক সহযোগিতা করেছেন,' বলেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. নওয়াব মাহমুদ।

প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা খরচে ২১ হাজার বর্গফুটের এই কমপ্লেক্সটি এমএইচ শমরিতা হাসপাতালের পেছনে। সেখানে ফুটবল টার্ফ ও ক্রিকেট পিচ বসানো হয়েছে।

কয়েকদিনের মধ্যেই পার্কিং লট গ্রাহকদের গাড়িতে ভরে যায়। চাকরিজীবীরা কাজের পর এখানে ছুটে আসেন। মধ্যবয়সী ব্যবসায়ীরাও আসতে থাকেন।

তার গ্রাহকদের বেশিরভাগই কর্পোরেট কর্মী, শিক্ষার্থী ও তরুণ চাকরিজীবী। 'আমরা দেখছি, ব্যবসায়ী ও প্রবীণরা তাদের বন্ধু ও পরিচিতদের নিয়ে এখানে খেলতে আসছেন।'

তিনি বলেন, 'ঢাকায় ফুটসাল কোর্ট ছাড়াও কয়েকটি ব্যক্তি মালিকানাধীন খেলার মাঠ আছে। সেখানে ফুটবল, ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলার সুযোগ আছে। তবে চাহিদার তুলনায় এসব মাঠের সংখ্যা কম। ঢাকায় জমি সীমিত, ব্যক্তি মালিকানাধীন মাঠের সংখ্যা খুবই কম। তাই ফুটসাল বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।'

খেলার খরচ

তারপরও এই খাতে কিছু বাধা আছে।

ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও জমি ভাড়া নিতে প্রচুর খরচ, সীমিত সরকারি সহায়তা ও টার্ফের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এই খাতে সংকট সৃষ্টি করেছে।

আরেক সমস্যা হলো—বেশিরভাগ ফুটসাল মাঠ ধনীদের আবাসিক এলাকার আশেপাশে। ফলে কম আয়ের মানুষদের জন্য সেগুলো ব্যবহার করা কঠিন।

এ ছাড়াও, জমির খরচ বা ভাড়ায় মুনাফার টাকা চলে যায়। টার্ফ রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ও রাতে বিদ্যুৎবিল খরচ আরও বাড়িয়ে দেয়।

খেলোয়াড়দের মধ্যে বিরোধ হলে তা মেটানোও একটা বড় বিষয়। তাই প্রতিষ্ঠানটিকে প্রভাবশালী হওয়ারে পাশাপাশি সার্বক্ষণিক সিসিটিভি রাখতে হয়।

প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও এই ব্যবসার প্রসার ঘটছে। 'খেলবোকই' ও 'টার্ফ বুকিং'র মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে গ্রাহকরা কয়েক সপ্তাহ আগে খেলার জায়গা ঠিক করে নিতে পারেন। কোনো কোনো প্ল্যাটফর্ম খেলোয়াড় জোগাড়ে সহায়তা করে।

সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টার্ফগুলোর ফ্লাডলাইট জ্বলে ওঠে। কৃত্রিম ঘাসে স্নিকার্সের শব্দ, খেলোয়াড়দের হৈহুল্লোড়-উল্লাস অতীতের খোলা মাঠের মতো না হলেও একেবারেই অনুভূতিহীন নয়।

একসময় যারা আশঙ্কা করেছিলেন মাঠের অভাবে হয়তো খেলাধুলাই হারিয়ে যাবে তারা হয়তো আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Soybean oil price hike temporary: commerce adviser

Improved supply and increased competition will help bring down prices soon, he says

1h ago