তারল্য সংকটে ভুগছে বেশিরভাগ ব্যাংক

১৫ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি

বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, আমানতের ধীর প্রবৃদ্ধি ও ঋণ আদায়ের ধীর গতি ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। ফলে, ব্যাংকগুলো ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে।

শুধু তাই নয়, এটি ব্যাংকগুলোকে কল মানি মার্কেটের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করছে। কল মানি মার্কেট হলো একটি স্বল্পমেয়াদী অর্থ বাজার, এর মাধ্যমে সংকটে থাকা ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে।

গত সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক কল মানি মার্কেটে লেনদেন হয়েছে ৯ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। যা গত বছরের ১১ আগস্টের পর সর্বোচ্চ এবং গত বছরের একই দিনে ছিল ৯ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা।

ব্যাংকিং সেক্টর সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আমানত বৃদ্ধির ধীর গতি, ঋণ পুনরুদ্ধারের দুর্বলতা ও আমদানি বিল পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কেনার মতো একাধিক কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৪০ শতাংশে, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ।

একইসঙ্গে ব্যাংকগুলোর খেলাপিঋণও বেড়েছে, যা একটি ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১৬ দশমিক ০২ শতাংশ বেশি।

ব্যাংকাররা বলছেন, সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ঋণপত্রের একটি অংশও ইতোমধ্যে ফোর্স ঋণে পরিণত হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার কল মানি রেট, ঋণের সুদের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশে।

ব্যাংকারদের মতে, ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে কল মানি মার্কেটে ব্যাপক চাপ দেখা যাচ্ছে। তাই সুদের হার বাড়ানো সত্ত্বেও শরিয়াহভিত্তিকসহ অনেক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে তারল্য সহায়তা নিচ্ছে।

চলতি বছরের ৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের ৭ দিনের পুনঃক্রয় চুক্তি (রেপো) ও একদিনের তারল্য সহায়তা সুবিধার আওতায় ৪ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা নিয়েছিল ৭টি ব্যাংক। এর একদিন পর ৮টি ব্যাংক ৩ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা ঋণ নেয়।

এরপর গত ৮ আগস্ট ৪টি ব্যাংক ৩ হাজার ৪০২ কোটি টাকা এবং ৯ আগস্ট ৬টি ব্যাংক ৩ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়।

জুলাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিতিশীলতা ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকটের প্রধান কারণ হতে পারে।

মাঝারি রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের বিপরীতে উচ্চ আমদানি বিলের কারণে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি ডলার সংকটের মধ্যে টাকার বিপরীতে ডলারের দরও রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ১৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে, যা তারল্য সংকটকে আরও বাড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুনে ব্যাংকিং খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২ লাখ ৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা।

উদ্বৃত্ত তারল্যের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে আছে ৬৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে আছে ৬৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে আছে ৩৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

উদ্বৃত্ত তারল্যের সিংহভাগ ট্রেজারি বন্ড ও বিলগুলোতে বিনিয়োগ করা হয়েছে।

ব্যাংকভেদে তারল্য পরিস্থিতির ভিন্নতা আছে; যেমন- কোনো কোনো ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত তহবিল আছে, আবার কোনো কোনো ব্যাংক তারল্য ঘাটতিতে আছে।

শরিয়াহভিত্তিক ৬ ব্যাংকসহ অন্তত এক ডজন ব্যাংক বর্তমানে চরম তারল্য সংকটে ভুগছে। এছাড়া তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ন্যূনতম তারল্যের সীমা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ অনিয়মের কারণে অনেক আমানতকারী তাদের অর্থ তুলে নেওয়ায় বাংলাদেশে বেশ কিছু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে।

জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটের মধ্যে আমানতের ধীর গতি ও সরকারি খাতে ঋণের প্রসারকে বর্তমান তারল্য সংকটের জন্য দায়ী করেছেন পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী।

তিনি বলেন, 'সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আমানত তুলে নেওয়া হয়েছে, কারণ সঞ্চয়কারীরা তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।'

চলতি বছরের জুলাইয়ে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা মে মাসের চেয়ে সামান্য কম। চলতি বছরের মে মানে ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

তিনি আরও বলেন, 'পূবালী ব্যাংক তারল্য সংকট নেই। বরং গত ৬ মাসে আমাদের আমানত বেড়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা।'

'গত বছর পাবলিক সেক্টরের ঋণ বৃহৎ পরিমাণে বেড়েছে, যা ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে,' মন্তব্য করেন এই ব্যাংকার।

যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির্জা ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বেশ কয়েকটি ব্যাংক তারল্য সংকটে থাকলেও সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের তারল্য পরিস্থিতি ততটা খারাপ নয়।

তবে তিনি স্বীকার করেন, ঋণ আদায় মোটেও ভালো অবস্থায় নেই, কারণ ঋণগ্রহীতারা বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ঋণের টাকা ফেরত দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

'এটি তারল্য পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলেছে,' বলেন মির্জা ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদ।

ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক বলেছেন, শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া অন্যদের তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। কারণ, বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা এখনো বাড়েনি এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আমদানি বিলও কমেছে।

তবে তিনি সতর্ক করেন, ঋণের চাহিদা বাড়লে তারল্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হতে পারে।

গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ, যা আগের বছরের ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশের চেয়ে কম।

তিনি বলেন, 'বর্তমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার পরিমাণ কমিয়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English
tax collection target for IMF loan

IMF to continue talks with Bangladesh for near-term agreement

The global lender said such an agreement would pave the way for completing the combined third and fourth reviews

1h ago