কম সুদে ঋণ, মূল্য দিচ্ছে দেশের অর্থনীতি

bangladesh bank logo

দেশে মূল্যস্ফীতির সমহারে ঋণের সুদহার অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ, মূল্যস্ফীতির বিপরীতে সুদহার ঋণাত্মক হওয়ায় দ্রুত লাভের জন্য বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনুৎপাদনশীল খাতকে বিনিয়োগের জন্য বেছে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।

বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় দেশে মূল্যস্ফীতি গত আগস্টে ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে পৌঁছায়। মূল্যস্ফীতি অক্টোবরে কিছুটা কমে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে নেমে আসে।

ঋণের গড় সুদহার সেপ্টেম্বরে ৭ দশমিক ১২ শতাংশে দাঁড়ায়। এর অর্থ হচ্ছে, ঋণের আসল সুদহার ঋণাত্মক ১ দশমিক ৯৮ শতাংশে ঠেকেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঋণগ্রহীতাদের জন্য তহবিলের প্রকৃত খরচ শূন্যের নিচে। এটা অযৌক্তিক।'

ঋণগ্রহীতাদের প্রকৃত সুদের হার নির্ধারিত হয় সুদের হার থেকে মূল্যস্ফীতির হার বাদ দিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি মাসে আমানত ও সুদের গড় হার প্রকাশ করে। অক্টোবরের তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখায় দেশের অর্থনীতি একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি অর্থনীতিতে ঋণের সুদহার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হতে পারে, যদি বাজার সুদহার নির্ধারণ করার সুযোগ পায়।'

তবে অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, ঋণের সুদহার কয়েক মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হারকে ছাড়িয়ে যায় বলে তিনি জানান।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'বাংলাদেশে নীতিনির্ধারকরা কৃত্রিমভাবে সুদের হার নির্ধারণের চেষ্টা করছেন। এর ফলে আর্থিক খাত নেতিবাচক পরিণতির সম্মুখীন হতে শুরু করেছে।'

ঋণে কম সুদহার নির্ধারণের মাধ্যমে বড় ঋণগ্রহীতারা সুবিধা পাচ্ছে। এতে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ ব্যাংকগুলো নিজেদের লাভ নিশ্চিত করতে আমানতে সুদহার ঋণের সুদহারের চেয়ে কমপক্ষে ২-৩ শতাংশ কম রাখে।

সেপ্টেম্বরে আমানতের গড় সুদহার ৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে দাঁড়ায়, যার অর্থ আমানতের সুদহার ছিল মাইনাস ৫ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক অর্থনীতিবিদ মনসুর বলেন, 'বাংলাদেশে জমির দাম ইতোমধ্যেই বেড়ে গেছে, যার অর্থ ঋণের টাকা অনুৎপাদনশীল খাতে যাচ্ছে।'

অনুৎপাদনশীল খাতে যদি প্রচুর পরিমাণে তহবিল বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে উৎপাদনশীল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। এমন পরিস্থিতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন কম হওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়।

আমদানি বিলের জন্য টাকার বিনিময়ে মার্কিন ডলার ক্রয়সহ বিভিন্ন কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় টাকা কমে যাওয়ায় এ খাতে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে এসএমই খাতে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত অর্থবছরে রেকর্ড ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার সরবরাহের পর চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি দেওয়া হয়েছে।

মনসুর বলেন, 'ডলারের বিপরীতে বিপুল পরিমাণ দেশীয় মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে যাওয়ায় বাজারে টাকা কমেছে। এতে পণ্যের চাহিদা কমেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'বড় ঋণগ্রহীতারা তাদের প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিতে পারেন এবং তারা অনেক সময় তা অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, 'যখন তহবিল অনুৎপাদনশীল খাতে স্থানান্তরিত হয়, তখন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।

তিনি বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করে বলেন, তারা ঋণের সঠিক ব্যবহারের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে না।

সাবেক এই গভর্নর অর্থনীতির স্বার্থে অবিলম্বে সুদের হারে ক্যাপ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। ঋণে ক্যাপ দেওয়া হলে মানুষের কষ্ট আরও বাড়তে পারে।'

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, উৎপাদনশীল খাতকে এগিয়ে নিতে সরকার এই ক্যাপ দিয়েছে।

তিনি বলেন, 'কিন্তু তারল্য সংকটের কারণে ছোট উদ্যোক্তারা ব্যাংকগুলো থেকে প্রত্যাশিত সমর্থন পাচ্ছেন না। বড় ঋণগ্রহীতারা তহবিল পায়, কারণ তারা শর্ত পূরণ করতে পারে।'

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি রিজওয়ান রহমান মনে করেন, ঋণের সুদের হার বাড়ালে তা ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর।

তিনি বলেন, 'তারপরও ঋণের সুদহার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত। কেননা, আমাদের একইসঙ্গে অর্থনীতি ও ব্যবসা উভয়ই বাঁচাতে হবে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তিনি ঋণের সুদহার সীমা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।'

সুদহারের ওপর ক্যাপ উঠিয়ে নেওয়া হলে ব্যাংকগুলো রাতারাতি সুদহার ৯ শতাংশ থেকে ১৫-১৬ শতাংশে নিয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করেন তিনি।

তাই ক্যাপ প্রত্যাহারের বিষয়টি তিনি সমর্থন করছেন না। তিনি বলেন, 'সেটা হলে ব্যবসার জন্য সমস্যা তৈরি হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Why was July 2025 wetter in Bangladesh?

Bangladesh experienced three low-pressure systems on July 7, July 14 and July 24 which led to heavy rain

31m ago