সাত কোম্পানির দখলে জনতার ৫৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ

জনতা ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে খেলাপি হয়েছে অ্যাননটেক্স গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপ।
বাংলাদেশ ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, তফসিলি ব্যাংক,

রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ৫৭ শতাংশ অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট, রতনপুর ও এস আলম গ্রুপসহ সাতটি বড় কোম্পানির। ব্যাংকটির ২৫ হাজার ৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে এই সাত বড় কোম্পানির খেলাপির পরিমাণ ১৪ হাজার ২১০ কোটি টাকা।

এর মধ্যে অ্যানটেক্সের ৭ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা, ক্রিসেন্ট গ্রুপের ১ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা, রতনপুর গ্রুপের ১ হাজার ২২৭ কোটি টাকা, এস আলম গ্রুপের ১ হাজার ২১৫ কোটি টাকা এবং রিমেক্স ফুটওয়্যারের ১ হাজার ৭৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আছে।

জনতা ব্যাংকের আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, চৌধুরী গ্রুপের খেলাপি ঋণ ৬২৫ কোটি টাকা এবং র‌ানকা গ্রুপের ৫৫২ কোটি টাকা।

জনতা ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে খেলাপি হয়েছে অ্যাননটেক্স গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপ।

তিনি বলেন, 'খেলাপি ঋণ বেশি থাকায় ব্যাংকটি এখন বিপাকে পড়েছে।'

এদিকে গত বছর শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেড়ে ২৫ হাজার ৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ। ২০২২ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা।

একটি সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে জানায়, এ বছরের মার্চে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৩১ শতাংশ।

২০২৩ সাল শেষে পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাননটেক্স মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে বলে ব্যাংকটির আর্থিক বিবরণী থেকে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা অ্যাননটেক্সের ঋণে অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি খুঁজে পেয়েছিল। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সম্প্রতি এই ঋণ আগের মতো খেলাপি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।

গত এপ্রিলে জনতা ব্যাংককে ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকার সুদ মওকুফ সুবিধা বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। জনতা ব্যাংক এই সুদ মওকুফ সুবিধা অ্যাননটেক্স গ্রুপকে দিয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে অডিট জালিয়াতি ও কেলেঙ্কারি খুঁজে পেলে ৭ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা খেলাপি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করতে বলা হয়।

ব্যাংকটির আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়েরের পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি থার্মেক্স গ্রুপের ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা এবং সিকদার গ্রুপের ৮২৯ কোটি টাকা মন্দা ঋণকে নিয়মিত ঋণ হিসেবে দেখিয়েছে।

গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১ হাজার ২১৫ কোটি টাকা।

২০২৩ সালে জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৯ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা নিয়েছে ২৩ বড় ঋণগ্রহীতা, যা মোট ঋণের ৭৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

বড় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ ২০ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।

আরেক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের ২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা এবং ওরিয়ন গ্রুপের ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা।

গতকাল দ্য ডেইলি স্টার জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল জব্বারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে এবং হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠায়। কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দেননি।

তবে মো. আব্দুল জব্বার দুই সপ্তাহ আগে এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ব্যাংক এখন বড় ঋণ দেওয়া বন্ধ করে বকেয়া ঋণ আদায়ের চেষ্টা করছে।

তিনি জানিয়েছিলেন, তিনি বেশ উদ্বিগ্ন, কারণ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে।

যোগাযোগ করা হলে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম মাহফুজুর রহমান বলেন, জনতা ব্যাংক ঋণগ্রহীতাদের তালিকা করেছে। কিন্তু তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি।

জনতা একসময় বাংলাদেশের অন্যতম নামকরা ব্যাংক ছিল, তবে অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্টের সঙ্গে জড়িত একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে এর আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে।

২০১৭ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের মার্চে ৩০ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকটির মোট ঋণের ৭৫ শতাংশই পাঁচটি শাখা থেকে বিতরণ করা হয়েছে।

Comments