জনতা ব্যাংক: ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকার রেকর্ড খেলাপি ঋণ

জনতা ব্যাংক

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি হয়ে পড়ায় ২০২৪ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ রেকর্ড ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা হয়েছে। 

ব্যাংকিং খাতে এখন সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকে।

 ব্যাংকের তথ্যে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের মোট ঋণ এক লাখ ৮০০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৬৬ দশমিক আট শতাংশ বা ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

গত সেপ্টেম্বরে জনতার খেলাপি ছিল ৬০ হাজার ৩৪৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে ব্যাংকটির খেলাপি দ্রুত বেড়েছে। প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। যা আগে নিয়মিত দেখানো হতো।

গত জুনে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৪৮ হাজার কোটি টাকা। মাত্র ছয় মাসে তা বেড়েছে ১৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কয়েকটি বড় ঋণগ্রহীতার মধ্যে কেন্দ্রীভূত। শীর্ষ পাঁচ খেলাপির হাতে মোট মন্দ ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ।

এর মধ্যে সবচেয়ে বড় খেলাপি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ।

বেক্সিমকোয় জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে শিল্পগ্রুপটির সব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে।

জনতা ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

অ্যাননটেক্সের খেলাপি সাত হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ক্রিসেন্টের খেলাপি তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকা। থার্মেক্স গ্রুপের খেলাপি দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা। সিকদার গ্রুপের ৮৫০ কোটি টাকা।

জনতা ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে বেক্সিমকো-এস আলম গ্রুপ ঋণ ফেরত না দেওয়ায় তাদের সব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে।

এছাড়াও, ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে যারা আগে যাদের ঋণ নিয়মিত ছিল তারাও এখন খেলাপি।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বসুন্ধরা গ্রুপের ঋণের একটি ছোট অংশ গত ডিসেম্বরে খেলাপি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ হয়। যদিও গ্রুপটি তা পুনঃতফসিলের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।

গত ডিসেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকে বসুন্ধরার মোট ঋণের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির অপর শীর্ষ ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপের গত বছর শেষে মোট ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ঋণের পরিমাণ ছিল সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাত্র কয়েকটি শিল্প গ্রুপের কাছে ব্যাংকটি জিম্মি হয়ে পড়েছে বলেই সংকট গভীর হয়েছে।

জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকোর ঋণ ২০১৫ সালে দুই হাজার ৪৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২০ সালে ছয় হাজার ৪০০ কোটি টাকা হয়।

গত জুনে তা হয় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এটি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের প্রায় ৯৫০ শতাংশ। একক ঋণগ্রহীতা হিসেবে তা ২৫ শতাংশের আইনি সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত বেক্সিমকো নয়টি নতুন প্রতিষ্ঠান চালু করে। ২০২২ সালে মাত্র এক মাসে অতিরিক্ত ঋণ পেতে আরও আটটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়।

জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, সালমান এফ রহমান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময় প্রভাব খাটিয়ে এসব বড় ঋণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিয়েছিলেন।

জনতা ব্যাংককে একসময় দেশের অন্যতম ভালো ব্যাংক হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের একাধিক ঋণ কেলেঙ্কারির পর ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটে।

২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটি আননটেক্সের ২২ প্রতিষ্ঠানকে তিন হাজার ৫২৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে এসব ঋণ অনুমোদনে ব্যাপক অনিয়ম দেখা যায়।

২০১৭ সালে জনতা ব্যাংকের মোট খেলাপি ছিল পাঁচ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। সাত বছরে তা হয়েছে ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

ঋণ অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তা ও পর্ষদ সদস্যদের চিহ্নিত করতে জনতা ব্যাংকের ফরেনসিক অডিটের তাগিদ দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষক ও খাত বিশেষজ্ঞরা।

আর্থিক অবস্থার অবনতির কারণে জনতা ব্যাংক মারাত্মক তারল্য সংকটে পড়েছে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাংকটি জরুরি সহায়তা হিসেবে ২০ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে।

স্বাভাবিক নগদ প্রবাহ বজায় রাখতে ও আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে এই টাকা দরকার।

পর্যাপ্ত জামানতের অভাবে মুদ্রাবাজার থেকে জনতার ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা কমে যাওয়ায় সম্ভাব্য নগদ সংরক্ষণ অনুপাত (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ তারল্য অনুপাত (এসএলআর) ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

জনতা ব্যাংকের নবনিযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মজিবুর রহমান সম্প্রতি বলেছেন, খেলাপি আদায়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে।

টাকা উদ্ধারে বড় খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও নিশ্চিত করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Pahela Baishakh sales better this year

In previous years, Baishakh celebrations and the purchase of new dresses accounted for an estimated one-fourth of annual sales by local fashion outlets.

22m ago