অর্থনীতির ৪ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংক
স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

ক্রমাগত মূল্যস্ফীতি, অস্থিতিশীল মুদ্রা বাজার, ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ মোকাবিলার পাশাপাশি রিজার্ভ শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকটি নীতিগত উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে।

এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে এই চার সংকট মোকাবিলার পথ খুঁজতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত অবস্থান তৈরি করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন এবং এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের মতামত নেওয়া শুরু করেছে।

গত বৃহস্পতিবার গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারসহ চার ডেপুটি গভর্নর স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

পরে, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ ও নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এবং ব্যবসায়ীদের সংগঠন, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্টেকহোল্ডারদের মতামত নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিগত অবস্থান চূড়ান্ত করা হবে। মুদ্রানীতির মাধ্যমে এর বাস্তবায়ন শুরু হলেও এর আগে কিছু উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।'

অপর এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি আর্থিক খাতের উন্নতির লক্ষ্যে টেকসই নীতি হবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা বাস্তবায়ন করবে।'

গত বৃহস্পতিবার অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত অবস্থান স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ এমন সময়ে এসেছে যখন দেশের অর্থনীতি আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতা, ডলারের মজুদ কম ও ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণসহ একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

গত আগস্টে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ২৩ পয়েন্ট বেড়ে গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ নয় দশমিক ৯২ শতাংশে পৌঁছেছে। পুরো অর্থবছরে সরকারের মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ছয় শতাংশ। গত জুলাইয়ে তা ছিল নয় দশমিক দুই শতাংশ।

এখনো মূল্যস্ফীতি কমার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছে না।

গত ২১ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। কেননা, সরবরাহের তুলনায় ডলারের চাহিদা বেশি।

গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৯ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। গতকাল শনিবার ডলারের দাম ছিল ১১০ টাকা। গত বছরের জানুয়ারিতে এটি ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা।

বিশেষজ্ঞরা বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য সুদের হার ও মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণকে দায়ী করছেন।

গত জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সীমা তুলে নেয় এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চার দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত পূরণের জন্য বাজারভিত্তিক সুদের হার চালু করে। তবে বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই হার এখনো পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হয়নি।

একইভাবে, যদিও বৈদেশিক মুদ্রার বাজার পরিচালনার নিয়মগুলো শিথিল করা হয়েছে, তবুও একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হার এখনো বিদ্যমান।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা ভালো যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতিবিদসহ স্টেকহোল্ডারদের মতামত নিচ্ছে।'

তার মতে, 'সুপারিশ বা মতামত বাস্তবায়ন না হলে তা গ্রহণের কোনো মানে হয় না।'

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, 'সুদ ও মুদ্রার বিনিময় হার এখনো নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অথচ তা কোনো ইতিবাচক ফল নিয়ে আসেনি।'

'উভয় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হতে হবে,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ অর্থনীতির জন্য আরেকটি উদ্বেগের বিষয়।

গত মার্চে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এটি আগের বছরে ১৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ বেড়েছে। এটি বিতরণ করা মোট ঋণের আট দশমিক ৮০ শতাংশ।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন ২০২২-এ বলা হয়েছে, ২০২২ সালে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ ছিল তিন লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠককালে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ খেলাপি ঋণ আদায় দ্রুততর করার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি মনে করেন, 'খেলাপি ঋণ আদায় ছাড়া ঋণ বিতরণের পরিধি বাড়ানো সম্ভব নয়।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হানের।

তিনি বলেন, 'মুদ্রানীতি স্বাধীনভাবে বাস্তবায়নের পাশাপাশি তা গতিশীল করতে হবে। শুধু নীতি প্রণয়নই যথেষ্ট নয়।'

অর্থনীতির এই অধ্যাপক আরও বলেন, 'খেলাপি ঋণ কমানো এবং ব্যাংকিং খাতে, বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোয় সুশাসন আনার ক্ষেত্রে একমাত্র কর্তৃত্ব বাংলাদেশ ব্যাংককে দিতে হবে।'

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারছে না।

'কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ব্যাংকিং খাতে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Multiple blasts heard in Tehran, black smoke visible in east: AFP

Israel army says struck Iran centrifuge production, weapons manufacturing sites

20h ago