ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট তীব্র হয়েছে

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত কল মানি রেট তখন বৃদ্ধি পায়, যখন ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ে ও বাজার থেকে অর্থ ধার করে।
ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট

বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে। এতে বেশিরভাগ ব্যাংক তাদের কার্যক্রম চালাতে কল মানি মার্কেট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো সুদহার বাড়ালেও ব্যাংকগুলো ঋণ নেওয়া কমায়নি বলে জানিয়েছেন এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

গত বুধবার ৩২টি ব্যাংক ও তিনটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) সাত দিনের রেপো সুবিধা, ১৪ দিনের ইসলামি ব্যাংকের তারল্য সুবিধা ও একদিনের তারল্য সুবিধার আওতায় ২০ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।

এর একদিন আগে ২৭টি ব্যাংক ও একটি এনবিএফআই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আরও ১৩ হাজার ৪২২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল।

একই সময়ে কল মানি রেট ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। কল মানি হলো এক থেকে ১৪ দিনের ম্যাচিউর সময়কালের একটি ন্যূনতম স্বল্পমেয়াদী ঋণ, যা চাহিদা অনুযায়ী পরিশোধ করতে হয় এবং আন্তঃব্যাংক লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হয়।

গত বুধবার গড় ওভারনাইট কল মানি রেট দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা গত বছরের জুলাইয়ের একই দিনে ছিল ৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত কল মানি রেট তখন বৃদ্ধি পায়, যখন ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ে ও বাজার থেকে অর্থ ধার করে।

বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে সংকট, আমানতের ধীর গতি, কিছু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের প্রতি আস্থার অভাব, রেকর্ড খেলাপি ঋণ ও ঋণ আদায়ে ধীরগতি ইত্যাদি তারল্য সংকটের প্রধান কারণ।

তারা আরও বলেন, তবে দেশে চলমান মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়িয়েছে, এতে তারল্য সংকট আরও প্রবল হয়েছে।

গত অক্টোবরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ করার পর থেকে কল মানি রেট দ্রুত বাড়তে থাকে।

এরপর নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে রেপো রেট নামে পরিচিত পলিসি রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ করে।

ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরে সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সম্প্রতি সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় অর্থ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ আমানতের হারের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি সুদ পাওয়ায় গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছেন।

বৃহস্পতিবারের নিলামে সরকার যথাক্রমে ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ, ১১ দশমিক ২০ শতাংশ এবং ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে ৯১ দিন, ১৮২ দিন এবং ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ৬ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে।

আমানত সংগ্রহে সরকার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এ কারণে ব্যাংকিং খাত এখন চরম তারল্য সংকটে ভুগছে।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তারল্য সংকটের কারণে তারা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন।

তিনি আরও বলেন, 'সরকারও তারল্য সংকটের মুখে পড়েছে, তাই অর্থ সংগ্রহে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার বাড়িয়েছে।'

এদিকে, রোববার অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে ব্যাংকগুলোর বাইরে টাকার পরিমাণ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ব্যাংকগুলোর বাইরে টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই মাসে ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা।

তিনি আরও বলেন, তারল্য সংকট ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক নগদ প্রবাহে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, কারণ গত ১৮ মাস ধরে বৈদেশিক মুদ্রা সংকট, আমানতের ধীর প্রবৃদ্ধি ও ঋণ আদায়ে ধীর গতির মতো সমস্যার মধ্যে আছে এই খাত।

গত দুই বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির পূরণে ব্যাংকগুলো টাকার বিনিময়ে আন্তঃব্যাংক প্লাটফর্ম ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে।

গত বছরের জুলাই-ডিসেম্বরে রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরে সমপরিমাণ টাকার বিপরীতে ব্যাংকগুলোতে ১৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছিল।

এদিকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ঋণ অনিয়মের কারণে চরম তারল্য সংকটে পড়েছে।

গত বছরের নভেম্বরে ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা, যা জুলাইয়ের ১ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকার চেয়ে কম।

যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির্জা ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ঋণগ্রহীতারা ঋণের অর্থ ফেরত না দেওয়ার অজুহাত হিসেবে বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছেন।

'এতে ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি আরও প্রকট হয়েছে,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

1h ago