সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেওয়ার পরও বাজারে অর্থ ঢালছে বাংলাদেশ ব্যাংক

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ব্যাংক থেকে কম ঋণ নেওয়ার পরামর্শ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেওয়ার পরও অর্থনীতিতে নতুন অর্থের সরবরাহ করা হচ্ছে, যা একটি পরস্পরবিরোধী উদ্যোগ। ফলে, এটি উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন করে তুলতে পারে।

যদিও চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ এ ধরনের অর্থায়ন ভোক্তা মূল্য সূচক বা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।

এছাড়া ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। গত বছরের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর আছে।

যেকোনো দেশের অর্থনীতিতে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে নীতি সুদহার বা রেপো রেট। তাই বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অর্থ সরবরাহ, মূল্যস্ফীতি ও তারল্য নিয়ন্ত্রণে এটি ব্যবহার করে থাকে।

গত ১৭ জানুয়ারি প্রকাশিত নতুন মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো রেট ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করেছে। মূলত ২০২২ সালের মে থেকে আর্থিক নীতিতে কড়াকড়ি শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপর থেকে এ নিয়ে অষ্টমবারের মতো নীতি সুদহার বাড়ানো হলো।

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো বিভিন্ন উপায়ে অর্থনীতিতে অর্থ ঢালছে। যেমন- বিভিন্ন ব্যাংককে তারল্য সহায়তা, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে বিশেষ তারল্য সহায়তা ও বিশেষ ট্রেজারি বন্ডের বিপরীতে বিশেষ রেপো সুবিধা দিচ্ছে।

সাধারণত তারল্য ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলো রেপো সুবিধা, নিশ্চিত তারল্য সহায়ক সুবিধা, নিশ্চিত রেপো সুবিধা, স্থায়ী ঋণ সুবিধা ও ইসলামী ব্যাংকের তারল্য সুবিধার আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকে।

এভাবে গত ২৮ জানুয়ারি নিলামে ৩৩টি ব্যাংক ও একটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১০ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রেপো ও নিশ্চিত তারল্য সহায়তার আওতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১৩ লাখ ৮ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যা এক বছর আগে ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিশ্রুতি নোটের বিপরীতে কিছু ইসলামী ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। এই সুবিধায় একটি ব্যাংক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণ নিতে পারে।

গত ২৮ ডিসেম্বর পাঁচটি ইসলামি ব্যাংকসহ সাতটি দুর্বল ব্যাংককে ২২ হাজার কোটি টাকা জরুরি তহবিল থেকে ঋণ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক।

এখানে উল্লেখ্য সার ও বিদ্যুতের বকেয়া বিল পরিশোধে সরকার বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করেছে। ওই বন্ডের বিপরীতে গত ২২ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ছয়টি ব্যাংককে ১২ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক এই অর্থ নিয়েছে। তবে, অন্য ব্যাংকগুলো রেপো রেটে নিলেও ইসলামী ব্যাংক শূন্য সুদহারের বন্ডের বিপরীতে এই অর্থ নিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সরকারের জন্য টাকা ছাপানোর প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থগিত করলেও অর্থ সরবরাহ এখনো চলছে।

তিনি বলেন, 'এ অর্থায়ন অব্যাহত থাকলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা কাজে লাগবে না।'

তিনি আরও বলেন, বন্ড বা অন্য কোনো সরকারি সিকিউরিটিজের বিপরীতে অর্থ সরবরাহ করাও অর্থ ছাপানোর একটি ফর্ম, যা মূল্যস্ফীতি আরও বাড়াবে।

চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন মাসের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, মার্কিন ডলার সরবরাহ করে ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের অর্থ তুলে নিয়েছে  কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাই ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বাজারে টাকা ঢালছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, প্রভাব একই রকম হবে।

তিনি বলেন, 'বিশেষ বন্ডের বিপরীতে অর্থ সরবরাহ করায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। এই টুল ব্যবহার না করে সরাসরি সরকারকে অর্থ সরবরাহ করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলোকে বন্ডের বিপরীতে নগদ অর্থের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক আশিকুর রহমান বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছে এবং রেপো রেট বাড়িয়েছে। অন্যদিকে দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য টাকা ছাপাচ্ছে।'

'এটি একটি পরস্পরবিরোধী উদ্যোগ। কোনো অর্থনীতিতে এভাবে অর্থ সরবরাহ করা হলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে,' যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'যখন বাজারে ২২ হাজার কোটি টাকা সরবরাহ করা হয়, তখন মানি মাল্টিপ্লায়ার এফেক্টের কারণে বাজারে এক লাখ কোটি টাকার প্রভাব পড়ে।'

তিনি দুর্বল ও সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর জন্য টাকা ছাপানো বন্ধ করে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করেন।

Comments

The Daily Star  | English
Not satisfied at all, Fakhrul says after meeting Yunus

Not satisfied at all, Fakhrul says after meeting Yunus

"The chief adviser said he wants to hold the election between December and June"

1h ago