ব্যাংক একীভূত হলে কার লাভ কার ক্ষতি?

মূলত সংকটে পড়া ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারই অংশ এই একীভূতকরণ।
বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংক একীভূতকরণ, এক্সিম ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক,

খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত পদ্মা ব্যাংককে অধিগ্রহণ করতে যাচ্ছে এক্সিম ব্যাংক। মূলত সংকটে পড়া ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারই অংশ এই একীভূতকরণ। আরও কয়েকটি দুর্বল ব্যাংক একই পথ অনুসরণ করতে পারে।

যদিও কর্তৃপক্ষ একীভূতকরণ শব্দটি ব্যবহার করছে, তবে শেষ পর্যন্ত এটি হবে অধিগ্রহণ। যেখানে এক্সিম ব্যাংক পদ্মা ব্যাংক কিনে নেবে এবং একসময় পদ্মা ব্যাংকের অস্তিত্ব থাকবে না।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণ কোনো নতুন ধারণা নয়, বরং দেশে ও বিদেশে সফল একীভূতকরণের অনেক উদাহারণ আছে। তবে এবারের উদ্যোগে কে জিতবে আর কে হারবে কিংবা কার লাভ হবে, কার ক্ষতি হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যেতে পারে, যেসব ব্যাংক খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত ব্যাংকগুলোকে অধিগ্রহণ করবে সেসব ব্যাংকের শেয়ার বিনিয়োগকারীরাই হয়তো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। অন্যদিকে পদ্মা ব্যাংকের বর্তমান দুর্দশার জন্য যাদের অপকর্ম অনেকাংশে দায়ী, তারাই হয়তো লাভবান হবেন।

এ কথা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায় যে, দুর্বল ব্যাংকগুলোর উচ্চ খেলাপি ঋণ, কম দক্ষতা ও সুশাসনের অভাব রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে না। তাই অধিগ্রহণকারী ব্যাংককে ব্যবসায়িক নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে এবং সমস্যাযুক্ত শাখাগুলোতে সুশাসন ফেরাতে বাড়তি উদ্যোগ নিতে হবে। এতে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের মুনাফা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে ব্যাংকগুলো ভালো লভ্যাংশ দিতে পারবে না, ফলে ক্ষতির শিকার হবেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে তাদের শেয়ারের দরপতন হতে পারে।

সরকার দুর্বল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের দায়িত্ব নিলেও অধিগ্রহণকারী ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংকের নিয়মিত ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে কাজ করতে হবে, যারা সঠিকভাবে নিয়মনীতি মেনে চলেনি।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) কথা বলা যেতে পারে। রাষ্ট্রায়ত্ত দুই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্পঋণ সংস্থা একীভূত হয়ে বিডিবিএল গঠন করেছিল। আর দুটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করে নতুন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পরও তাকে ভালো করা কতটা কঠিন তার উদাহরণ এই বিডিবিএল।

উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে একীভূত হওয়ার ১৪ বছর পরও হিমশিম খাচ্ছে বিডিবিএল।

সঙ্গত কারণেই তাই প্রশ্ন উঠেছে, ভালো ব্যাংকে বিনিয়োগ করা একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী কেন দুর্বল ব্যাংকের বোঝা বহন করবেন?

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী, উভয়পক্ষকে তাদের শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে।

অর্থাৎ নিয়ম অনুযায়ী, যদি বার্ষিক সাধারণ সভা বা অতিরিক্ত সাধারণ সভার সময় অধিগ্রহণ প্রস্তাবে ভোট নেওয়া হয়, তাহলে এই প্রস্তাবের পক্ষে বেশি হ্যাঁ ভোট থাকতে হবে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একটি ভালো ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা দুর্বল ব্যাংক কেনার অনুমতি দেবেন কি না?

খুব স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্নের উত্তর 'না' হওয়া উচিত, কারণ এটি তাদের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

কিন্তু শেয়ারহোল্ডারদের মিটিংয়ে এজেন্ডা পাস হওয়ার ইতিহাস ভালো কিছু বলছে না। ইতিহাস বলছে, পরিচালনা পর্ষদ যে কোনো উপায়ে একটি প্রস্তাবের অনুমোদন করে! এজন্য তারা ভুয়া বিনিয়োগকারীদের হাজির করে বা প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের চুপ থাকতে বাধ্য করে।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ভালো পারফর্ম করা ব্যাংকগুলোর অধিকাংশই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অধিগ্রহণ করতে চায় না।

একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, 'ভালো পারফর্মিং ব্যাংক হওয়া কি পাপ? কেন আমাদের ডুবে যাওয়া ব্যাংকের দায়িত্ব নিতে হবে?'

সরকার একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কিনে অধিগ্রহণকারীদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। সেক্ষেত্রে করদাতাদের টাকা ব্যবহার করতে যাচ্ছে সরকার।

তবে করদাতারা এমন একটি উদ্যোগের অনুমোদন দেবে বলে মনে হয় না, কারণ এই উদ্যোগের মাধ্যমে বেশিরভাগ রাজনৈতিকভাবে সমর্থিত বড় ঋণখেলাপি উপকৃত হবেন।

তাই ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ কোনোটিই কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনবে না।

সুতরাং, সরকারের উচিত ছিল দুর্বল ব্যাংকগুলোর ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া, যেন আমানতকারীরা কোনো ব্যাংকে অর্থ রাখার আগে আগে কয়েকবার ভাবেন।

পাশাপাশি দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঋণখেলাপিদের নাম প্রকাশ করতে বাধ্য করতে হবে, তাদের সামাজিকভাবে লজ্জায় ফেলতে হবে। তা না করে একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ করা হলে ঋণখেলাপিদের শাস্তি হবে না, কোনো পরিচালক বা ব্যাংক কর্মকর্তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে না, এমনকি জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ চুরি বা চুরিতে সহায়তা করার জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হবে না।

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, ব্যাংকগুলোর পতনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিষয়ে জনগণ কখনোই কিছু জানতে পারবে না। বরং ঋণখেলাপিরা মুক্ত হয়ে পরবর্তী শিকারের সন্ধানে থাকবেন!

Comments