‘ইউসিবি ছাড়তে আমাদের বাধ্য করা হয়েছিল এবং প্রধানমন্ত্রী সব জানতেন’

শরীফ জহীর
শরীফ জহীর। ছবি: স্টার

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে জানতেন বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান শরীফ জহীর ।

সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শরীফ জহীর বলেন, 'ব্যাংক ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না কারণ সাইফুজ্জামান তখন মন্ত্রী ছিলেন। বোর্ডে চুপ করে থাকার চেয়ে পদত্যাগ করা ভালো বলে মনে হয়েছিল।'

গত ২৭ আগস্ট চার দশকেরও বেশি পুরোনো বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ইউসিবির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৮ সাল থেকে ব্যাংকটি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান ও তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক দুজন শেয়ারহোল্ডার পরিচালক এবং তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালকসহ পাঁচ সদস্যের একটি বোর্ড নিয়োগ দেয়। শরীফ জহীর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

শরীফ বলেন, সম্প্রতি পুনর্গঠিত অন্যান্য ব্যাংকের মতো ইউসিবির তারল্য সংকট নেই। তিনি বলেন, তারা এখন সুশাসন প্রতিষ্ঠার অংশ হিসাবে গ্রাহকদের আস্থা পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করছেন, যে প্রক্রিয়াটি রাজনৈতিক প্রভাব এবং অসদাচরণের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।

এই বাধার জন্য তিনি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানকে দায়ী করেন, যিনি মন্ত্রী থাকাকালীন ২০১৮ সালের জুনে ইউসিবির পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

'তিনি আমাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন এবং তার পরিবারের সদস্যদের বোর্ডে নিয়ে এসেছিলেন,' বলেন শরীফ।

শরীফ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার তাদের (সাইফুজ্জামান) সমর্থন করায় বোর্ডে কথা বলা কঠিন ছিল। তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাংকের বিষয়গুলো সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিলেন।

শরীফ বলেন, তিনি ব্যাংক দখলের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদারের কাছে অভিযোগ করেছিলেন। নজরুল ইসলাম পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন।

'চেক অনুদানের একটি কর্মসূচিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাই তিনি আমাদের কাছে জানতে চান ইউসিবিতে আমাদের এত সমস্যা হচ্ছে কেন?' , বলেন শরীফ।

জবাবে শরীফ প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, 'আপনি তো সব জানেন।'

'সেসময় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব ছিল না,' বলেন শরীফ।

১৯৮৩ সালে ব্যাংকটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সাইফুজ্জামানের বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবং শরীফ জহিরের বাবা মো. হুমায়ুন জহির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন।

পরে আখতারুজ্জামান চৌধুরীকে বোর্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং ১৯৯৩ সালে 'বোর্ড বিরোধ' বিতর্কে হুমায়ুন জহিরকে হত্যা করা হয়।

শরীফ বলেন, শেখ হাসিনা সে সময় শোক জানাতে তাদের বাসভবনে এসেছিলেন।

শরীফ বলেন, ২০১৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাবু ও তার পরিবারের সদস্যরা ব্যাংকের বোর্ডে ফিরে আসেন। সাইফুজ্জামান পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব নেওয়ার আগে ২০১৮ পর্যন্ত ব্যাংকটি ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছিল।

ব্যাংকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জহির বলেন, তারা ফরেনসিক অডিট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইতোমধ্যে একটি অডিট ফার্ম তাদের নিরীক্ষা শুরু করেছে।

ফরেনসিক অডিট হলো, কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত খতিয়ে দেখা।

শরীফ জহীর বলেন, 'যথাযথ নিরীক্ষার পর আমরা ব্যাংকের প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে পারব। এটি একটি বড় ব্যাংক যেখানে দুই মিলিয়ন গ্রাহক এবং ৬০ হাজার কোটি টাকার আমানত আছে।'

তিনি বলেন, তৈরি পোশাক এবং ট্রেড ফাইন্যান্স ব্যাংকের জন্য প্রধান বিনিয়োগের ক্ষেত্র।

শরীফ বলেন, ব্যাংকটি বর্তমানে গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে। পরিচালনা পর্ষদ ম্যানেজমেন্ট টিমকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং একসঙ্গে কাজ করার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছে।

'আমরা ব্যাংকের জন্য নতুন স্লোগান নিয়ে এসেছি: "ইউনাইটেড ইন ইন্টিগ্রিটি, গ্রোয়িং সাসটেইনেবলি"। আমরা ভালো করপোরেট শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই, বলেন তিনি।

শরীফ বলেন, 'ব্যাংক এখন বড় ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে যাতে তারা কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে পারে। আমরা প্রতিদিনই ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি, তবে তারল্য সংকট নেই।

তিনি বলেন, ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে স্ট্যাচুটরি লিকুইডিটি রেশিও (এসএলআর) এবং ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) বজায় রাখছে এবং এবং ম্যানেজমেন্টকে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা পূরণে সব রকমের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকটি আমানতকারীদের শতভাগ চাহিদা পূরণ করছে। ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান বলেন, প্রয়োজনে আমরা ব্যাংকের মূলধন ভিত্তি বাড়াব।

ব্যাংকিং খাত নিয়ে শরীফ জহীর বলেন, নিয়ম-কানুনগুলো ভালো হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা বাস্তবায়নের ঘাটতি ছিল।

তিনি বলেন, 'সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এদিকে নজর দিতে হবে। সরকারের উচিত কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া, যা এই খাতে শাসন ব্যবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করবে।'

তিনি বলেন, ইউসিবির নতুন বোর্ডের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে ব্যাংকের স্ট্রাটেজি প্রণয়ন করা।

ইউসিবি সম্পর্কে শরীফ বলেন, আস্থা তৈরিতে ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছেন তারা।

'ব্যাংক সম্প্রসারণের জন্য আমরা আমাদের পরিচালনা পর্ষদে তরুণ প্রজন্মকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই।'

তিনি আরও বলেন, 'রাজনৈতিকভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিরা যেন ব্যাংকিং খাতে না আসেন।'

'ব্যাংকিং এবং রাজনীতি আলাদা ক্ষেত্র,' বলেন শরীফ।

তিনি বলেন, যখন কোনো সংসদ সদস্য পরিচালনা পর্ষদে দায়িত্ব পালন করেন তখন স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যারা ব্যবসা বা ব্যাংকিংয়ে প্রবেশ করতে চান তাদের বৈষম্য বা অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস ও মানসিকতা থাকতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Election Roadmap: BNP unhappy as Yunus gives no specific timeline

The election must be held by December, as any delay could cause the situation to spiral out of control, the BNP said after a meeting with the chief adviser yesterday.

8h ago