ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের অন্ধকার অতীত

১৯৯৩ সালে এই ব্যাংকের পরিচালক হুমায়ুন জহিরকে তার ধানমন্ডির বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর পর থেকে ব্যাংকটির ওপর সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়।

বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) পুরোনো পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন করে পর্ষদ গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এই ব্যাংকটির আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি অতীত আছে। প্রায় ২৫ বছর আগে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী পরিবার বন্দুকের মুখে এই ব্যাংকটির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল।

১৯৯৩ সালে এই ব্যাংকের পরিচালক হুমায়ুন জহিরকে তার ধানমন্ডির বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর পর থেকে ব্যাংকটির ওপর সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। এর সঙ্গে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রয়াত বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরীর নামও জড়িয়ে আছে। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা আখতারুজ্জামান ও তার ছেলের ওপর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন।

হুমায়ুন জহির হত্যার পর ইউসিবির তৎকালীন চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান চৌধুরী গ্রেপ্তার হন। জামিনে মুক্তি পেয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান তিনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশে ফিরে আসেন তিনি।

১৯৯৯ সালে ব্যাংকটির হেড অফিসে পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক চলার সময় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের লোকজন হানা দেন। তারা ব্যাংকটির পরিচালকদের পদত্যাগে বাধ্য করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক তখন ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী ব্যাংকটির বোর্ডে ফিরে আসেন।

অস্ত্রের মুখে ব্যাংক দখলের ওই ঘটনার সঙ্গে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিরা জানান, বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে সেটা ছিল অন্যতম কালো অধ্যায় যা শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালে। ওই বছর ইউসিবির পরিচালনা পর্ষদ থেকে আখতারুজ্জামানকে বরখাস্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিজের কোম্পানির নামে ব্যাংক থেকে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করায় তার বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয় তখন।

আখতারুজ্জামান ইউসিবির চেয়ারম্যান হয়েও ঋণ পরিশোধ না করায় প্রতিবাদ করেছিলেন হুমায়ুন জহির। বাংলাদেশের ইতিহাসে খেলাপি ঋণের সেটাই ছিল প্রথম বড় ঘটনা। হুমায়ুন জহিরের ছেলে শরিফ জহির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, যখন আমার বাবা প্রতিবাদ জানিয়ে বাবুকে (আখতারুজ্জামান চৌধুরী) ঋণের টাকা পরিশোধ করতে বলেন তখন থেকেই তিনি আমার বাবার শত্রু হয়ে ওঠেন।

শরিফ জহির বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ গার্মেন্টস রপ্তানিকারী ও ব্যবসায়ী গ্রুপ অনন্তের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

শরিফ বলেন, আখতারুজ্জামান তার ভাইপো ও এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলমকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকটি দখল করেন।

১৯৯৩ সাল থেকে শরিফ ইউসিবির বড় অংশের শেয়ারের মালিক ছিলেন। তার পরিবার ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির শেয়ার ধরে রেখেছিলেন। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তবে ২০১৮ সালে প্রথম প্রজন্মের এই বেসরকারি ব্যাংকটিকে আরেক দফায় বলপূর্বক দখল করা হয়। এবার এই কাজটি করেন আখতারুজ্জামান চৌধুরীর ছেলে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী।

গত মঙ্গলবার সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যাংকটিকে মুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এদিন ব্যাংকটির ১৮ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেন। এই ১৮ জনের মধ্যে ছিলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বোন রোক্সানা জামান চৌধুরী এবং তাদের আত্মীয় আনিসুজ্জামান চৌধুরী ও আসিফুজ্জামান চৌধুরী।

১৬ আগস্ট পর্যন্ত সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুখমিলা জামান ইউসিবির চেয়ারম্যান ছিলেন। ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, সেদিন ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। তবে পুনর্গঠন করা পর্ষদেও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের রাখা হয়েছিল।

শরীফ জানান তিনি এখন বিদেশে অবস্থান করছেন। তিনি আগামী দু-এক দিনের মধ্যে বাংলাদেশে ফিরে আসবেন এবং ইউসিবির পরিচালনা পর্ষদে নবনিযুক্ত পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা পরিকল্পনা করছেন।

১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম ভিত্তিক ব্যবসায়ীদের একটি গ্রুপের হাতে ইউসিবি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে সুনামের সঙ্গে গ্রাহক সেবা দিলেও সাইফুজ্জামানের পরিবার দখলে নেওয়ার পর পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারিতে যুক্ত হতে থাকে ব্যাংকটির নাম।

২০২৩ সালে ইউসিবির খেলাপি ঋণের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০১৬ সালে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। তবে এই খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি।

এর মধ্যেই সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তি নিয়ে গড়ে তুলেছেন রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য। তিন বারের এই এমপির সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাল লন্ডনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটসে আবাসন—যেখানে ইংল্যান্ডের বৃহত্তম বাংলাদেশি কমিউনিটির আবাসস্থল এবং লিভারপুলে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ভবন।

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী সাইফুজ্জামান ও রুখমিলা যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইতেও বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন।

 

Comments