ডলার ঘাটতি-মূল্যস্ফীতিতে গাড়ি বিক্রি কমেছে

ডলার ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি, বাংলাদেশের ‍মূল্যস্ফীতি, গাড়ি বিক্রি,
স্টার ফাইল ফটো

ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, বাড়তি সুদের হার ও টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়নের কারণে কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংকটে থাকা শিল্পগুলোর সার্বিক অবস্থা নিয়ে প্রতিবেদনগুলোর এই পর্বে থাকছে গাড়িশিল্প।

গত অর্থবছরে দেশে গাড়ি বিক্রি কমেছে। উৎপাদন ও চাহিদা কমায় অন্যসব খাতের মধ্যে এই শিল্পের মুনাফা সবচেয়ে বেশি কমেছে।

ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির জন্য এলসি খুলতে জটিলতা দেখা দেওয়ায় গত অর্থবছরে গাড়ি উৎপাদন কমাতে বাধ্য হন স্থানীয় নির্মাতারা।

মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। তারা ব্যক্তিগত গাড়ির মতো পণ্যের পরিবর্তে অতি প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন।

দেশে চার তালিকাভুক্ত গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হলো— রানার অটোমোবাইলস, ইফাদ অটোস, আফতাব অটোমোবাইলস ও অ্যাটলাস বাংলাদেশ।

প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক বিবরণীতে বলা হয়েছে—২০২২-২৩ অর্থবছরে তাদের সম্মিলিত বিক্রি ২২ শতাংশ কমে এক হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।

ওই অর্থবছরে তাদের সম্মিলিত লোকসান হয় ১২০ কোটি টাকা। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরে তাদের মোট মুনাফা ছিল ৮২ কোটি টাকা।

রানার অটোমোবাইলসের চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার সনৎ দত্ত দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০২২-২৩ অর্থবছরে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের গাড়িশিল্প সংকটে ছিল।'

তিনি আরও বলেন, 'মূলত গাড়ি তৈরির কাঁচামালের ঘাটতির কারণে এটি হয়েছিল। ডলার সংকটের কারণে সরকার আমদানি সীমিত করেছিল, যার প্রভাব পড়েছে গাড়িশিল্পে।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশীয় গাড়ি নির্মাতারা ১১ কোটি ৯০ লাখ ডলারের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানির জন্য এলসি খুলেছিলেন। এটি এর আগের বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ কম।

একইভাবে, নতুন গাড়ি আমদানির জন্য এলসি খোলার সংখ্যা একই সময়ে ৫৯ শতাংশ কমে ২৮১ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।

সনৎ দত্তের মতে, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রেতারা প্রয়োজনীয় কেনাকাটাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলে এই প্রবণতা আরও তীব্রভাবে দেখা যাচ্ছে। সেখানে মানুষ আরও বেশি আর্থিক সংকটে আছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

সনৎ দত্ত আরও বলেন, 'লো ডিসপ্লেসমেন্ট মোটরসাইকেলের চাহিদা কমেছে এবং হাই ডিসপ্লেসমেন্ট মোটরসাইকেলের চাহিদা বেড়েছে।'

'এর কারণ হতে পারে উচ্চবিত্ত পরিবারগুলো হয়তো মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে কিছুটা মুক্ত। অর্থাৎ, প্রিমিয়াম সেগমেন্টে চাহিদার খুব হেরফের হয় না।'

এরপরও রানারের বিক্রি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪০ শতাংশ কমে ৬৬২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৯৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। গত অন্তত ১০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে পড়ল।

প্রতিদিন প্রায় ৫০০ মোটরসাইকেল উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন রানার ৫০ থেকে ২০০ কিউবিক সেন্টিমিটার ইঞ্জিন ডিসপ্লেসমেন্টসহ ৪০টি মডেলের নয় সিরিজের মোটরসাইকেল তৈরি করে।

রানার লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস ও ডিজেলচালিত পাঁচটি মডেলের থ্রি-হুইলারও তৈরি করে।

তবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কঠিন পরিস্থিতি পার করা সত্ত্বেও সহায়ক নীতির কারণে আগামীতে এ ব্যবসা প্রসারের সম্ভাবনা আছে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, গাড়িশিল্প উন্নয়ন নীতিমালা ২০২১ প্রণয়নের পর থেকে এ শিল্পে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে।

নীতিমালা অনুযায়ী তিন ও চার চাকার গাড়ি সংযোজনের পাশাপাশি মোটরসাইকেল নির্মাতারা কাঁচামাল আমদানিতে কম শুল্ক দেবেন।

বার্ষিক প্রায় দুই হাজার ৪০০ গাড়ি উত্পাদন ক্ষমতা নিয়ে আফতাব অটোমোবাইলস বর্তমানে টয়োটা ও হিনো ব্র্যান্ডের ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক গাড়ি সংযোজন করছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি ৬৬ শতাংশ বেড়ে ১১৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগের বছরের মুনাফা ১০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৪১ লাখ টাকা হয়েছে।

আফতাব অটোমোবাইলসের চেয়ারম্যান শফিউল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দ্রুত পরিবর্তিত ও প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিক যানবাহন বিভাগ অস্থিতিশীল ব্যবসায়িক পরিবেশে পড়েছে।'

তিনি বলেন, 'করোনা মহামারির কারণে দেশে লকডাউন ও চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গাড়িশিল্পে উদ্বেগজনক প্রভাব ফেলেছে।'

'তবে আমরা মনে করি, এই প্রভাব সাময়িক। আশা করছি, আগামী বছরের মধ্যে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠা যাবে।'

তিনি আরও বলেন, 'পদ্মা সেতুসহ অন্যান্য বড় বড় প্রকল্প নির্মাণের ফলে দেশ তথা গাড়িশিল্পের ওপর অর্থনৈতিক প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়বে।'

পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে রাজধানীর সঙ্গে সংযুক্ত করায় পরিবহন খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।

পরিবহন প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন রুটে চলাচল করায় সাধারণ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের চাহিদা বাড়ছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে ইফাদ অটোসের বিক্রি চার শতাংশ কমে ৯০৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত অন্তত ১২ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি প্রথমবারের মতো ১৫ কোটি টাকা লোকসান করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা হয়েছে ৪১ কোটি টাকা।

ইফাদ অটোস ভারতীয় ব্র্যান্ডের সম্পূর্ণ নক-ডাউন ইউনিট ও খুচরা যন্ত্রাংশের পাশাপাশি অশোক লেল্যান্ডের বেশ কয়েকটি মডেলের গাড়ি আমদানি করে।

প্রতিষ্ঠানটি ফার্মট্র্যাক ব্র্যান্ডের কৃষি-যন্ত্রপাতি ও এসকর্টস লিমিটেডের আমদানি করা খুচরা যন্ত্রাংশও বিক্রি করে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে তালিকাভুক্ত অপর গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাটলাস বাংলাদেশের বিক্রি এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ৯৮ শতাংশ কমে এক কোটি ৫৪ লাখ টাকা হয়েছে। এটি এর আগের বছর চার কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসানের পর নয় কোটি ৬০ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

BGMEA wants 3-month window from India to clear pending shipments

The association urges the interim government to send a letter to India seeking the opportunity

1h ago