আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে পচনশীল ব্যাগের উৎপাদন

সময়মতো পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না পাওয়ায় ইফতেখারুল হক এই ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারছেন না।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে পচনশীল ব্যাগের উৎপাদন
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ক্রিস্টাল বায়োটেক কারখানায় কম্পোস্টেবল বায়োপ্লাস্টিক ব্যাগ পরিদর্শন করছেন একজন শ্রমিক। ছবি: আনোয়ার আলী

রাজশাহীর উদ্যোক্তা মো. ইফতেখারুল হক ২০২২ সালে সফলভাবে পচনশীল শপিং ব্যাগ উৎপাদন শুরু করেন। তার এই পচনশীল ব্যাগ পলিথিন বর্জ্যের ব্যাপক দূষণ এড়ানোর গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হতে পারে।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকজন পরিবেশ সচেতন ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তার পচনশীল ব্যাগ পরীক্ষামুলকভাবে ব্যবহার করেছেন। বিদেশি কয়েকজন ক্রেতাও তার পণ্যে ব্যপক আগ্রহ দেখিয়েছেন।

কিন্তু, সময়মতো পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না পাওয়ায় ইফতেখারুল হক এই ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারছেন না।

রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাহমুদা পারভীন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ২০২৩ সালের মার্চে পচনশীল ব্যাগকে সবুজ পণ্য হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। ফলে এই ধরনের ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বিপণন সহজ হয়ে যায়।

'তবে, কোনটিকে পচনশীল ব্যাগ বলা হবে সে বিষয়ে কোথাও কোনো ব্যাখ্যা নেই,' বলেন তিনি।

ইফতেখারুল হক তার ব্যাগগুলো সবুজ পণ্য হিসেবে প্রত্যয়িত করার জন্য এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছেন। প্রত্যয়ন পেলে পরিবেশগতভাবে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পণ্যটি বাজারজাত করা যাবে বলে জানান তিনি।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার অবস্থা দেখুন, আমার উৎপাদিত ব্যাগ বাজারে এলে পলিথিন দূষণ দূর হবে। কিন্তু, এই ব্যাগ বাজারে আনতে আমাকে কত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অথচ, পরিবেশ দূষণকারী পলিথিন ব্যাগে নির্বিঘ্নে বাজার ছেয়ে আছে।'

বারবার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তর গত আগস্টে উদ্যোক্তা হককে তার পণ্য পচনশীল কি না তা বুয়েট থেকে অনুমোদন নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। তবে পরীক্ষা পদ্ধতি দীর্ঘ হওয়ায় প্রত্যয়ন পেতে আরও সময় লাগছে।

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সত্ত্বেও ইফতেখারুল হক তার ব্যাগ বাজারে আনতে এখনো তৎপর আছেন। তিনি জানিয়েছেন, দেশে পচনশীল ব্যাগের প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকার বাজার আছে। 

আমি একা এই বিশাল চাহিদা পূরণ করতে পারব না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'দেশের পলিথিন কারখানাগুলো সবাই মিলে এই ব্যাগ তৈরিতে এগিয়ে আসতে পারে।' 

'তারা তাদের কারখানায় সামান্য পরিবর্তন এনে পচনশীল ব্যাগ উৎপাদন করতে পারবেন' বলে জানান তিনি।

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০২ সাল থেকে দেশে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ।

তবুও ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে দুই হাজার ১৮৩ কোটিরও বেশি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে প্রায় ৭৮ হাজার ৪৩৩ টন বর্জ্য তৈরি হয়েছে। এগুলো দেশের নালা-নর্দমা ও জলাশয় দূষিত করছে বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

করোনা মহামারির আগে পাটজাত পণ্যের ব্যবসা করতেন ইফতেখারুল হক। তখন তিনি পলিথিন দূষণের বিকল্প খুজতে শুরু করেন।

ইফতেখারুল হক বলেন, 'তখন আমি দেখলাম, পরিবেশবান্ধব হওয়া সত্ত্বেও পাটজাত পণ্য তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল হওয়ায় পলিথিনের সঙ্গে পাল্লা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।'

২০২১ সালে তিনি অনলাইনের মাধ্যমে জানতে পারেন, জার্মান প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেশ কয়েকজন ভারতীয় উদ্যোক্তা পচনশীল শপিং ব্যাগ তৈরি করছেন।

আরও গবেষণা ও ভারতের কয়েকটি কারখানা ঘুরে পরের বছর প্রায় দুই কোটি টাকা বিনিয়োগ করে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় ক্রিস্টাল বায়োটেক কারখানা গড়ে তোলেন ইফতেখারুল হক।

রাজশাহী শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের পাশে দুই বিঘা জমির ওপর তিনি কারখানাটি গড়ে তোলেন।

তিনি ভুট্টার স্টার্চ গ্রানুল আমদানি করে হপার মেশিনে তা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় গলিয়ে নেন। তারপর সেগুলোকে ব্লোয়ার মেশিনে ফুলিয়ে ব্যাগ তৈরি করেন।

ইফতেখারুল হক জানান, ব্যাগের পচনশীলতা নির্ধারণ করতে ছোট দুটি পদ্ধতি আছে।

প্রথমটি হলো—পচনশীল ব্যাগ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, কিন্তু পলিথিন গলে তৈল জাতীয় পদার্থে রুপ নেয়। দ্বিতীয়টি হলো—ডাইক্লোরোমিথেন দ্রবণে এই ব্যাগ গলে যায়, কিন্তু পলিথিন ব্যাগ অপরিবর্তিত থাকে।

ইফতেখারুল হক আরও জানান, তিনি নিজেই পরীক্ষা করে দেখেছেন প্রায় ছয় মাসের মধ্যে তার পচনশীল ব্যাগগুলো পানিতে মিশে যায়।

কয়েকজন স্থানীয় ব্যবসায়ী পরীক্ষামূলকভাবে এসব পচনশীল ব্যাগ ব্যবহার করেছিলেন। ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ক্রেতাদের কাছে পাঠানো নমুনাগুলো সেসব দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো অনুমোদন দিয়েছে।

সম্প্রতি, সুইডেন থেকে একজন ক্রেতা নমুনা ব্যাগ কেনার জন্য ইফতেখারুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।

২০২২ সালের নভেম্বরে ইফতেখারুল হকের সবুজ পণ্যের প্রত্যয়নের আবেদন নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাহমুদা পারভীন জানান, তারা প্রাথমিকভাবে আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কারণ এটি তখন নতুন ধারণা ছিল।

'পরে আবেদনটি আমরা আমাদের সদরদপ্তরে পাঠিয়ে দিই। তাকে গত অগাস্টে বুয়েট থেকে পচনশীলতার প্রত্যয়ন জমা দিতে বলা হয়েছে,' যোগ করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগ ইতোমধ্যে ইফতেখারুল হকের পণ্যটিকে পচনশীল হিসেবে সনদ দিয়েছে। একই অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর) নমুনা পাঠানো হয়েছে।

রাজশাহীতে বিসিএসআইআরের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আহসানুর রাব্বী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই ব্যাগের নমুনা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তারা শিগগিরই প্রতিবেদন দেবেন।'

পচনশীলতার পরীক্ষাকে দীর্ঘ প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'নকল প্রতিরোধে দীর্ঘ প্রক্রিয়া জরুরি।'

ইফতেখারুল হক বলেন, এই দেরির ফলে অনেক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'কারখানার জন্য ঋণ নিয়েছি। ব্যাংকের সুদ গুণতে হচ্ছে। বিনা উৎপাদনে কারখানার ব্যয় বহন করতে হচ্ছে।'

Comments