শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তা শঙ্কায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে

বিদেশি কোম্পানি, মাস্টারকার্ড, বাটা সু, এফবিসিআই,
অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল

শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তা সংকট ও শ্রমিক বিক্ষোভ বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ চলমান পরিস্থিতি তাদের আস্থা কমিয়েছে।

অনেক অঞ্চলে শিল্প পুলিশের উপস্থিতি কমেছে, এ কারণেও বিনিয়োগকারীদের আস্থায় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকে বলছেন, কিছু শিল্প অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য তারা কারো কাছে যেতে পারছেন না। কারণ এই মুহূর্তে কোনো কার্যকর কর্তৃপক্ষ নেই।

বর্তমানে অনেক বিনিয়োগকারী চলমান সংকট সমাধান ও পুনরায় কাজ শুরু করতে কালেক্টিভ বারগেইনিং এজেন্টস (সিবিএ) নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। এই সংকটের মূল কারণ শ্রমিকদের বিক্ষোভ এবং তাদের প্রধান দাবি বেতন বৃদ্ধি করা।

বিনিয়োগকারীরা আরও বলেছেন, শ্রমিকরা বছরের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করে তাদের দাবি জানাচ্ছেন, এটি অস্বাভাবিক। মূলত সরকার পরিবর্তনের পটভূমিতে তারা এই আন্দোলন শুরু করেছে।

তাদের ভাষ্য, 'আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতিতে হয়তো বহিরাগতদের একটি অংশ সুযোগ নিচ্ছে।'

এদিকে আন্দোলনকারীরা কেবল উৎপাদন কাজ বন্ধ রাখছেন না, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারখানা ভাঙচুরের চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন চলতি সপ্তাহে রাজধানীর টঙ্গী এলাকায় একটি বিদেশি কোম্পানির জুতা কারখানায় হামলা চালিয়েছে শ্রমিকরা।

এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কা, শ্রমিক বিক্ষোভ অব্যাহত থাকলে তা তাদের কারখানাতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

বাটা সু কোম্পানির (বাংলাদেশ) রিটেইল ডিরেক্টর আরফানুল হক জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তারা শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং পুলিশের সহায়তাও নিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, তাদের কারখানায় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি পূরণ করায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে।

'গত সপ্তাহে প্রায় ৬০০ নিয়মিত শ্রমিক এবং ৮০০ আউটসোর্সিং শ্রমিক তাদের দাবি জমা দিয়েছেন,' বলেন তিনি।

আরফানুল হক বলেন, 'যেহেতু আমাদের কারখানা একটি বড় শিল্প কেন্দ্রে অবস্থিত, তাই শিল্প পুলিশের সহায়তা পেয়েছি।'

প্রতি বছর কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাক সংগ্রহ করে এমন একটি প্রধান ইউরোপীয় খুচরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিনিধি বলেছেন, শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে তাদের পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে।

তিনি বলেন, কোম্পানির শিপমেন্টে দেরি হচ্ছে, এ বিষয়টি অস্বাভাবিক। আমাদের ধারণা, আসন্ন ক্রিসমাসে এটি আমাদের বিক্রিতে প্রভাব ফলবে।

মাস্টারকার্ড বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, 'পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানিগুলোতেও এই সংকট প্রভাব ফেলছে। এই ধরনের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা জুলাইয়ে ৪০ শতাংশ ও আগস্টে ৩৫ শতাংশ কমেছে।'

তার ভাষ্য, 'স্থানীয় ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কারখানা চালু রাখতে সবচেয়ে বড় বাধা হলো নিরাপত্তার অভাব।'

'শিল্পাঞ্চলগুলোতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে,' বলেন তিনি।

একই কথা বলেছেন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী।

তিনি বলেন, 'একদিনের জন্য হলেও অরাজকতা ব্যবসায়ের জন্য ভালো নয়। আমরা জানি না এই পরিস্থিতির পেছনে কারা আছে। শিল্প পুলিশ এখনো পুরোপুরি কার্যকর না, তাই নিরাপত্তার জন্য আমরা কার কাছে যাব তাও জানি না।'

'জরুরি ভিত্তিতে পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। আমাদের হাতে সময় খুব কম।'

তিনি বলেন, অনেকের মতো আমাদের কর্মীরাও বিক্ষোভ করেছেন, তবে ম্যানেজমেন্ট সিবিএ নেতাদের সঙ্গে বসে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিষয়গুলো সমাধান করেছে।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত বিদেশি কোম্পানি নিউজিল্যান্ড ডেইরির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মহসিন আহমেদ বলেন, 'আমাদের উৎপাদনে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। তবে আমরা শ্রমিকদের সঙ্গে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছি, যেন আমাদের কোনো সমস্যা না হয়।

নিউজিল্যান্ড ডেইরির কারখানায় প্রায় এক হাজার শ্রমিক কাজ করে। এটি গাজী টায়ার কারখানার কাছাকাছি অবস্থিত। গাজী টায়ার কারখানায় ভাঙচুর ও আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

মহসিন আহমেদ মুঠোফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুলিশের মানসিক শক্তি বাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেন তারা সংকটের সময় শিল্প কারখানাগুলোকে সহায়তা করতে পারে।'

সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিদেশি কোম্পানিতে চুক্তিভিত্তিক চাকরি করা অনেকেই স্থায়ী হওয়ার দাবি করেন।

একই কথা বলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের ভাইস চেয়ারম্যান আমিরুল হক আমিন। তিনি বলেন, 'পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শ্রমিকরা অবশ্যই তাদের দাবি উত্থাপন করবেন। বেশিরভাগ বিদেশি কোম্পানিতে ভালো সিবিএ আছে। তাই আশা করছি, তারা ভালোভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে।'

এফআইসিসিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক টি আই এম নুরুল কবির বলেন, বিদেশি কোম্পানির মধ্যে কেবল বাটা বাংলাদেশ তাদের কারখানায় হামলারন কথা জানিয়ে চেম্বারে চিঠি পাঠিয়েছে।

তিনি জানান, আরও দু-তিনটি কারখানাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে তারা এখনো চেম্বারে কোনও অভিযোগ দায়ের করেনি।

তার ভাষ্য, 'এফআইসিসিআই ইতোমধ্যেই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। শিল্পাঞ্চলের যেসব জায়গায় বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে সেখানে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। সেনাবাহিনী একটি হটলাইন নম্বরও দিয়েছে, জরুরি প্রয়োজনে যে কেউ যোগাযোগন করতে পারবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

7h ago