কাঁচামাল আমদানিতে অতি নির্ভরতা, ঝুঁকিতে ওষুধশিল্প

ওষুধ প্রস্তুতকারকরা দেশের চাহিদার প্রায় পুরোটা মেটানোর পাশাপাশি ১৬০ দেশে রপ্তানিও করছে। কিন্তু, প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাঁচামাল আনতে হয় মূলত চীন ও ভারত থেকে।
কাঁচামাল আমদানি ছাড়া দেশের ওষুধশিল্প ইসোমিপ্রাজলের মতো সাধারণ ওষুধও তৈরি করতে পারে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস (এপিআই) তৈরিতে বিনিয়োগের এখনই উপযুক্ত সময়। এই খাতে দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এর বিকল্প নেই। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে বছরে এক দশমিক তিন বিলিয়ন ডলারের আমদানি খরচও বাঁচানো যাবে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য—এপিআই সক্ষমতা তৈরিতে দেরি হলে পেটেন্ট নিয়ে সমস্যা হতে পারে। বাংলাদেশ বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পেটেন্ট ছাড় পায়। আগামী বছরের নভেম্বরে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার পর এই সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে।
ওষুধ প্রস্তুতকারকদের মতে, এখনো প্রায় ৮৫ শতাংশ ওষুধের কাঁচামাল প্রধানত চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা হয়। ওষুধ উৎপাদন ব্যবস্থায় ফাঁক-ফোকর, নিয়ন্ত্রক সংস্থার বাধা এবং দক্ষ কর্মী ও বিনিয়োগের অভাবের কারণে আমদানি করা কাঁচামালগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
এসব সমস্যা সমাধানে এপিআই-নীতি প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
স্কয়ার, বেক্সিমকো, একমি ও ইনসেপটাসহ ছয় দেশি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে আড়াই হাজার কোটি টাকার ৪০ ধরনের এপিআই উৎপাদন করছে।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর রেজা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এপিআই উৎপাদন শুধুমাত্র ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা বন্ধ করতে হবে। এর পরিবর্তে একে জাতীয় কৌশলগত লক্ষ্য হিসেবে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।'
'আমরা যখন এপিআই তৈরির চেষ্টা করি তখন কেবল কাঁচামাল আমদানির অনুমতি পেতে আট-নয় মাস দেরি হয়। কারণ, এতে ১৮টি পৃথক ছাড়পত্রের দরকার পড়ে।'
তিনি আরও বলেন, 'যতক্ষণে আমরা অনুমোদন পাচ্ছি, ততক্ষণে বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বদলে যাচ্ছে বা বাজার চলে যাচ্ছে প্রতিযোগীদের হাতে।'
চীনে এক শিল্পের এপিআই উপজাত অন্য শিল্পে ব্যবহার করা হয়, জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'এভাবেই তারা কম খরচে সমন্বিত ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এখানে এমন ব্যবস্থা দরকার।'
ওষুধশিল্পকে সহায়তার জন্য সরকার ঢাকার অদূরে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় এপিআই শিল্পপার্ক করেছে। জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও গ্যাস সংযোগ নেই। ফলে বিনিয়োগে আগ্রহ পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা।
বেক্সিমকো ফার্মার ওই কর্মকর্তার আশঙ্কা—সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও সিঙ্গেল উইন্ডো ক্লিয়ারেন্স ব্যবস্থা ছাড়া এপিআই পার্ক অব্যবহৃত শিল্পাঞ্চলে পরিণত হতে পারে।
'আমরা বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত। কিন্তু, নীতিগত সমর্থন দরকার' বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির (বাপি) সভাপতি আবদুল মুক্তাদির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ওষুধ ফরমুলেশনে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কিন্তু, এপিআই সক্ষমতা না থাকায় আমাদের ভিত্তি দুর্বল।'
এপিআই পার্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এলপিজি দিয়ে কোনো রাসায়নিক কারখানা চলতে পারে না।'
তার মতে, এপিআই উৎপাদনে বিনিয়োগর অভাব আরেক বড় সংকট।
বাপি সভাপতির মতে—বাংলাদেশে ব্যাংক সুদের হার ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। ভারত ও চীনে যা তিন থেকে পাঁচ শতাংশ। এ কারণে বাংলাদেশে এপিআই উৎপাদনে বিনিয়োগ পাওয়া কঠিন।
তিনি এপিআই উৎপাদনের পূর্বশর্ত প্রসেস কেমিস্ট্রি ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দক্ষ কর্মীর ঘাটতির কথাও জানিয়েছেন।
বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় মহামারি-পরবর্তী সময়ে নতুন সুযোগ এসেছে। কারণ, পশ্চিমের দেশগুলো চীনের এপিআই সরবরাহকারীদের বিকল্প খুঁজছে।
তিনি মনে করেন, বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই খাতে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তবে এর পরিধি বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সহযোগিতা দরকার।
'আমাদের ভর্তুকির দরকার নেই। আমাদের দরকার জ্বালানি ও বিনিয়োগের মতো মৌলিক সহায়তা। সরকারকেও স্বীকার করতে হবে যে এপিআই একটি জাতীয় অবকাঠামো।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশ পেটেন্ট ছাড়ের সুবিধা হারালে পেটেন্টযুক্ত এপিআই তৈরির খরচ ও জটিলতা বহুগুণ বেড়ে যাবে।'
বিকন মেডিকেয়ারের প্রধান নির্বাহী মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এপিআই উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ দরকার। বিশেষ করে, ক্যানসারের ওষুধের জন্য। ভারত ও চীন নিজেদের বিশাল বাজারের কারণে তা বহন করতে পারে। বিশ্ববাজারে প্রবেশাধিকার না পেলে এ ধরনের বিনিয়োগ বাংলাদেশে টেকসই হবে না।'
তিনি এপিআই উৎপাদনের জন্য বাধ্যতামূলক এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) স্থাপনের প্রচুর খরচ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
'ইটিপির জন্য প্রচুর টাকা প্রয়োজন। সরকারি সহযোগিতা ছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে তা বহন করা কঠিন। সরকার যদি গবেষণা, উন্নয়ন ও পরিবেশগত ছাড়ে সহায়তা দেয় তবে কম খরচে এপিআই উত্পাদন সম্ভব।'
Comments