ডলার সংকটের প্রভাব ওষুধ শিল্পে

দেশের ওষুধ শিল্পের অগ্রগতির কারণে তুলনামূলক কম খরচেই জীবন রক্ষাকারী ওষুধ কিনতে পারছেন সাধারণ মানুষ। তবে, ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করতে ক্রেডিট লেটার (এলসি) খুলতে সমস্যায় পড়ছেন ওষুধ প্রস্তুতকারীরা।
বরিশাল সদরে একটি ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনছেন বেশ কয়েকজন গ্রাহক। শিগগির এসব ওষুধ কিনতে তাদের আরও বেশি টাকা দিতে হতে পারে। কারণ, জ্বালানি ও ডলার সংকটে উত্পাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে দাম সমন্বয় করতে বাধ্য হচ্ছে ওষুধ প্রস্তুতকারকরা। ২২ জানুয়ারি ২০২৩। ছবি: টিটু দাস/স্টার

দেশের ওষুধ শিল্পের অগ্রগতির কারণে তুলনামূলক কম খরচেই জীবন রক্ষাকারী ওষুধ কিনতে পারছেন সাধারণ মানুষ। তবে, ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করতে ক্রেডিট লেটার (এলসি) খুলতে সমস্যায় পড়ছেন ওষুধ প্রস্তুতকারীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারীরা চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে ৪৬৫ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খুলেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৪১ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ৫৯৯ দশমিক ৮৫ মিলিয়ন ডলার।

একইভাবে, ওষুধ উৎপাদন খাতে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য গত জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এলসির পরিমাণ ৩৫ দশমিক ১৫ শতাংশ কমে ৬৫ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ডলার হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে দেশের ওষুধ উৎপাদকরা ঠিক সময়ের মধ্যে ওষুধ রপ্তানি করার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। কেননা, এই ব্যর্থতা বাংলাদেশের ওষুধ খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে।

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ওষুধ শিল্প একটি চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় ব্যাংকগুলো এলসি খুলতেও দেরি করছে।'

তিনি আরও বলেন, 'দেশের ওষুধ উৎপাদকরা পর্যাপ্ত কাঁচামাল আনতে না পারলে উৎপাদন ব্যাহত হবে।'

বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদন খাতের জন্য বছরে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। কারণ স্থানীয়ভাবে ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি কাঁচামাল সংগ্রহ করা যায় না।

দেশের ওষুধ শিল্প স্থানীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'ব্যাংকগুলো অনেক সময় তাদের অফশোর শাখায় এলসি আবেদন পাঠায়, যাতে মার্কিন ডলারে আমদানি বিল পরিশোধ করতে পারে। এতে করে এলসি খোলার জন্য ব্যয় বাড়তে পারে।'

ক্রমবর্ধমান আমদানির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকায় এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ গুরুতর ডলার ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে।

ডলার বাঁচাতে অপ্রয়োজনীয় আমদানি সীমিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমদানির বিষয়ে কঠোর হওয়ায় গত জুলাই থেকে ডিসেম্বরে মধ্যে বাংলাদেশে সামগ্রিক এলসি খোলার হার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ শতাংশ কমেছে।

এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা এম মহিবুজ জামান বলেন, 'উদ্যোক্তারা এলসি খোলার জন্য পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছেন না। এলসি খোলার অনুমোদন দিতে ব্যাংকগুলো বেশি সময় নিচ্ছে, এতে লিড টাইম দীর্ঘায়িত হচ্ছে।'

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের ওষুধ প্রস্তুতকারকরা সময়মতো কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না উল্লেখ করে মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান বলেন, 'এতে করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে আমদানিকারকরা তাদের কাঁচামাল বন্দর থেকে সময়মতো খালাস করতে পারেন না, কারণ ব্যাংক এলসি নিষ্পত্তি করতে পারে না।'

তিনি আরও বলেন, 'কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ মার্জিন দেওয়ার পরেও আমরা এলসি খুলতে পারছি না।'

এই সংকটের আশু সমাধান দেখছেন না শফিউজ্জামান।

তিনি বলেন, 'সরকারের উচিত গুরুত্ব বিবেচনায় ওষুধ উৎপাদন খাতের জন্য এলসি খুলতে অগ্রাধিকার দেওয়া। দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি না হলে স্বাস্থ্যখাতের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।'

বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের গ্লোবাল বিজনেস ডেভেলপমেন্টের পরিচালক মঞ্জুরুল আলম বলেন, 'আপাতত এলসি খুলতে সমস্যা হওয়ায় এই খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে ২০২৩ সালে আরও কয়েকটি নতুন দেশে ওষুধ রপ্তানি শুরু হতে পারে। তখন হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে পারে।'

তার মতে, চলমান ডলার সংকট এবং সর্বশেষ গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে ব্যবসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশের ওষুধ শিল্প।

গত ১৮ জুন শিল্প, বিদ্যুতকেন্দ্র এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্যাসের খুচরা মূল্য ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১৭৮ দশমিক ৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার।

বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বৃদ্ধির এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে এই সিদ্ধান্তও আসে।

মহিবুজ জামান বলেন, 'বৈশ্বিক বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ওষুধ শিল্পের জন্য বড় বোঝা। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এই খাত অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং টিকে থাকার লড়াইয়ে নামতে হবে।'

মঞ্জুরুল আলম স্বীকার করেন যে এলসি খোলার বিধিনিষেধের মধ্যে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় ওষুধ শিল্প অনেক সমস্যায় পড়েছে।

তিনি বলেন, 'ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এড়ানোর উপায় নেই।'

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য প্রায় ২৫ কমেছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার সহায়তা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য ও সুস্থতা খাদ্য ও জ্বালানির মতোই অপরিহার্য। তাই, ওষুধের সরবরাহ, প্রাপ্যতা ও দাম যাতে প্রভাবিত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।'

ওষুধ প্রস্তুতকারীদের জন্য এলসি নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি উইন্ডো খোলার আহ্বান জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম।

তিনি বলেন, 'গ্যাসের দাম বেড়েছে। ফলে ওষুধ প্রস্তুতকারকদের উৎপাদন খরচ বেশি হবে। কিন্তু বাড়তি উৎপাদন খরচের পুরোটা ভোক্তাদের কাছ থেকে নেওয়াও যাচ্ছে না।'

জাহাঙ্গীর জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদনের পরই কেবল ওষুধের মূল্য সমন্বয় সম্ভব।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সম্প্রতি দেশের ওষুধ রপ্তানিতে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। গত জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ওষুধের চালান ১২ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ কমে ৯২ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

Comments