রাজস্ব বোর্ডকে ভাগ করলে কতটুকু সুফল মিলবে?

কর প্রশাসনকে আধুনিক করা, রাজস্ব বাড়ানো ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দুটি নতুন বিভাগ গড়তে যাচ্ছে সরকার।
বোর্ড ভেঙে দেওয়ার খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি হয়েছে। এতে পরিবর্তনের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।
'রাষ্ট্রীয় নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ-২০২৫'র খসড়ায় রাজস্ব বোর্ড ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করা হবে। এর পরিবর্তে গঠন করা হবে—রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
রাজস্ব আদায়ে রাজস্ব বোর্ডের ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিতর্ক সামনে এসেছে যে, সংস্কার হিসেবে চিহ্নিত এই উদ্যোগটি অর্থবহ সংস্কার আনবে নাকি আমলাতন্ত্রের জটিলতা আরও বাড়াবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। এটি বর্তমানে বিশ্বের সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটের এপ্রিল সংখ্যায় বিশ্বব্যাংকও কর, নীতিনির্ধারণী ও প্রশাসনকে আলাদা করার পরামর্শ দিয়েছে।
বাহ্যিক চাপ ছাড়াও নীতিগত প্রশ্ন আছে। একই প্রতিষ্ঠানকে করনীতি তৈরি ও তা প্রয়োগের দায়িত্ব দেওয়া উচিত নয়।
এমন পরিস্থিতিতে অনেকের বিশ্বাস, বোর্ডকে দুইভাগে ভাগ করা হলে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কর হয়রানির বিষয়ে ক্রমাগত অভিযোগের সমাধান করা যেতে পারে এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা আসতে পারে।
অন্যদের আশঙ্কা, এটি আমলাতন্ত্রের মধ্যে পদোন্নতি ও ক্ষমতা একীকরণের সুযোগ তৈরি করবে।
কর আদায়ে ব্যর্থতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বিপর্যস্ত প্রতিষ্ঠানটিকে ভেঙে নতুন প্রতিষ্ঠান করা হলে তা সত্যিই সুফল আনবে নাকি পুরোনো সমস্যা নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঁধে চাপবে—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া মনে করেন, তত্ত্বগতভাবে এই উদ্যোগকে সময়োপযোগী ও আধুনিক হিসেবে দেখা যেতে পারে।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখন একটি প্রতিষ্ঠান নীতিনির্ধারণ, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পরিচালনা করে তখন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।'
তার যুক্তি, একটি স্বাধীন নীতি বিভাগ বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন ও নিরপেক্ষ তদারকি নিশ্চিত করবে। তবে এর সাফল্য নির্ভর করবে পদ্ধতিগত সমস্যা মোকাবিলার ওপর।
খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, একজন সচিব বা জ্যেষ্ঠ সচিবকে নতুন নীতি বিভাগের প্রধান করা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে তাদের অভিজ্ঞতা কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে?
স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, প্রশাসনিক সক্ষমতার বাইরেও রাজস্বনীতি, আন্তর্জাতিক কর ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি।
'বিশাল ফারাক'
রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার এগিয়ে নিতে গত বছরের ৯ অক্টোবর উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বোর্ডের সাবেক দুই চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবদুল মজিদ ও নাসিরউদ্দিন আহমেদ; সাবেক কর সদস্য দেলোয়ার হোসেন ও আমিনুর রহমান; এবং কাস্টমসের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন।
অর্থ উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া কমিটির প্রতিবেদনে রাজস্ব প্রশাসনকে নীতিনির্ধারণী থেকে আলাদা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে।
উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ফরিদ উদ্দিন খসড়া অধ্যাদেশের সুপারিশ আমলে না নেওয়ার সমালোচনা করছেন। তিনি তাদের সুপারিশ ও খসড়ার রূপরেখার মধ্যে 'বিপর্যয়কর ফারাক' পেয়েছেন।
ফরিদ উদ্দিন বলেন, 'এই অধ্যাদেশ রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে বিশৃঙ্খলার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তারা অহেতুক বিষয়টিকে জটিল করে তুলেছেন।'
খসড়ার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'রাজস্ব আদায়ে অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার অঙ্গীকারটি ফাঁপা। কারসাজির দরজা খোলা আছে।'
তিনি উল্লেখ করেন যে, স্ট্যাম্প ডিউটিতে সামান্য অভিজ্ঞতা আছে এমন মানুষ নিজেকে রাজস্ব বিশেষজ্ঞ বলে দাবি করতে পারেন।
'স্ট্যাম্প ডিউটিতে কয়েকদিন কাজ করার পর প্রশাসনের যে কেউ সেখানে পোস্টিং পেতে পারেন। ফারাকটা বিশাল। এটি সত্যিই বিরক্তিকর। বিপর্যয়করও।'
তিনি জানান, কমিটি জ্যেষ্ঠতা বা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের পরিবর্তে রাজস্ব বিষয়ে দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে নিয়োগের প্রস্তাব করেছে।
'এখন খসড়া অধ্যাদেশে নিয়োগ দেওয়া হলে স্বেচ্ছাচারিতার আশঙ্কা আছে। সরকারের পক্ষ থেকে যে কাউকে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। আরও অব্যবস্থাপনায় পুরো ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়ার ঝুঁকি আছে।'
তিনি আরও বলেন, খসড়া অধ্যাদেশে অস্ট্রেলিয়ার রাজস্ব বিভাগের আদলে সুপারিশ করেছিলাম। তবে অধ্যাদেশে সেগুলো উপেক্ষা করা হয়েছে।
রাজস্ব নীতি বিভাগ রাজস্ব প্রশাসন বিভাগের কার্যক্রম দেখভাল করবে—এমন বিধানেরও সমালোচনা করেন তিনি। তার মতে, 'নীতি বিভাগের এটা করা উচিত নয়।'
একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আরেক সদস্য আমিনুর রহমান।
তিনি জানান, তাদের লক্ষ্য ছিল মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। অনেকটা বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো। খসড়া অধ্যাদেশে তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
'আমাদের লক্ষ্য ছিল কাঠামোগত পরিবর্তন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে অনেক সময় অংশীদারদের স্বার্থ ও অসুবিধার কথা যথাযথভাবে বিবেচনা না করেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই।'
এ কারণেই কমিশনে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধি নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
আরেকটি মূল সুপারিশ ছিল যে উভয় বিভাগের প্রধানদের রাজস্ব বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তাদেরকে হয় রাজস্ব ক্যাডার হতে হবে নয় সমমানের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
'কিন্তু অর্ডিন্যান্সে সেই বাধ্যবাধকতা একেবারেই বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন সরকার পছন্দমতো যে কোনো কর্মকর্তাকে সচিব হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে। গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে রাজস্বনীতি সম্পৃক্ত থাকলে প্রকৃত সংস্কার সুদূরপরাহত থেকে যাবে।'
তিনি আশা করেন যে সরকার গেজেট প্রকাশের আগে বিষয়গুলো সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেবে।
কর সমিতির উদ্বেগ
বিসিএস ট্যাক্সেশন অ্যাসোসিয়েশন ও বিসিএস (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশনসহ কর সমিতিগুলো খসড়া অধ্যাদেশের বিরোধিতা করে বলেছে, এতে সরকারের সংস্কার প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
গতকাল রোববার এক বিবৃতিতে কাস্টমস ও ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, 'নীতিনির্ধারণী ও দায়িত্বশীল পর্যায়ে এই দুই ক্যাডারের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা ও নীতির মধ্যে মারাত্মক পার্থক্য হতে পারে। এটি রাজস্ব সংস্কারের মৌলিক লক্ষ্যকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে।'
সমিতি বলেছে, নীতি বিভাগকে কর প্রয়োগ পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হলে আইনি দ্বন্দ্ব হতে পারে।
বিসিএস ট্যাক্সেশন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, 'রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে তারা রাজস্ব বোর্ডকে ভাগ করার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।'
'আমাদের দুই ক্যাডারকে কোণঠাসা করে নির্দিষ্ট ক্যাডারের পেশাজীবীদের আনার উদ্যোগ নেওয়া হলে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে যাবে।'
'বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে ফলাফল'
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গঠিত শ্বেতপত্র প্যানেলের সদস্য অধ্যাপক আবু ইউসুফ রাজস্ব বোর্ড ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও অধ্যাদেশের যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দেন।
তিনি বলেন, 'রাজস্ব বোর্ড ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তা হলো—প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো ও পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমানো। সঠিক ব্যক্তিদের সঠিক পদে বসিয়ে করের পরিধি বাড়ানো।'
'তবে সবকিছুই নির্ভর করছে বাস্তবায়নের ওপর' উল্লেখ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) নির্বাহী পরিচালক ইউসুফ বলেন, 'কাগজে-কলমে সংস্কার অনেক সময় সঠিক মনে হয়, কিন্তু বিষয়টি নির্ভর করে বাস্তবায়ন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।'
'নীতিনির্ধারণী ও রাজস্ব আদায় যদি স্বাধীনভাবে ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া পরিচালিত হতে পারে তবে সত্যিকার অর্থে আমাদের আর্থিক ভবিষ্যৎকে নতুন রূপ দিতে পারবো।'
Comments